অনুসন্ধানী সংবাদ

এলজিইডির অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. আবদুর রশিদ’র ৩শ কোটি টাকার সম্পদের অনুসন্ধান ফাইলবন্দি

ab rasid
print news

ঢাকা প্রতিনিধি : স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. আবদুর রশিদ মিয়া। তার বিরুদ্ধে প্রায় ৩০০ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগের অনুসন্ধান কার্যত ফাইলবন্দি হয়ে আছে। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) অভিযোগসংশ্লিষ্ট প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত যাচাই-বাছাইয়ের কাজে চার দফা তাকে তলব করেছে। কিন্তু তাতে সাড়া দেননি তিনি। অনুসন্ধান কর্মকর্তা শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে স্থানীয় পুলিশের মাধ্যমে নোটিশ পাঠিয়ে তাকে তলব করেন। এরপরও তিনি দুদকে হাজির হননি। দুদককে নিয়ে এ ধরনের অবজ্ঞার নেপথ্য কারণ অনুসন্ধানকালে সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, ‘বেয়াই ম্যাজিকে বাজিমাত’ করেছেন রশিদ। অর্থাৎ, রশিদের বেয়াই যুগ্মসচিব পদমর্যাদার সাবেক এক কর্মকর্তা। তিনি ছিলেন দুদকের সাবেক প্রভাবশালী এক কমিশনারের স্টাফ অফিসার। সেই দাপটে অনুসন্ধান কর্মকর্তার

নোটিশ আমলে নেননি তিনি। এমনকি দুর্নীতির অনুসন্ধান চলমান থাকার তথ্য গোপন করে ‘দুদকে কোনো অনুসন্ধান/তদন্ত চলমান নেই’-মর্মে প্রত্যয়নপত্র নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী থেকে অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী পদে পদোন্নতিও বাগিয়েছেন। একাধিক সূত্রে উল্লিখিত তথ্য পাওয়া গেছে। জানতে চাইলে দুদকের আইন ও প্রসিকিউশন শাখার সাবেক মহাপরিচালক মো. মঈদুল ইসলাম বলেন, ‘দুদকে যার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের অনুসন্ধান চলমান, সেখানে তারাই আবার চিঠি দিয়ে যদি বলে-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে কোনো অনুসন্ধান বা তদন্ত চলমান নেই, তাহলে দুর্নীতিবাজদের প্রশ্রয় দেওয়া হয়। এটা অনাকাঙ্ক্ষিত ও অনভিপ্রেত। কমিশন এর দায় এড়াতে পারে না। বলা যায়, সরষের মধ্যে ভূত। দুদকের কাজ যেখানে দুর্নীতি দূর করা, তারাই যদি তথ্য গোপন

করে, তাহলে এটাও এক ধরনের দুর্নীতি। দুদক আইনেও এটা অপরাধ। টান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি প্রভাব খাটিয়ে শুধু দুদকের আদেশ অমান্য করেছেন তা নয়, দুর্নীতির অভিযোগের অনুসন্ধান চলমান থাকা অবস্থায় ওই ধরনের চিঠি নিয়ে থাকলে তিনি প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছেন। এটি বহুমুখী দুর্নীতির মধ্যে পড়ে। দুদকের ক্ষমতা যে প্রশাসন ও আমলাতন্ত্রের হাতে চলে গেছে, এটা তারই প্রকট দৃষ্টান্ত। এর সঙ্গে জড়িত সবাইকে জবাবদিহির আওতায় আনা উচিত।’ জানা যায়, গত বছরের শুরুর দিকে এলজিইডির তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. আবদুর রশিদ মিয়ার অনিয়ম-দুর্নীতি ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের বিষয়ে দুদকে অভিযোগ জমা পড়ে। অভিযোগে থাকা তথ্য-উপাত্ত যাচাই-বাছাইয়ের জন্য প্রথমে

গোপন তদন্ত করা হয়। ওই তদন্তে রশিদ ও তার স্ত্রী-সন্তানের নামে থাকা বিপুল অবৈধ সম্পদের তথ্য পাওয়া যায়। এরপর তদন্ত কর্মকর্তার গোপন প্রতিবেদনের সুপারিশ আমলে নিয়ে গত বছরের ২৯ মার্চ রশিদের অনিয়ম-দুর্নীতি ও অবৈধ সম্পদের বিষয়ে আনুষ্ঠানিক অনুসন্ধান কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নেয় কমিশন। সংস্থার সহকারী পরিচালক মানসী বিশ্বাসকে অনুসন্ধান কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, অনুসন্ধান পর্যায়ে অনেক অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া গেলেও অনুসন্ধান কাজে চরম অসহযোগিতা করছেন আব্দুর রশিদ। বেশকিছু নথিপত্র চেয়ে চারবার তাকে দুদকে তলব করা হলেও তিনি তাতে সাড়া দেননি। সবশেষ গত বছরের ১৫ মে শেরেবাংলা নগর থানা পুলিশের মাধ্যমে নোটিশ পাঠিয়ে আব্দুর রশিদকে তলব করা হয়।

থানা সূত্র জানায়, এই তলবি নোটিশ পুলিশ গিয়ে আগারগাঁও এলজিইডি ভবনে আব্দুর রশিদের কার্যালয়ে পৌঁছে দেয়। চতুর্থবার পাঠানো ওই নোটিশে বলা হয়েছে, ‘অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য প্রদানের জন্য ২০২৩ সালের ১০ এপ্রিল, ১৬ এপ্রিল ও ২ মে নোটিশ প্রেরণ করা হলেও চাহিদাকৃত কোনো রেকর্ডপত্র সরবরাহ করা হয়নি। কিংবা উপস্থিত হয়ে কোনো বক্তব্য উপস্থাপন করাও হয়নি। এ অবস্থায় আপনাকে আগামী ২৩ মে অনুসন্ধানের স্বার্থে নিজ, স্ত্রী ও ছেলে-মেয়েদের এনআইডি কার্ড, স্মার্টকার্ড, পাসপোর্ট, জন্মসনদের ফটোকপিসহ হাজির হয়ে বক্তব্য প্রদানের জন্য অনুরোধ করা হলো।’ এই নোটিশকেও পাত্তা না দেওয়ার পর রশিদের ব্যক্তিগত ও কর্মস্থলের দরকারি তথ্য-উপাত্তের অভাবে কার্যত অনুসন্ধান কাজ ফাইলবন্দি হয়ে আছে। তবে দুদক আইন ২০০৪-এর ১৯(৩) ধারায় রেকর্ডপত্র সরবরাহ না করলেও ব্যবস্থা গ্রহণের সুযোগ রয়েছে বলে নোটিশে উল্লেখ করা হয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে অনুসন্ধান কর্মকর্তা সহকারী পরিচালক মানসী সরকার কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। অনুসন্ধানসংশ্লিষ্ট নথিপত্রে অভিযোগ আছে, অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে আব্দুর রশিদ মিয়া অন্তত ৩০০ কোটি টাকার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের মালিক হয়েছেন। তবে এসব সম্পদের বেশির ভাগই তিনি করেছেন স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে ও আত্মীয়স্বজনের নামে। এলজিইডির তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী প্রশাসন ও ট্রেনিং বিভাগের দায়িত্বে থাকাকালে তিনি বেপরোয়া দুর্নীতিতে জড়িয়েছেন। এর আগে তিনি বিভিন্ন প্রকল্পের পরিচালক ও নির্বাহী প্রকৌশলীর দায়িত্বও পালন করেছেন। গুরুত্বপূর্ণ এসব পদে থাকাকালে অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে তিনি অন্তত

