ধর্ম

শবে বরাত : করণীয়-বর্জনীয়

বরাত
print news

ডা.মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ : লাইলাতান নিসফে মিন শাবান’। আর ইসলামি তমুদ্দুন তথা মুসলিম কৃষ্টিতে যেসব দিবস ও রজনী বিখ্যাত, এর মধ্যে একটি হলো শবে বরাত’। শবে বরাত শব্দটি ফারসি। শব মানে রাত, বরাত মানে মুক্তি; শবে বরাত অর্থ মুক্তির রজনী। এর আরবি হলো ‘লাইলাতুল বারাআত’। হাদিস শরিফে একে ‘নিসফ শাবান’ বা শাবান মাসের মধ্যরাত বলা হয়েছে। ভারতীয় উপমহাদেশ, পারস্যসহ পৃথিবীর অনেক দেশের ফারসি, উর্দু, বাংলা, হিন্দিসহ নানান ভাষায় যা ‘শবে বরাত’ নামেই পরিচিত।আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হা মীম! শপথ! স্পষ্ট কিতাবের, নিশ্চয় আমি তা নাজিল করেছি এক বরকতময় রাতে; নিশ্চয় আমি ছিলাম সতর্ককারী। যাতে সব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নির্ধারিত হয়। এই নির্দেশ আমার তরফ থেকে, নিশ্চয় আমিই দূত পাঠিয়ে থাকি। এ হলো আপনার প্রভুর দয়া, নিশ্চয় তিনি সব শোনেন এবং সব জানেন।আর যুগ যুগ ধরে মানুষের কাছে শবে বরাত-খ্যাত রাতটি হাদিসে ঘোষিত ‘লাইলাতান নিসফে মিন শাবান’ ভাগ্য রজনী হিসেবে ব্যাপক পরিচিত। অথচ হাদিসের বর্ণনায় এটি ক্ষমা কিংবা মুক্তির মাস। কাক্সিক্ষত এ রাতটি নিয়ে যেমন বাড়াবাড়ির শেষ নেই। আবার এ রাতটি একেবারেই মর্যাদাহীন বলেও অনেকে মাত্রাতিরিক্ত ছাড়াছাড়িতে লিপ্ত হয়।
আসুন সংক্ষেপে এ রাত সম্পর্কে কিছু কথা জেনে নিই : শবে বরাতের ফজিলতকে সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন বলা ঠিক নয়। কারণ ১০ জন সাহাবি থেকে শবেবরাতের ফজিলত সম্পর্কিত হাদিসগুলো বর্ণিত হয়েছে। সুতরাং শবেবরাতের ফজিলত ও রাতের ইবাদতকে সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন তথা বিদয়াত বলা কোনোক্রমেই সংগত নয়। বরং বাস্ততার আলোকে স্বীকার করতেই হবে, এ রাত পূণ্যময় মুক্তির রাত। এ রাতে জেগে থেকে নফল ইবাদত-বন্দেগি করা পুণ্যময় কাজ। তবে ইসলামে এ রাতের ইবাদতের জন্য বিশেষ কোনো নিয়মনীতি নেই। শবে বরাত কী? দুইটি শব্দ। একটি আরবি (লাইলাতুল বারাআত) অন্যটি ফার্সি (শবে বরাত)। আরবিতে ‘লাইলাতুল বারাআত’ শব্দ দুটির অর্থ হলো- মুক্তির রাত। আর ফার্সিতে ‘শবে বরাত’ শব্দ দুটির অর্থ দাড়ায়- ‘ভাগ্য রজনী’। কিন্তু হাদিসের পরিভাষায় এ রাতটি ব্যবহৃত হয়- ‘লাইলাতান নিসফে মিন শাবান’ বা মধ্য শাবানের রাত। সুতরাং এ রাতটিকে শবে বরাত কিংবা লাইলাতুল বারাআত না বলে হাদিসে ব্যবহৃত ‘লাইলাতান নিসফে মিন শাবান’ বললে বা নামকরণ করলেই তা সুন্দর হয়। তাতে আদায় হবে পরিপূর্ণ সুন্নাত এবং সবার কাছেই হবে গ্রহণযোগ্য। তাছাড়া নামকরণে বিভেদ কিংবা মর্যাদায় অতিরঞ্জন ও ছাড়াছাড়ি না করে হাদিসের ওপর আমল করাই জরুরি বিষয়। এ রাত সম্পর্কে কী বলেছেন বিশ্বনবি? হিজরি সালের অষ্টম মাস শাবানে বেশি বেশি নফল রোজা রাখার ব্যাপারে হাদিসের নির্দেশনা রয়েছে। আর এ মাসের ১৪ তারিখ সন্ধ্যা থেকে শুরু হয় কাঙ্ক্ষিত ‘লাইলাতান নিসফে মিন শাবান’ বা শবে বরাত। হাসান হাদিসের বর্ণনায় এটি বিশেষ ক্ষমার রাত হিসেবে পরিচিত। এ রাতের রিজিক চাওয়ার ব্যাপারেও হাদিসের বর্ণনা এসেছে। তবে এ হাদিসকে অনেকে মাওজু বলেছেন। হাদিসের দুর্বল বর্ণনার পাশাপাশি বিশুদ্ধ বর্ণনায় ক্ষমা ও গোনাহ মাফের বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে ওঠে এসেছে : হজরত আবু মুসা আল-আশআরি রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, আল্লাহ মধ্য শাবানের রাতে আত্মপ্রকাশ করেন এবং মুশরিক ও হিংসুক ব্যতিত তাঁর সৃষ্টির সবাইকে ক্ষমা করেন।’ (ইবনে মাজাহ)। হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বর্ণনা করেন, এক রাতে আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে (বিছানায়) না পেয়ে তাঁর খোঁজে বের হলাম। আমি লক্ষ্য করলাম, তিনি জান্নাতুল বাকিতে। তাঁর মাথা আকাশের দিকে তুলে আছেন। তিনি বলেন- ‘হে আয়েশা! তুমি কি আশঙ্কা করেছো যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসুল তোমার প্রতি অবিচার করবেন?আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন, তা নয়, বরং আমি ভাবলাম যে, আপনি হয়তো আপনার কোনো স্ত্রীর কাছে গেছেন। তিনি বলেন-‘মহান আল্লাহ মধ্য শাবানের রাতে দুনিয়ার কাছাকাছি আকাশে অবতরণ করেন এবং কালব গোত্রের মেষপালের পশমের চাইতেও অধিক সংখ্যক লোকের গোনাহ মাফ করেন।’ (ইবনে মাজাহ)। সুতরাং হাদিসের দিকে লক্ষ্য রেখে বেশি বেশি নফল রোজা রাখার মাস শাবানের মধ্য রাতের ইবাদত ও ক্ষমা পাওয়ার বিষয়ে অতিরঞ্জন ও বাড়াবাড়ি না করাই উত্তম। নিজ নিজ ঘরে কিংবা একাকি আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনার মাধ্যমে নিজেদের গোনাহ মাফ করিয়ে নেয়ার সুবর্ণ সুযোগ ‘লাইলাতান নিসফে মিন শাবান’।
আইয়ামে বিজের রোজা : সবার মনে রাখতে হবে, শাবান মাসজুড়ে রোজা রাখার বিশেষ ফজিলত রয়েছে। হাদিস শরিফে এ ব্যাপারে বেশ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। আয়েশা (রা.) বলেন, ‘আমি নবী করিম (সা.)-কে শাবান মাসের মতো এত অধিক (নফল) রোজা আর অন্য কোনো মাসে রাখতে দেখিনি। এ মাসের অল্প কয়েক দিন ছাড়া বলতে গেলে সারা মাসই তিনি রোজা রাখতেন।’ (তিরমিজি, হাদিস : ৭৩৭)। এছাড়াও ‘আইয়ামে বিজ’ বা প্রতি মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখে রোজা রাখার ব্যাপারেও হাদিস শরিফে উৎসাহিত করা হয়েছে। এটা রাসুল (সা.)-এর সুন্নত।
শবে বরাতের রোজা : ১৫ শাবান শবে বরাত। একটি হাদিসে এই রাত পরবর্তী দিনে রোজা রাখার নির্দেশনা রয়েছে। আলী (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসুল (সা.) বলেন, ‘১৫ শাবানের রাত যখন হয়, তোমরা রাতটি ইবাদত-বন্দেগিতে পালন করো এবং দিনের বেলা রোজা রাখো। কেননা এ রাতে সূর্যাস্তের পর আল্লাহ প্রথম আসমানে এসে বলেন, কোনো ক্ষমাপ্রার্থী আছে কি? আমি তাকে ক্ষমা করে দেব। কোনো রিজিক অন্বেষণকারী আছে কি? আমি তাকে রিজিক দেব। আছে কি কোনো রোগাক্রান্ত? আমি তাকে আরোগ্য দান করব। এভাবে সুবহে সাদিক পর্যন্ত আল্লাহ মানুষের বিভিন্ন প্রয়োজনের কথা উল্লেখ করে তাদের ডাকতে থাকেন।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ১৩৮৮)।
লাইলাতান নিসফে মিন শাবান’ রাতে কিছু বর্জণীয় আমল : ‘লাইলাতান নিসফে মিন শাবান’ উপলক্ষে পরিবারের জন্য বিশেষ খাবারের আয়োজনের মধ্যমে সারা বছর ভালো খাবার পাওয়ার বিশ্বাস ও আয়োজন থেকে বিরত থাকা। ‘লাইলাতান নিসফে মিন শাবান’-এ আনন্দ বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে মারাত্মক শব্দ দুষণের হাতিয়ার ফটকা ও আতশবাজী ইত্যাদি থেকে বিরত থাকা। ‘লাইলাতান নিসফে মিন শাবান’-এ গোনাহ মাফের নিয়তে সন্ধ্যা রাতে গোসল করা থেকে বিরত থাকা। ঘরে, আঙিনায়, কবরে মোমবাতি-আগরবাতি জ্বালানো ও গোলাপজল ছিটানো থেকে বিরত থাকা।
‘লাইলাতান নিসফে মিন শাবান’-এ বাড়ি ঘর আলোকসজ্জা, কবরস্থানে আলোকসজ্জা ইত্যাদিও পরিহার করা আবশ্যক। কারণ শবে বরাতের নামে ইসলামে এ সব মারাত্মক সীমালঙ্ঘন। তা কোনোভাবে বৈধ নয়।

 

* সর্বশেষ  গুরুত্বপূর্ণ  সব  সংবাদ, ছবি ,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন লেখা পেতে আমাদের  ফেসবুক পেইজে  লাইক  দিয়ে  অ্যাকটিভ  থাকুন।  ভিজিট করুন : http://www.etihad.news

* অনলাইন  নিউজ পোর্টাল  ইত্তেহাদ নিউজে  লিখতে  পারেন  আপনিও। লেখার বিষয়  ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন  [email protected] ঠিকানায়

সংবাদটি শেয়ার করুন....
ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক :

ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক :

About Author

etihad news is one of the famous Bangla news portals published from Abudhabi-UAE. It has begun with a commitment to fearless, investigative, informative, and independent journalism. This online portal has started to provide real-time news updates with maximum use of Smart Technology.

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *