অনুসন্ধানী সংবাদ

বগুড়া আরডিএর ১২ একর সরকারি জমি বেদখল 

bogura 3 20240217124305
print news

বগুড়া প্রতিনিধি : পল্লী উন্নয়ন একাডেমি (আরডিএ) বগুড়ার প্রায় ১২ একর জমি বেদখল হয়ে গেছে। সর্বশেষ ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তরের আওতায় সেটেলমেন্ট তালিকায় অধিকাংশ জমি অন্যের নামে নথিভূক্ত হয়। হাতছাড়া হয়ে যাওয়া সরকারি এসব জমির বর্তমান বাজার মূল্য ৫০ কোটি টাকার উপরে।আরডিএতে চাকরিরত কর্মকর্তাদের একটি চক্র এই জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত বলে প্রমাণ মিলেছে। বিগত দুই যুগ ধরে এই চক্রের সদস্যরা তাদের দখল করা সরকারি জমির মালিকানা টিকিয়ে রাখতে কয়েকদফা হাতবদল (বেচাকেনা) করেন। বর্তমানে এসব স্থানে উঁচু উঁচু দালানসহ একাধিক স্থাপনা গড়ে তোলা হয়েছে।অনুসন্ধানে জানা গেছে ১৯৭৪ সালে বগুড়ার শেরপুর উপজেলায় এই একাডেমি প্রতিষ্ঠিত হয়। সেসময় একজন অবাঙালির পরিত্যক্ত ১০২ একর জমি আরডিএ বগুড়াকে দেওয়া হয়। সঙ্গে আরও ১৬ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়। কর্মকাণ্ড বর্ধিত হলে ২৬ বছর পর ২০০০ সালে ৬টি দাগে ২ একর জমি অধিগ্রহণ করে মূল জমির সঙ্গে যোগ করা হয়। একাডেমির এই জমির মধ্যে বাইরের ১৭ জন জমির মালিকের ৪ দশমিক ৩১৫ একর জমি থাকার কারণে সরকারি সিদ্ধান্তে সেটি রেওয়াজবদল (একস্থান থেকে অন্য স্থানে স্থানান্তর) করা হয়। জমির মালিকরা ভিন্ন স্থানে জমি পাওয়ার কারণে সেখানে চলে যান। এখন কাগজে কলমে আরডিএর ১২০ একর জমির মালিকানা রয়েছে।

তবে বর্তমানে ১০৮ দশমিক ৩৮ একর জমিতে সামগ্রিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হচ্ছে প্রতিষ্ঠানটির। এরমধ্যে ৮০ একর জমির ওপর একাডেমির প্রদর্শনী খামার রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে এই খামারটির জমির পরিমাণ ৬৮ দশমিক ৩২ একর। অর্থাৎ খামারে ১১ দশমিক ৬২ একর জমি কম রয়েছে। আরডিএর পক্ষ থেকে সর্বশেষ ২০২১ সালে ডিজিটাল সার্ভে করার পর জমি কম থাকার বিষয়টি নিশ্চিত হয়।

bogura 1 20240217124338

যেভাবে বেদখল হলো জমি

২০০০ সালে একাডেমির চারপাশে পাকা সীমানা প্রাচীর নির্মাণ করা হয়। এরআগে সমস্ত জমি খোলা অবস্থায় ছিল। সীমানা প্রাচীর নির্মাণের সময়ই ১১ একরেরও বেশি সম্পত্তি বাইরে রেখে কাজ শুরু করায় নানাবিধ প্রশ্ন তৈরি হয়। শুরু থেকেই সম্পত্তি তদারকির দায়িত্বে নিয়োজিত থাকা একাডেমির প্রশাসন বিভাগের ভূমিকাও ছিল রহস্যজনক। ১৯৯৮ সালে আরডিএর কর্মচারী ইউনিয়নের নেতা আব্দুল মজিদের বিরুদ্ধে প্রথম জমি আত্মসাতের অভিযোগ ওঠে। সেসময় স্থানীয়রা এলাকায় মাইকিংসহ তার বিচারের দাবি জানান। অভিযোগের পর প্রতিষ্ঠানটিতে প্রেষণে নিয়োজিত উপ-সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তা মনোয়ার হোসেন সরকারের অধীনে জমি দখলের বিষয়টি তদন্ত করা হয়। কিন্তু বিগত ২৪ বছরেও সেই তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়নি।

অনুসন্ধান করে জানা যায়, দুর্নীতি মামলায় অভিযুক্ত একাডেমির সাবেক মহা-পরিচালক এম এ মতিনের সহযোগিতায় সাবেক পরিচালক মাহমুদ হোসেন খান (বর্তমানে দুর্নীতি দমন কমিশনের দায়ের করা মামলায় অভিযুক্ত এবং আমেরিকায় অবস্থানরত), বর্তমান প্রশাসনিক কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম, সাবেক পরিচালক নজরুল ইসলাম খান, সাবেক উপ-সহকারী প্রকৌশলী তারা মিয়া, মহা-পরিচালকের সাবেক পিএস আজিজুর রহমান, সাবেক খামার ব্যবস্থাপক মীর আলতাফ, কর্মচারি ইউনিয়নের সাবেক বেলাল খান, আশকারুল আনোয়ার, মোহাম্মদ আব্দুল্লাহসহ আরও অনেকে নিজেদেরকে ভূয়া মালিক দেখিয়ে একাডেমির জমির সঙ্গে রেওয়াজবদল ও জমি দখল করে নেন। এছাড়া অনেক কর্মকর্তা আবার তাদের আত্মীয় স্বজনদের নামেও জমি দখল করেন। দখল করা এসব জমি টিকিয়ে রাখতে অন্তত ৪ থেকে ৫ বার হাতবদল হয়েছে। বর্তমানে যারা এসব জমিতে অবস্থান করছেন তাদের অনেকেই পাকা ঘরবাড়ি করে স্থায়ীভাবে স্থাপনা নির্মাণ করেছেন। সরেজমিন ঘুরে সেখানে ঘরবাড়ি ছাড়াও বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, চাতাল, খামার, বাগানের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে।

সরকারি জমি নিতে কারসাজি

পল্লী উন্নয়ন একাডেমি বগুড়ার অবস্থান শেরপুর উপজেলার গাড়িদহ এবং কলতাপাড়া মৌজায়। এখানে একসঙ্গে অনেক পরিমাণ জমি হওয়ার কারণে বিগত ৯০ দশকে পল্লী উন্নয়ন একাডেমি মৌজা নামে পৃথক মৌজা খোলা হয়। যার জেএলনং-১২৬। এই মৌজার অধীনে সরকারি জমির বাইরে অন্য কোনো ভূমি মালিকের জমি থাকার কথা নয়। কিন্তু বিগত ১৪ মে ২০২৩ তারিখে ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তরের আওতায় ঢাকার সেটেলমেন্ট প্রেসের মুদ্রন তালিকা থেকে দেখা গেছে এই মৌজা রেকর্ডে আরডিএর বাইরে ২২ জন ভূমি মালিকের নাম রয়েছে। সর্বশেষ জরিপ অনুসারে এই ২২ জনের নামে জমি রেকর্ড করা হয়।

সরকারি মৌজার জমি কীভাবে সাধারণ মানুষের নামে রেকর্ড করা হলো সেই প্রশ্নের জবাবে শেরপুর উপজেলার ভারপ্রাপ্ত সেটেলমেন্ট কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম জানান, মাঠ পর্যায়ে জরিপ করে যে তথ্য পাওয়া গেছে তাদের নামেই জমি রেকর্ড করা হয়েছে। এখানে কারো দ্বিমত থাকলে সেটা অভিযোগ পেলে তদন্ত করে দেখা হবে।