৩০০ কোটি টাকার সম্পদ গড়েছেন বলে অভিযোগ আছে। তার সম্পদের তালিকায় আছে রাজশাহীতে একটি ৫ তলা ও একটি ৭ তলা বাড়ি, একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টার, সিরাজগঞ্জের হাটিকুমরুল এলাকায় ২৫ শতাংশ জমির ওপর ফুড গার্ডেন, সিরাজগঞ্জ-বগুড়া মহাসড়কে আরেকটি ফুড গার্ডেন, বগুড়ার শেরপুর পৌরসভায় জমি, হিমছায়াপুর মৌজায় বিশাল বাগানবাড়ি, একই এলাকায় ১০ নম্বর শাহবন্দেগী ইউনিয়নে খন্দকার তলা মৌজায় ৫ একর জমি, বগুড়ার শেরপুর সেরময়া মৌজায় ১২ বিঘা জমি। রাজধানীর আগারগাঁওয়ে রয়েছে অত্যাধুনিক ডুপ্লেক্স অ্যাপার্টমেন্ট। এছাড়াও ঢাকা ও রাজশাহীতে নামে-বেনামে আরও একাধিক ফ্ল্যাট, বিভিন্ন ব্যাংকে এফডিআর ও নগদ টাকা জমা থাকার অভিযোগ আছে। জানা যায়, অনুসন্ধানে এসব অভিযোগের অনেকগুলোর সত্যতা পাওয়া গেছে। বাকিগুলো যাচাই-বাছাই করতেই  মূলত রশিদ ও তার পরিবারের সদস্যদের এনআইডি, পাসপোর্ট ও জন্ম সনদের কপি চাওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে বৈধ আয়ের পরিমাণ নিশ্চিত হতে রশিদের বার্ষিক বেতনসংক্রান্ত ডকুমেন্ট চাওয়া হয়েছে। আরও জানা যায়, গত বছরের ২৪ এপ্রিল আবদুর রশিদকে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী থেকে অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। অথচ গত বছরের ২৯ মার্চ রশিদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান কমিটি গঠন করা হয়। ১০ এপ্রিল তাকে দুদকে প্রথম তলব করা হয়। এর আগে তার বিরুদ্ধে চলে গোপন অনুসন্ধান। অথচ ‘বেয়াই ম্যাজিকে’ দুদক থেকে পাঠানো পত্রে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়-রশিদের বিরুদ্ধে সংস্থাটিতে কোনো দুর্নীতির অভিযোগের অনুসন্ধান/তদন্ত চলমান নেই। দুদকের এই প্রত্যয়নপত্রের ওপর ভিত্তি করে মন্ত্রণালয় রশিদের

পদোন্নতি চূড়ান্ত করে। এসব অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে এলজিইডির অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. আবদুর রশিদ মিয়া  বলেন, ‘পেশাগত প্রতিযোগিতার ধারাবাহিকতায় একটি চক্র উদ্দেশ্যমূলকভাবে এই অভিযোগ করেছে। দুদক অনুসন্ধান করছে। দুদককে পাত্তা না দিলে তো আমারই ক্ষতি।  চার দফা তলব করার পরও আপনি দুদকে হাজির হননি-অভিযোগ আছে দুদকের সাবেক এক কমিশনারের স্টাফ অফিসার ছিলেন আপনার বেয়াই। তার দাপটেই আপনি সংস্থাটির তলবে হাজির না হয়ে পুরো অনুসন্ধান ফাইলটি চাপা দিয়ে রেখেছেন-এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি ঠিক নয়। দুদক অনুসন্ধান করে আমার কোনো অবৈধ সম্পদ পাবে না। ৩০০ কোটি দূরের কথা, ৩ কোটি টাকার সম্পদ থাকলে আমি আর চাকরি করব না। অভিযোগসংশ্লিষ্ট কোনো সম্পদই আমার নেই। সব মিথ্যা।’ তাহলে দুদকের তলবে হাজির হচ্ছেন না কেন-এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আসলে প্রথম তিনটি নোটিশ আমি পাইনি। বোঝেন তো আমাদের ডাক বিভাগের যে অবস্থা। এর চেয়ে কুরিয়ার অনেক ভালো। আমার ধারণা, আমার বিরুদ্ধে যে চক্রটি কাজ করছে, তারাই ওই নোটিশগুলো গায়েব করে দিয়েছে। চতুর্থ দফায় পাঠানো নোটিশ আমি পেয়েছি। আমার কাছে যে তথ্য-উপাত্ত চাওয়া হয়েছিল, সেগুলো জমা দিয়েছি।

 

* সর্বশেষ  গুরুত্বপূর্ণ  সব  সংবাদ, ছবি ,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন লেখা পেতে আমাদের  ফেসবুক পেইজে  লাইক  দিয়ে  অ্যাকটিভ  থাকুন।  ভিজিট করুন : http://www.etihad.news

* অনলাইন  নিউজ পোর্টাল  ইত্তেহাদ নিউজে  লিখতে  পারেন  আপনিও। লেখার বিষয়  ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন  [email protected] ঠিকানায়

সংবাদটি শেয়ার করুন....
ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক :

ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক :

About Author

etihad news is one of the famous Bangla news portals published from Abudhabi-UAE. It has begun with a commitment to fearless, investigative, informative, and independent journalism. This online portal has started to provide real-time news updates with maximum use of Smart Technology.

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *