সীমান্ত হত্যা বন্ধে প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন নেই : এখনও বিচার পায়নি ফেলানীর পরিবার


ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক : নানা সময়ে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের শীর্ষ পর্যায়ের সম্মেলনে সীমান্তে নন-লিথ্যাল উইপন (প্রাণঘাতী নয়) অস্ত্র ব্যবহারের সিদ্ধান্ত হয়। সীমান্ত হত্যা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার ব্যাপারে সদিচ্ছার কথাও বলেন নীতিনির্ধারকরা। এমনকি উভয় দেশের মধ্যে রাজনৈতিক পর্যায়ের আলোচনায়ও সীমান্ত হত্যা শূন্যে নামিয়ে আনতে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ভারত; কিন্তু বাস্তবে তার প্রতিফলন খুব কমই চোখে পড়ছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে হত্যার ঘটনা উদ্বেগ বাড়িয়ে তুলেছে। ২০১৯ সালে এ সংখ্যা ছিল ৩৮। গত এক দশকের মধ্যে কেবল ২০১৮ সালে সীমান্তে হত্যার ঘটনা দুই অঙ্কের নিচে ধরে রাখা সম্ভব হয়েছিল। ওই বছর সরকারি হিসাবে তিনজন হত্যার শিকার হন। ওই সময়ে সীমান্তের পরিবেশও ছিল স্বস্তিদায়ক। অথচ পরের বছরই তা এক লাফে ১৩ গুণ বেড়ে যায়।
নতুন বছরের জানুয়ারিতে সীমান্তে বিএসএফের হাতে মৃত্যু হয় । এমন পরিস্থিতিতে সীমান্ত হত্যা বন্ধ করতে উভয় দেশের মধ্যে দ্রুত রাজনৈতিক পর্যায়ে আলোচনা শুরু হওয়া দরকার বলে মনে করছেন সংশ্নিষ্ট সবাই।
নিরাপত্তা বিশ্নেষক ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সীমান্ত হত্যার ঘটনা মানবাধিকার ও আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন। দুই দেশের মধ্যে বন্ধুত্বের যে সম্পর্ক, তা অব্যাহত রাখতে এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এড়াতে হবে। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বহুমাত্রিক যে সম্পর্ক, তার প্রতিফলন যাতে মাঠ পর্যায়ে বিএসএফের সদস্যদের আচরণে পড়ে, সেটা নিশ্চিত করা জরুরি। বিজিবি কর্তৃপক্ষ বলছে, সীমান্তে হত্যার ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় তারা উদ্বিগ্ন। এসব হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে বিএসএফের বক্তব্যও গ্রহণযোগ্য মনে করছে না তারা।
সাম্প্রতিক সময়ে সীমান্তে হত্যার ঘটনা ঘটেই চলেছে। এটা বড় উদ্বেগের কারণ। এরই মধ্যে ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনারের কাছে এ নিয়ে বাংলাদেশের উদ্বেগের কথা জানানো হয়েছে। বিজিবি-বিএসএফের বৈঠকেও সীমান্ত হত্যার প্রসঙ্গটি গুরুত্ব দিয়ে উত্থাপন করা হয়েছে। ভারত বারবার বলেছে, তারা সীমান্তে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করছে না। কিন্তু পরিস্থিতি যা দেখা যাচ্ছে, তাতে তাদের এই বক্তব্য অন্তঃসারশূন্য হয়ে পড়ছে। সীমান্তে হত্যার ঘটনায় বাংলাদেশ উদ্বিগ্ন ।
নিরাপত্তা বিশ্নেষক মেজর জেনারেল (অব.) আবদুর রশিদ বলেন, কেন সীমান্ত হত্যা বাড়ছে এটা সামাজিক, রাজনৈতিক ও নিরাপত্তাজনিত প্রেক্ষাপট থেকে দেখতে হবে। সীমান্ত ব্যবস্থাপনায় স্থানীয় জনসাধারণকে সম্পৃক্ত করা দরকার। যদি তারা বেআইনিভাবে সীমান্ত অতিক্রম করে তাহলে কেন করছে, সেই কারণ খুঁজতে হবে। সীমান্ত হত্যা বন্ধে উভয় দেশের মধ্যে যে রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি রয়েছে, তা কেন মাঠ পর্যায়ে মানা হচ্ছে না, তার পেছনে কী ধরনের অনুঘটক রয়েছে বাংলাদেশ-ভারতকে তার কারণ বের করতে হবে। এরপর দুই দেশের মধ্যে মতবিনিময় করে যৌথ ব্যবস্থাপত্র প্রণয়ন করা জরুরি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন বলেন, হঠাৎ করেই সীমান্ত হত্যার ঘটনা বেড়েছে। এটা উদ্বেগের বিষয়। দুই দেশের মধ্যে যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে সেই বার্তা আমলে নিয়ে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী যথাযথ আচরণ করছে না। তাদের বুঝতে হবে সীমান্তে কোনো যুদ্ধাবস্থা নেই। এমন অবস্থায় গুলি করা কোনো সমাধান হতে পারে না। ভারতীয় কর্তৃপক্ষের এ বিষয়টি গভীরভাবে ভাবা উচিত।
যখনই সীমান্তে এ ধরনের ঘটনা ঘটছে তখনই আমরা জোরালো প্রতিবাদ জানাচ্ছি। সীমান্ত হত্যা কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। এটা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের লঙ্ঘনও। বিএসএফের দাবি- আত্মরক্ষার্থে তারা গুলি করছে। এ ব্যাখ্যা গ্রহণযোগ্য নয়।
মহিউদ্দিন আহমেদ আরও বলেন, আমরা বলছি, যদি অজ্ঞতাবশত, ভুল করে বা অবৈধভাবে কোনো নাগরিক সীমান্ত অতিক্রম করে তাহলে চুক্তি অনুযায়ী তাদের বিজিবি অথবা স্থানীয় পুলিশের কাছে হস্তান্তর করার কথা। সেটা না করে তারা সীমান্তে হত্যা করছে। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সভা, সম্মেলন ও সরকারি পর্যায়ের বৈঠকে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল সীমান্ত হত্যা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা হবে। নন-লিথ্যাল উইপন ব্যবহারের কথাও বলেছে। তার পরও দেখা যাচ্ছে, সীমান্তে বিএসএফ গুলি ছুড়ছে। এতে আমাদের নাগরিকরা হতাহত হচ্ছেন। এ ধরনের ঘটনার প্রতিবাদ আমরা আগেও জানিয়েছি, এখনও জানাচ্ছি। পাশাপাশি সীমান্তে নজরদারি বাড়িয়েছি। আমাদের জনগণকে সচেতন করা হচ্ছে যাতে অবৈধভাবে তারা সীমান্ত না পেরোয়।
এক দশকে ৩৩২ জন হত্যা: বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে গত পাঁচ বছরে নিহতের সংখ্যা ১২১। আর গত এক দশকে প্রাণহানি ঘটেছে ৩৩২ জনের। পরিসংখ্যান বলছে- ২০০৯ সালে ৬৬, ২০১০ সালে ৫৫, ২০১১ ও ২০১২ সালে ২৪ জন করে, ২০১৩ সালে ১৮ জন, ২০১৪ সালে ২৪ জন, ২০১৫ সালে ৩৮ জন, ২০১৬ সালে ২৫ জন, ২০১৭ সালে ১৭ জন এবং ২০১৮ সালে তিনজন এবং ২০১৯ সালে ৩৮ জন হত্যার শিকার হন। গত বছর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জাতীয় সংসদে এই পরিসংখ্যান দেন। তবে ওই পরিসংখ্যানে ২০১৯ সালের তথ্য ছিল না। কিন্তু আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) প্রতিবেদনে বলা হয়- ২০১৯ সালে সীমান্তে ৩৮ জনকে হত্যা করা হয়েছে। তাদের হিসাবে ২০১৮ সালে এই সংখ্যা ১৪ জনের। যদিও সরকারি পরিসংখ্যানে ২০১৮ সালে সীমান্ত হত্যার সংখ্যা বলা হয়েছে তিন। তবে সরকারি-বেসরকারি সব পরিসংখ্যানেই গত চার বছরের মধ্যে ২০১৯ সালেই সীমান্তে হত্যার ঘটনা সবচেয়ে বেশি।
সীমান্তে হত্যার শিকার হয়েছেন ১০ জন। মাসের প্রথম ২৩ দিনের ব্যবধানে বিএসএফের গুলিতে প্রাণ হারান তারা। এর মধ্যে গত বুধ ও বৃহস্পতিবার পরপর দুই দিনে ছয়জনকে হত্যা করেছে বিএসএফ। ছয়টি সীমান্তে এসব ঘটনা ঘটেছে। নওগাঁ ও যশোর সীমান্তে চারজন, লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলার দইখাওয়া এলাকায় বনচৌকি সীমান্তে দু’জন, চাঁপাইনবাবগঞ্জে দু’জন এবং ঠাকুরগাঁও ও পঞ্চগড়ে একজনকে হত্যা করেছে বিএসএফ। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার নওগাঁ ও যশোর সীমান্তে চার বাংলাদেশি নিহত হন। তাদের মধ্যে তিনজন নিহত হয়েছেন বিএসএফের গুলিতে এবং একজন নির্যাতনে। নওগাঁয় যারা বিএসএফের গুলিতে নিহত হন তারা হলেন- রণজিৎ কুমার, মফিজুল ইসলাম ও কামাল হোসেন। বিবিসি বাংলাকে সীমান্তে সাম্প্রতিক হত্যাকাণ্ড নিয়ে একটি বক্তব্য দিয়েছেন বিএসএফের দক্ষিণবঙ্গ সীমান্ত অঞ্চলের ইন্সপেক্টর জেনারেল ওয়াই বি খুরানিয়া। সেখানে তিনি বলেছেন, আমরা দুই বাহিনীই ঘটনার তদন্ত করছি। কেন, কীভাবে ওই ঘটনা হয়েছিল আর ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের ঘটনা এড়ানো যায়, সে ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে। বাহিনীর সদস্যদের পরিস্কার নির্দেশ দেওয়া আছে- শুধু আত্মরক্ষার্থেই বল প্রয়োগ করা যাবে, আর সেটাও যতটা সম্ভব কম করেই করতে হবে। এর জন্য দক্ষিণবঙ্গ সীমান্তে অনেক পাম্প অ্যাকশন গান ব্যবহার করা হয়, যা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রাণঘাতী নয়।
এখনও বিচার পায়নি ফেলানীর পরিবার: বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত হত্যাকাণ্ডের মধ্যে দেশে-বিদেশে সবচেয়ে বেশি নাড়া দেয় কুড়িগ্রামের কিশোরী ফেলানী খাতুনের হত্যার ঘটনা। ২০১১ সালের ৭ জানুয়ারি কুড়িগ্রামের অনন্তপুর সীমান্তে কিশোরী ফেলানীকে গুলি করে হত্যা করে বিএসএফ ১৮১ ব্যাটালিয়নের চৌধুরীহাট ক্যাম্পের এক সদস্য। ফেলানী হত্যায় বিএসএফের নিজস্ব আদালতে অভিযোগ থেকে খালাস পান অভিযুক্ত হাবিলদার অমিয় ঘোষ। ওই রায়ের পর বাংলাদেশে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়।
ওই মামলায় ফেলানীর পরিবারকে আইনি সহায়তা দিয়েছেন কুড়িগ্রাম জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর আব্রাহাম লিংকন। গতকাল তিনি সমকালকে বলেন, ফেলানীর মামলাটি এখন ভারতের সুপ্রিম কোর্টে বিচারাধীন। সেখানে অভিযুক্তরা বক্তব্য দিয়েছেন। যদি সীমান্ত ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে ভারতের উচ্চ আদালত একটি নির্দেশনা দিতেন তাহলে উভয় দেশের জন্যই মঙ্গলজনক হতো। ফেলানীর পরিবারও ন্যায়বিচার পেত।