আরডিএর তৎপরতা

২০২২ সালের ৬ জুন আরডিএর সাবেক মহাপরিচালক খলিল আহমদ একাডেমির বাউন্ডারি ওয়ালের বাইরে ১১ একরের বেশি বেহাত হয়ে যাওয়া জায়গা উদ্ধারে উদ্যোগ নেন। তিনি জমি উদ্ধারের জন্য মৌখিক নির্দেশনায় ৬ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেন। কমিটির সদস্যরা হলেন আরডিএ’র অতিরিক্ত মহা-পরিচালক ড. আব্দুল্লাহ আল মামুন, পরিচালক কৃষি বিজ্ঞান মিজানুর রহমান, যুগ্ম পরিচালক ড. আব্দুল মজিদ, যুগ্ম-পরিচালক (প্রশাসন) খালিদ আওরঙ্গজেব, উপ-পরিচালক মোহাম্মদ মহিউদ্দিন এবং প্রশাসনিক কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম। এই রফিকুল ইসলাম একাডেমির জমি বেহাত হওয়ার ঘটনার মূল হোতা। তাকেই আবার উদ্ধার কমিটির সদস্য করায় স্বাভাবিক কারণেই কোনো ফলাফল আসেনি। কাগজে কলমে কাজ শুরুর পর ২০ মাস পার হলেও কোনো অগ্রগতি রিপোর্ট কমিটির সদস্যরা দিতে পারেনি। উল্টো কমিটি গঠন এবং জমি উদ্ধার তৎপরতার খবর আগে থেকেই জেনে যান অবৈধ দখলদাররা। তারাই উল্টো সরকারি এই মৌজার ৫২টি দাগে ৯ একর জমির মালিকানা দাবি করে ২০২২ সালের ১৬ আগস্ট আদালতে মামলা দায়ের করেন।

এর আগেও বিগত ২০০৬ সালে একইভাবে আদালতে জমির মালিকানা দাবি করে দখলদাররা একটি মামলা দায়ের করেছিলেন। বিগত ১৮ বছর ধরে এই মামলাটির কোনো অগ্রগতি নেই। এখন নতুন করে মামলার কারণে জমি উদ্ধার তৎপরতা থেমে যাবে বলে মনে করছেন কর্মরতরা। বেহাত হওয়া প্রায় ১২ একর জমির খাজনা এখনো আরডিএ কর্তৃপক্ষ নিয়মিতভাবে পরিশোধ করে আসছে। সরকারি খাত থেকে এই টাকা প্রতিবছর দেওয়া হচ্ছে।

অভিযোগ প্রসঙ্গে আরডিএর প্রশাসনিক কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম বলেন, আমি রেওয়াজবদল সূত্রে আরডিএর ১৭ শতক জমি কিনেছিলাম। পরে সেই জায়গাটি বিক্রি করে দিয়েছি। আর একাডেমির বেদখল জমি উদ্ধারের জন্য আমরা সবাই মিলেই চেষ্টা করছি। এটি নিয়ে একাধিকবার উচ্চ পর্যায়ের মিটিংও করা হয়েছে। তবে কোনো ফলাফল এখনো আসেনি। এই বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আর কোনো তথ্য আমি দিতে পারছি না। তবে বেহাত হওয়ার পরও সেই জমির খাজনা কোন খাত থেকে আরডিএ পরিশোধ করছে সে ব্যাপারে কোনো তথ্য দেননি রফিকুল ইসলাম। আরডিএর মহা-পরিচালক খুরশীদ ইকবাল রেজভী বর্তমানে বিদেশে অবস্থায় করায় তার বক্তব্য জানা যায়নি।তবে যুগ্ম-পরিচালক (প্রশাসন) খালিদ আওরঙ্গজেব বলেন, জমিগুলো দীর্ঘদিন থেকে বেদখল হয়ে আছে। এটি দ্রুত উদ্ধার করা সম্ভব নয়। আমরা কাজ করছি। তিনি দাবি করেন, জমি বেদখলের বিষয়টি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় অবগত। তারা আইনগত ভাবে জমি উদ্ধারে কাজ করে যাচ্ছেন।

 

* সর্বশেষ  গুরুত্বপূর্ণ  সব  সংবাদ, ছবি ,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন লেখা পেতে আমাদের  ফেসবুক পেইজে  লাইক  দিয়ে  অ্যাকটিভ  থাকুন।  ভিজিট করুন : http://www.etihad.news

* অনলাইন  নিউজ পোর্টাল  ইত্তেহাদ নিউজে  লিখতে  পারেন  আপনিও লেখার বিষয়  ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি প্রকৃতি আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন  [email protected] ঠিকানায়
সংবাদটি শেয়ার করুন....
ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক :

ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক :

About Author

etihad news is one of the famous Bangla news portals published from Abudhabi-UAE. It has begun with a commitment to fearless, investigative, informative, and independent journalism. This online portal has started to provide real-time news updates with maximum use of Smart Technology.

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *