ফিচার ঢাকা বাংলাদেশ

মেট্রোরেল বদলে দিয়েছে ঢাকাবাসীর জীবনচিত্র

image 123748 1706184498
print news

বাসস : সকাল থেকে রাত পর্যন্ত মেট্রোরেল চালু হওয়ায় বদলে গেছে ঢাকাবাসীর জীবনচিত্র। সকাল ৯ টায় অফিসে পৌঁছানোর জন্য কিংবা সকাল ৮ টার ক্লাসে হাজিরা দেয়ার জন্য এখন আর ভোর ছয়টায় দৌড়াতে হয় না।
শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মজীবীসহ সকল শ্রেণী পেশার মানুষ এখন স্বস্তিতে ভ্রমণ করেন মেট্রোতে। সবার মধ্যে তাড়া আছে কিন্তু উদ্বেগ, উৎকন্ঠা বা বিরক্তি নেই।
‘মেট্রোরেল একটা চমৎকার ব্যাপার। ভাবতেই ভালো লাগে। মানুষগুলো সকাল-সন্ধ্যা কাজের জন্য ছুটছে। কিন্তু তাদের কোন ক্লান্তি নেই। বিরক্তি নেই। চেহারায় উৎকন্ঠা নেই। কারণ, তারা জানে যে তারা যথাসময়ে গন্তব্যে পৌঁছাবে’, বললেন পুরানা পল্টন লাইনের বাসিন্দা ইলোরা লিলিথ। পেশায় ফ্যাশন ডিজাইনার। তার একমাত্র বাচ্চা তূর্ণ বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশু। ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট-এ অবস্থিত বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের স্কুল ‘প্রয়াস’ এ ভর্তি হয়েছে সে। এতোদূর কিভাবে যাওয়া আসা করবেন তাই নিয়ে দূর্ভাবনায় ছিলেন। কিন্তু মেট্রোরেল তার সমস্যার সমাধান করে দিয়েছে। প্রতিদিন বাংলাদেশ সচিবালয় স্টেশন থেকে মেট্রোতে করে কারওয়ান বাজার নামেন। সেখান থেকে এসি বাসে বাচ্চার স্কুল। কোন ঝামেলা ছাড়াই সময় মতো পৌঁছে যেতে পারেন স্কুলে।
সারাদিনের ক্লাস শেষে ভিড় মেট্রোতে মায়ের আঁচল ধরে দাঁড়িয়ে থাকা অর্চিশার ক্লান্তি নেই। সে অনর্গল কথা বলছিল, ‘এখন অনেক মজা। মা রোজ সকালে স্কুলে দিয়ে যায়। আবার বিকেলে মা এসে নিয়ে যায়। আর আগের চেয়ে অনেক তাড়াতাড়ি বাসায় যাই। তাই, বিকেলে মা পাড়ার বন্ধুদের সাথে খেলতে দেয়।’ উদয়ন উচ্চ বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্রী অর্চিশা প্রতিদিন শেওড়াপাড়া থেকে বাসে এসে ক্লাস করতো। পথে জ্যামের কারণে প্রায়ই বাসায় ফিরতে সন্ধ্যে হতো। এখন মেট্রোতেই আসা-যাওয়া করে। শাহবাগ থেকে ১৫ মিনিটেই বাসায় পৌঁছাতে পারে।
সংবাদকর্মী আখতার জামান ১৫ বছর ধরে মিরপুর থেকে পল্টন অফিস করেন। নিজে গাড়ি চালিয়েও প্রতিদিন তেল খরচ হতো ১০০০ টাকা। কখনো বা তার চেয়েও বেশি। আর এখন খরচ হয় ১০৮ টাকা। ট্রাফিক জ্যাম এড়াতে সকাল ৭টায় রওয়ানা দিয়ে জাতীয় প্রেসক্লাবে নাস্তা খেয়ে অফিসে ঢুকতেন। অফিস সময় ৯টা ৩টা। কিন্তু কোনদিনই সন্ধ্যার আগে বাড়ি পৌঁছাতে পারতেন না। এখন তিনি নিয়মিত মেট্রোরেলে যাতায়াত করেন।
আখতার জামান বলেন, ‘এটা যে কী দারুন ব্যাপার তা বলে বোঝাতে পারবো না। আমি প্রতিদিন ভোরে বাচ্চাকে স্কুলে দিয়ে বাসায় ফিরি। গোসল এবং নাস্তা করে অফিসের জন্য তৈরি হয়ে বাচ্চাকে স্কুল থেকে আনতে যাই। বাচ্চাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে পায়ে হেঁটে মেট্রো স্টেশনে আসি। প্রতিদিন বাসার বাইরে নাস্তা খেতে হয় না। বাচ্চাদের সময় দিতে পারি। এতোকিছু করেও আমি ১২ টার মধ্যে অফিসে পৌঁছে যাই। আবার ৫ টায় বের হয়ে সন্ধ্যা ৬টার আগেই বাসায় পৌঁছাই।’
আবার যারা মেট্রোর পুরো রুটটা ব্যবহার করতে পারছেন না, তারাও সময় বাঁচাতে কাছাকাছি মেট্রো স্টেশন থেকে যাচ্ছেন নিজ গন্তব্যের কাছাকাছি কোন স্টেশনে। তারপর সেখান থেকে রিক্সা, টেম্পু, সিএনজি এমনকি বাসেও যাতায়াত করছেন।
যারা ভীড় এড়াতে ব্যক্তিগত গাড়িতে যাতায়াত করতেন তারাও এখন মেট্রোতে যাতায়াত করতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছেন। কারণ, ঘড়ির কাটায় চলা মেট্রোরেলে যাতায়াতে ট্রাফিক জ্যামের ঝুঁকি নেই। তেমনি নেই মাথা নিচু করে দেরি করে অফিসে পৌঁছানো, কিংবা প্রতিদিন অফিসের বকুনি খাওয়া। স্কুলে দেরি করার জন্য জবাবদিহি করার ঝামলাও নেই।
ছয় বছর ধরে স্কুলের বাস অথবা প্রাইভেট গাড়িতে পুরানা পল্টন থেকে মিরপুর যাতায়াত করে স্কলাসটিকার অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী মূর্চ্ছনা। প্রতিদিন স্কুল ছুটির পর বাসায় ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যেতো। প্রতিদিন ভোর ছয়টায় বাসা থেকে বের হয়ে সন্ধ্যা ছয়টায় বাসায় ফিরতো। কাজেই রুটিন অনুযায়ী কিছুই করা হতো না। কিন্তু সকাল-সন্ধ্যা মেট্রোরেল চালু হওয়ার পর মূর্চ্ছনা এখন মেট্রোতে যাতায়াত করে। সকাল সাতটায় বাসা থেকে বের হয়ে আটটার মধ্যে পৌঁছে যায় স্কুলে। আর বাসায় ফিরতে পারে বিকেল চারটার মধ্যেই।
মূর্চ্ছনা জানায়, ঘন্টার পর ঘন্টা গাড়িতে বসে থাকায় শারিরীকভাবেও অনেক ক্ষতি হয়েছে। ট্রেনে যাতায়াত করলে যে শারীরিক পরিশ্রম হয় সেটা তাকে অনেক স্বস্তি দিয়েছে। এখন বিকেলটা অনেক বড়। তাই নিজের জন্যও একটু সময় পাওয়া যায়।
যারা প্রতিদিন অফিস, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমনকি ব্যক্তিগত কাজে বাইরে বেরুলে ঘন্টার পর ঘন্টা পথে বসে থাকতে বাধ্য হতেন তারা সবাই স্বস্তির নিশ্বাস নিচ্ছেন। তারা একটু ঘুর পথে হলেও মেট্রোতেই যাতায়াত করছেন। বিশেষ করে উত্তরার বাসিন্দারা এই সুবিধা ভোগ করতে পারছেন। আবার মোহাম্মদপুরের বাসিন্দারা জ্যাম এড়াতে আগারগাঁও থেকে মেট্রোতে করে মতিঝিল যাচ্ছেন। আবার যারা পথের ট্রাফিক জ্যামের কথা ভেবে অফিস শেষে একটু দেরি করেই বাসায় ফিরতেন, তারাও এখন মেট্রোরেলের সুবিধা নিতে আগে আগে বাড়ি ফিরছেন। এতে করে পরিবারের সাথে তারা বেশি সময় কাটাতে পারছেন।
২০২২ সালের ২৮ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মেট্রোরেলের উদ্বোধন করেন। প্রথম ধাপে সপ্তাহে ছয় দিন সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত উত্তরা উত্তর থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত মেট্রোরেল চালু করা হয়।
দ্বিতীয় ধাপে গত ৪ নভেম্বর আগারগাঁও থেকে মতিঝিল অংশের উদ্বোধন করেন তিনি। ২০২৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর পুরোদমে চালু হয় ঢাকা মেট্রোরেল। এদিন চলাচলের সময়সূচি অপরিবর্তিত রেখে উত্তরা উত্তর থেকে মতিঝিল পর্যন্ত সবক’টি স্টেশনে মেট্রো ট্রেন থামতে শুরু করে। উত্তরা উত্তর থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মোট ১৬টি স্টেশন রয়েছে।
তৃতীয় ধাপে গত ২০ জানুয়ারি থেকে উত্তরা উত্তর থেকে মতিঝিল পর্যন্ত সকাল ৭টা ১০ মিনিট থেকে রাত ৮টা ৪০ মিনিট পর্যন্ত ট্রেন চলাচল শুরু হয়েছে। শুক্রবার ছাড়া প্রতিদিন এ সময়সূচি অনুযায়ী ট্রেন চলাচল অব্যাহত রয়েছে।
ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল) এর অফিস সুত্রে জানা যায়, প্রতিদিন সকাল ৭টা ১০ মিনিট থেকে সকাল ১১টা ৩০ মিনিট এবং বিকাল ৪টা ১ মিনিট থেকে রাত ৮টা ১০ মিনিট পর্যন্ত ১০ মিনিট পর পর মেট্রো ট্রেন স্টেশনে থামবে। অফ পিক আওয়ারে (সকাল সাড়ে ১১টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত) ১২ মিনিট পর পর মেট্রো ট্রেন স্টেশনে থামবে। উত্তরা থেকে প্রথম ট্রেনটি সকাল ৭টা ১০ মিনিটে ছাড়বে এবং মতিঝিল থেকে সর্বশেষ ট্রেন ছাড়বে রাত ৮টা ৪০ মিনিটে। তবে, সকাল সাড়ে ৭টার আগে ও রাত ৭টা ৪৫ মিনিটের পর কেবল এমআরটি বা র‌্যাপিড পাস ব্যবহারকারীরা যাতায়াত করতে পারবেন। কারণ, রাত ৭.৪৫ মিনিটের পর সকল টিকিট বিক্রয় অফিস এবং টিকিট বিক্রয় মেশিন বন্ধ হয়ে যায়।
মেট্রোরেলের স্বপ্নযাত্রা শুরু হয় ২০১২ সালের ১৮ ডিসেম্বর। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একনেক সভায় এই মেগা প্রকল্পটির অনুমোদন দেন। ঢাকার প্রথম মেট্রোরেল লাইন (উত্তরা-মতিঝিল) নির্মাণকাজ ২০১৬ সালের ২৬ জুন শুরু হয়।

 

* সর্বশেষ  গুরুত্বপূর্ণ  সব  সংবাদ, ছবি ,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন লেখা পেতে আমাদের  ফেসবুক পেইজে  লাইক  দিয়ে  অ্যাকটিভ  থাকুন।  ভিজিট করুন : http://www.etihad.news

* অনলাইন  নিউজ পোর্টাল  ইত্তেহাদ নিউজে  লিখতে  পারেন  আপনিও লেখার বিষয়  ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি প্রকৃতি আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন  [email protected] ঠিকানায়
সংবাদটি শেয়ার করুন....
ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক :

ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক :

About Author

etihad news is one of the famous Bangla news portals published from Abudhabi-UAE. It has begun with a commitment to fearless, investigative, informative, and independent journalism. This online portal has started to provide real-time news updates with maximum use of Smart Technology.

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *