সীমান্তে ভারতীয় বাহিনীর গুলি চালানো কতটা সমীচীন


তাওহিদুল ইসলাম : সীমান্তে ভারতীয় বাহিনীর গুলিতে একের পর এক প্রাণ হারাচ্ছে বাংলাদেশি নাগরিক। গত ৯ বছরে ২৪৫ জন বাংলাদেশি হত্যার শিকার হয়েছে। গত সোমবার ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের গুলিতে বর্ডার গার্ড বাংলাশের (বিজিবি) এক সদস্য নিহত হওয়ার পর পুরোনো আলোচনা নতুন করে শুরু হয়েছে।
সবশেষ ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে দুদেশের প্রধানমন্ত্রী যৌথ বিবৃতিতে সীমান্তহত্যা শূন্যের কোঠায় নামানোর প্রতিশ্রুতি দিলেও কোনো কাজ হয়নি। কেন এই পরিস্থিতির সুরাহা হচ্ছে না, সীমান্তে গুলি চালানো কতটা সমীচীন- এসব প্রশ্ন এখন সর্বত্র। মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য বলছে, ২০১৫-২৩ সাল পর্যন্ত নয় বছরে বিএসএফের হাতে ২৪৫ জন বাংলাদেশি প্রাণ হারায় সীমান্তে। আর সর্বশেষ চলতি বছরে প্রথম সীমান্ত হত্যার শিকার হলেন বাংলাদেশি সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবির একজন সদস্য।
বাংলাদেশে টানা ১৫ বছর ধরে ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ সরকার। সীমান্তহত্যা শূন্যের কোঠায় নামাতে এই সরকারের সঙ্গে ভারতীয় সরকারের বহু আলোচনার কথা শোনা গেলেও তার কার্যকারিতা দৃশ্যত নেই। ভারতের শীর্ষ পর্যায় থেকে দফায় দফায় এ নিয়ে অঙ্গীকার করেছে। কিন্তু সীমান্ত হত্যা বন্ধ হয়নি। সীমান্তে চলছে প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহার।
সীমান্তে প্রাণঘাতী আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার নিয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুই দেশের বিজিবি-বিএসএফের মধ্যে পতাকা বৈঠকে যে সিদ্ধান্ত হয় তা বাংলাদেশ মানলেও ভারত মানছে না। সীমান্তে গুলি করে মানুষ হত্যা একেবারে অগ্রহণযোগ্য। সীমান্তে বাংলাদেশের জনগণকে একতরফা হত্যা করা হচ্ছে, এটা বোঝাই যাচ্ছে। এই হত্যাকাণ্ড বন্ধ করতে ভারত-চীনের মতো কোনো চুক্তি সমাধান হতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সীমান্তে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার না করা সংক্রান্ত কোনো প্রতিশ্রুতিই ভারত রাখছে না। সীমান্তে গুলি করে মানুষ হত্যা অগ্রহণযোগ্য।
আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, সীমান্তরক্ষী বাহিনী আত্মরক্ষার প্রয়োজনে প্রথমে সতর্ক করতে ফাঁকা গুলি ছুঁড়তে হবে। যদি এতে হামলাকারী নিবৃত না হয় এবং জীবনের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায় সেক্ষেত্রে গুলি ছোঁড়া যাবে। তবে সেটা হতে হবে অবশ্যই হাঁটুর নিচের অংশে। কিন্তু এসবের কোনো তোয়াক্কাই যেন করছে না ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী।
হত্যার শিকার অধিকাংশই বিভিন্ন চোরাচালান কর্মের সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ বিএসএফের। কিন্তু দুই দেশের আইন অনুযায়ী, কেউ অনুপ্রবেশ করলে, কাঁটাতার কাটলে বা পাচারের চেষ্টা করলে তাদের গ্রেপ্তার করে ওই দেশের আইনানুযায়ী বিচার করতে হবে। কিন্তু কোনো অবস্থাতেই গুলি ছোঁড়া বা নির্যাতন করা যাবে না। এই আইনের তোয়াক্কা করছে না বিএসএফ।
এছাড়া বাংলাদেশ ও ভারত উভয় দেশ সীমান্তে প্রাণঘাতী বা লেথাল উইপন ব্যবহার না করার কথা বলে আসছে। কিন্তু সীমান্তে তা ব্যবহার করা হচ্ছে, যার আলামত পাওয়া যাচ্ছে নিহতের শরীরে। যদিও সীমান্ত হত্যা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি (ভারত) দেশটি দিয়েছে বারবার, এখনো দিচ্ছে। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকেও বারবার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কোনো প্রতিশ্রুতিই রাখছে না ভারত।
গত বছরের ১৫ জুন বিজিবি সদর দপ্তরে বিজিবি-বিএসএফ মহাপরিচালক পর্যায়ের ৫৩তম সীমান্ত সম্মেলনে সীমান্ত হত্যা বন্ধে ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ সীমান্তে নন লেথাল (অপ্রাণঘাতী) অস্ত্র ব্যবহারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। বিজিবি-বিএসএফ রিজিয়ন কমান্ডার ও ফ্রন্টিয়ার আইজি পর্যায়ে চার দিনব্যাপী সীমান্ত সম্মেলন শেষে গেল বছরের ৫ সেপ্টেম্বর এক যৌথ বিবৃতিতে সীমান্ত হত্যা কমিয়ে আনার লক্ষ্যে বিএসএফের পক্ষ থেকে নন-লেথাল বা সীমান্তে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার না করার নীতি অনুসরণের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করা হয়। কিন্তু এই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন হয়নি। সর্বশেষ গত সোমবার বিএসএফের গুলিতে বিজিবি সদস্য সিপাহী মোহাম্মদ রইসুদ্দীন নিহত হয়েছেন।
সীমান্ত হত্যা বিষয়ে বাংলাদেশের জাতীয় মানবাধিকার কমিশন বলছে, সীমান্ত হত্যা কোনোক্রমেই গ্রহণযোগ্য নয়। আর প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার কখনই সমীচীন না। কাউকে মেরে ফেলার অধিকার কারো নেই।
এ বিষয়ে নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর (অব.) এমদাদুল ইসলাম বলেন, “সীমান্তে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার না করতে উভয় দেশেরই কথা ছিল। শান্তিকালীন অবস্থায় কোনো অবস্থাতেই অস্ত্র ব্যবহার করার কথা নয়। যদি করে থাকে তারা চরম অন্যায় করেছে।
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো. তৌহিদ হোসেন বলেন, “ভারতের লোকজন রেয়ারলি দুই-একজন মারা যায়। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষই বেশি মারা যাচ্ছে সীমান্তে। এ নিয়ে ভারত কখনো কথাও বলত না। কিন্তু ইদানীং যখন দুই দেশের তথাকথিত ভালো সম্পর্কের কথা চলছে, তখন তারা বলতে শুরু করল যে শুধু বাংলাদেশের নয়, সীমান্তে আমাদেরও (ভারত) মারা যাচ্ছে।”
তৌহিদ হোসেন বলেন, “চীন-ভারত সীমান্তে গুলি করা নিষেধ। সেখানে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে প্রতিনিয়ত গুলি চালানো হচ্ছে। সীমান্তে গুলি করে মানুষ হত্যা একেবারে অগ্রহণযোগ্য। পৃথিবীর মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ দুই দেশের সীমান্তে গুলি করে মানুষ মারা হয় এমন কোনো সীমান্ত নেই।”
হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের চেয়ারপারসন অ্যাডভোকেট এলিনা খান বলেন, “কেন সীমান্ত হত্যার শিকার হবে আমাদের দেশের মানুষ? বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের ভালো সম্পর্কের নমুনা কী এই যে, তাদের গুলিতে সাধারণ মানুষ মরবে, বিজিবির সদস্য মরবে? আমরা তো শুধু ভারতের সীমান্তে ঢুকি না, তারাও তো আমাদের সীমান্তে ঢোকে। কিন্তু আমরা তো তাদের গুলি করে মারি না। এ ক্ষেত্রে সরকারের কঠোর অবস্থান নেওয়া উচিত।”
এলিনা খান বলেন, “পতাকা বৈঠক হয় দুই দেশের মধ্যে। পতাকা বৈঠকে যে সিদ্ধান্ত হয় সেগুলো আমরা মেনে চলি। কিন্তু বৈঠকের সিদ্ধান্ত তো ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ মানে না। ওরা বিশ্বাস ভঙ্গ করে।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, “সীমান্ত হত্যায় ভারতে আদালতে মামলা হয়, কিন্তু কোনো সুরাহা হয়নি। এমনকি ফেলানি হত্যারও বিচার হয়নি।” ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, “১৯৯৬ সালে ভারত-চীনের মধ্যে চুক্তি হয় যে, দুই দেশের সীমান্তের দুই কিলোমিটারের এপাশে-ওপাশে কোনো অপারেশন করবে না। আমার কথা হলো, চীন-ভারত বড় কোনো বন্ধু না হয়েও যদি তারা এই চুক্তি করতে পারে, তাহলে ভারত-বাংলাদেশ কেন করতে পারবে না? আমাদের সীমান্তে একতরফা হত্যা করা হচ্ছে, এটা বোঝাই যাচ্ছে। এই হত্যাকাণ্ড বন্ধ করতে ভারত-চীনের মতো কোনো চুক্তি সমাধান হতে পারে।”
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের এই অধ্যাপক বলেন, “দিল্লি থেকে তো আর বলে দেওয়া হয় না এসব। কারণ যারা সীমান্তে নিয়োগ পায়, তারা একইসঙ্গে আবার ভারত-পাকিস্তান বর্ডারে নিয়োজিত থাকে। অনেক সময় ওইখান (ভারত-পাকিস্তান সীমান্ত) থেকে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে নিয়ে আসে। তারা জানে বর্ডারে কাউকে গুলি করে মেরে ফেললেও কোনো সাজা পাবে না। এই সাজা না দেওয়াই বড় ঘাটতি। এক সময় অনেক বেশি ছিল সীমান্ত হত্যা। এখন অনেক কমে এসেছে।” এ বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ ঢাকা টাইমসকে বলেন, “সীমান্ত হত্যা কোনোক্রমেই গ্রহণযোগ্য নয়। উভয় দেশেরই সংযম রাখতে হবে। এটা কোনোক্রমেই মানা যায় না। সীমান্তে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার কখনই সমীচীন নয়। দেখলেই কাউকে গুলি করতে হবে এমন কোনো কারণ নেই। কাউকে মেরে ফেলার অধিকার কারো নেই। আমরা এই হত্যার প্রতিবাদ জানাই।
* সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ সব সংবাদ, ছবি ,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন। ভিজিট করুন : http://www.etihad.news