ইত্তেহাদ এক্সক্লুসিভ

এনআইডি কার্ড নিয়ে অনলাইন-অফলাইনে সক্রিয় শত শত চক্র

images
print news

দেশ রূপান্তর : জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) হারিয়ে গেলে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে তা উত্তোলন বা কোনো ভুলভ্রান্তি সংশোধন করতে গিয়ে নানা জটিলতায় পড়তে হয় অনেককেই। দফায় দফায় পোহাতে হয় ভোগান্তি। আর এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অনলাইন ও অফলাইনে সক্রিয় অসংখ্য চক্র। নির্বাচন কমিশনের (ইসি) কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর সহায়তায় এসব চক্রের মাধ্যমে নাগরিকদের সুরক্ষিত তথ্য চলে যাচ্ছে অলিগলির দোকানে, পড়ছে বেহাত হওয়ার ঝুঁকিতেও।নিজের হারিয়ে যাওয়া জাতীয় পরিচয়পত্র তুলতে গিয়ে সম্প্রতি ভোগান্তির শিকার হন রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দির বাসিন্দা আবু জার গিফারী। কয়েক মাস আগে হারিয়ে যায় তার এনআইডি কার্ড। জরুরি ভিত্তিতে পাসপোর্ট করতে তার প্রয়োজন পড়ে জাতীয় পরিচয়পত্রের। নিয়ম অনুযায়ী ২৩০ টাকা ফি দিয়ে আবেদন করেন নির্বাচন কমিশনে। এরপর গত ২৭ ফেব্রুয়ারি বালিয়াকান্দি উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তার কার্যালয়ে গেলে নির্বাচন কর্মকর্তা তাকে থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করে তার অনুলিপি নিয়ে আসতে বলেন। পরদিন জিডির কাগজ নিয়ে গেলে জানতে পারেন নির্বাচন কর্মকর্তা জেলা নির্বাচন অফিসে মিটিংয়ে ব্যস্ত আছেন। তখন সেখানে এক দালালের সঙ্গে পরিচয় হয়। তিনি আশ্বস্ত করেন টাকা দিলে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে এনআইডি কার্ড তৈরি করে দেওয়া সম্ভব। এরপর ওই দালালের মাধ্যমে স্থানীয় একটি কম্পিউটারের দোকানে গেলে তাকে কয়েক মিনিটের মধ্যে এনআইডি কার্ডের হুবহু কপি দেওয়া হয়।আবু জার গিফারী বলেন, ‘আমার জরুরি ভিত্তিতে পাসপোর্ট করতে হবে। তাই যথাযথ নিয়ম মেনে আবেদন করি। কিন্তু কয়েক দিন ঘুরেও পরিচয়পত্র পাইনি। অথচ একটি কম্পিউটারের দোকানে এনআইডি নম্বর দেওয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যেই জাতীয় পরিচয়পত্র পেয়ে গেছি।’

প্রায় একইভাবে রাজধানীর আগারগাঁও থেকে এনআইডি কার্ড সংগ্রহ করেন মো. রাফসান। তিনি জানান, বছর পাঁচেক আগে নামের বানান সংশোধন করতে নির্বাচন ভবনে দিনের পর দিন ঘুরতে হয়েছে। এরপর ওই আইডি কার্ড আবার হারিয়ে যায়। সম্প্রতি জাতীয় পরিচয়পত্রের প্রয়োজন পড়ে। এমন পরিস্থিতিতে পরিচিত এক বড় ভাইয়ের মাধ্যমে আগারগাঁওয়ের একটি কম্পিউটারের দোকান থেকে ৫০০ টাকা দিয়ে হারিয়ে যাওয়া পরিচয়পত্রের অনুলিপি সংগ্রহ করেন।কীভাবে এনআইডি কার্ড সরবরাহ করা হয় তা জানতে কথা হয় সংশ্লিষ্ট চক্রগুলোর সঙ্গে যুক্ত একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে। তারা জানান, এনআইডি কার্ড হারিয়ে গেলে অনেকেই আবেদন করতে আসেন হুবহু আরেকটি কপির জন্য। এ ক্ষেত্রে যথাযথ প্রক্রিয়ায় ইসির নির্দিষ্ট ওয়েবসাইটে আইরিশের (চোখের মণির ছবি দিয়ে ভেরিফাই) মাধ্যমে অ্যাকাউন্ট খুলে আবেদন করতে হয়। এ ছাড়া সংশ্লিষ্ট নির্বাচন অফিসে আবেদন ফরমের মাধ্যমে আবেদন করা যায়। এতে করে সাধারণ ২৩০ এবং জরুরি হলে ৩৪৫ টাকা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ফি দিতে হয়। পরে সংশ্লিষ্ট নির্বাচন অফিস আবেদনটির অনুমোদন দিলে হারিয়ে যাওয়া এনআইডির অনুলিপি অনলাইনে ডাউনলোডের পর প্রিন্ট করা সম্ভব হয়। কিন্তু নির্বাচন অফিস থেকে অনুমোদন পেতে কয়েক দিন কেটে যায়। ফলে অনেকেই ভোগান্তি এড়াতে তাৎক্ষণিক এনআইডি পেতে তাদের দ্বারস্থ হয়।

চক্রগুলোর ওই সদস্যরা জানান, তারা তাৎক্ষণিক হুবহু এনআইডি কার্ড সরবরাহ করে দিতে পারেন। এ ক্ষেত্রে তাদের খরচ হয় ৭০-১২০ টাকা। এনআইডিতে থাকা বারকোড স্ক্যান করলে সেটি যে আসল তার প্রমাণও মেলে। ফলে একদিকে সেবাগ্রহীতা যেমন তাৎক্ষণিক পরিচয়পত্র পান, অন্যদিকে প্রতিটি কার্ডে তাদের লাভ থাকে ২০০-এর বেশি টাকা।

এ প্রক্রিয়ায় প্রতিদিন শত শত এনআইডি কার্ড উত্তোলন করা হচ্ছে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে। আর চক্রগুলোর সদস্যদের বিভিন্ন জেলার নির্বাচন অফিসেরই একশ্রেণির অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী অর্থের বিনিময়ে এ কাজে সহায়তা দিয়ে থাকে বলে জানা গেছে। এ নিয়ে নির্বাচন কমিশন বারবার সতর্ক করলেও কোনো সুফল মেলেনি। ফলে একদিকে রাষ্ট্র যেমন বিপুল পরিমাণ রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, তেমনি ঝুঁকিতে পড়ছে হাজারো নাগরিকের ব্যক্তিগত তথ্য।

কীভাবে দেওয়া হয় পরিচয়পত্র : মূলত নির্বাচন অফিসের কিছু অসাধু কর্মীর সঙ্গে যোগসাজশ রয়েছে এসব চক্রের। তাদের মাধ্যমে নির্বাচন অফিস থেকে সার্ভার কপি সংগ্রহ করে চক্রের সদস্যরা। সার্ভার কপিতে একজন নাগরিকের সংশ্লিষ্ট সব ধরনের তথ্য থাকে। সার্ভার কপি নির্দিষ্ট সফটওয়্যারে অথবা অ্যাপসের মাধ্যমে ইনপুট (প্রবেশ করিয়ে) করে হুবহু জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করা হয়। যার বারকোড যাচাই করলেও সংশ্লিষ্ট নাগরিকের সব তথ্য পাওয়া যায়। প্রতিটি সার্ভার কপি সংগ্রহে চক্রগুলো সরবরাহকারীকে ১০-১৫ টাকা করে দিয়ে থাকে। আবেদনকারীদের চাপ বেড়ে গেলে অবশ্য টাকার পরিমাণ বেড়ে যায়। তখন প্রতি সার্ভার কপির জন্য ৫০-৮০ টাকা পর্যন্ত দিতে হয়। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে নির্বাচন অফিসের সংশ্লিষ্ট কর্মীর সঙ্গে চক্রগুলোর মাসিক বা বাৎসরিক নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকার চুক্তি হয়ে থাকে।

অনলাইনেও সক্রিয় প্রতারক চক্র : শুধু অফলাইনেই নয়, অনলাইনেও সক্রিয় বহু চক্র। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, টেলিগ্রামে এমন অর্ধশত চক্রের সন্ধান মিলেছে অনুসন্ধানে। ‘৫ মিনিটের মধ্যে দেওয়া হয় জাতীয় পরিচয়পত্র’ ফেসবুকে দেওয়া এমন স্ট্যাটাসের সূত্র ধরে অনুসন্ধান করে এই অর্ধশত চক্রের সন্ধান মেলে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, প্রতিটি চক্রের দুই হাজারের বেশি সদস্য রয়েছে। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন নম্বর দিয়ে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ খোলে তারা। হারিয়ে যাওয়া জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর, জন্মনিবন্ধন নম্বর, পিতা-মাতার এনআইডি, ভোটার নম্বর এবং এমনকি মোবাইল ফোন নম্বর অথবা নাম-ঠিকানা দিলেও এসব চক্র জাতীয় পরিচয়পত্র কিংবা সার্ভার কপি সরবরাহ করতে সক্ষম।চক্রগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- ‘এক সেবা, National Nid card services/জন্মনিবন্ধন সেবা বিডি, অনলাইন ই-সেবা ফাস্ট সার্ভিস, পাইকারি রেটে NID, পাইকারি প্রযুক্তি সেবা।

চক্রগুলো অনলাইনে প্রতিটি পরিচয়পত্রের জন্য ১০০ থেকে ১৫০ এবং সার্ভার কপির ক্ষেত্রে ৫০ টাকা নিয়ে থাকে। এ ছাড়া গ্রাহকদের আস্থা অর্জনে চক্রগুলো জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্য সংশোধনের বিজ্ঞাপন দিয়ে ট্যাম্পারিংয়ের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনের এনআইডি সংক্রান্ত সেবার হটলাইন নম্বর ১০৫ থেকে বার্তা পাঠিয়ে আস্থা অর্জন করে থাকে। আবার অনেক সময় সংশোধনী আবেদন নিষ্পত্তির কথা বলে টাকা নিয়ে সংশোধন না করে প্রতারণাও করে থাকে কিছু কিছু চক্র।

২০২২ সালে জাতীয় পরিচয়পত্র সংক্রান্ত বিভিন্ন অ্যাপস ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অবৈধ কার্মকাণ্ড সার্বক্ষণিক মনিটরিং ও অপরাধীদের শনাক্ত করাসহ প্রাসঙ্গিক অন্যান্য বিষয় তদারকির জন্য দুটি কমিটি করে নির্বাচন কমিশন। ওই কমিটি অনলাইনে অভিযোগের ভিত্তিতে কিছু কিছু অবৈধ অ্যাপস ও ফেসবুক পেজ বন্ধ করে দেয়।

ছুটির দিনেও অস্বাভাবিক ডেটা সার্চ : সাপ্তাহিক বা অন্যান্য ছুটির দিনেও অস্বাভাবিক ডেটা সার্চের (তথ্য অনুসন্ধান) তথ্য রয়েছে ইসির হাতে। সম্প্রতি এ বিষয়ে গাজীপুর নির্বাচন অফিসের এক কর্মচারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নিয়েছে নির্বাচন কমিশন। এ সংক্রান্ত একটি চিঠি থেকে জানা যায়, উপজেলা/থানা নির্বাচন অফিসের ডেটা এন্ট্রি অপারেটরদের সিএমএসের সিটিজেন অপশন থেকে অস্বাভাবিক ডেটা সার্চ করা হয়েছে। একটি অ্যাকাউন্ট থেকে গত ২১ ফেব্রুয়ারি অন্য উপজেলার ৬৭০টি ডেটা সার্চ করার প্রমাণ পাওয়া গেছে।

হারিয়ে যাওয়া এনআইডি তোলা বা সংশোধন নিয়ে বহু চক্রের সক্রিয় থাকার সত্যতা স্বীকারও করেছেন জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন অনুবিভাগের একাধিক কর্মকর্তা। তাদের একজন নাম না প্রকাশ করার শর্তে বলেন, ‘গাজীপুরের যে কর্মচারীর বিরুদ্ধে অস্বাভাবিক ডেটা সার্চের অভিযোগ উঠেছে তা সত্য। তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে। শুধু ওই কর্মচারীই নন, এমন আরও কর্মী এ ধরনের ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত।’তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের কাছে এ ধরনের তথ্য আগেও এসেছে। অনেকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে। কিন্তু কোনোভাবেই এদের ঠেকানো যাচ্ছে না। কারণ নির্বাচন কমিশনের কিছু কর্মী এসব চক্রের সঙ্গে জড়িত। বিশেষ করে যারা ডেটা এন্ট্রি অপারেটরের কাজ করেন তাদের মাধ্যমে এ ধরনের ঘটনা ঘটে থাকে।’এ ব্যাপারে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ বলেন, ‘যারা এ ধরনের কাজের সঙ্গে যুক্ত তাদের বিরুদ্ধে ধারাবাহিকভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এখন পর্যন্ত ৫০ জন ডেটা এন্ট্রি অপারেটরের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তার মধ্যে ১৬ জনের চাকরি গিয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘এনআইডি সংক্রান্ত হটলাইন নাম্বার ট্যাম্পারিং করে গ্রাহকদের আস্থা অর্জনে যে মেসেজ দেওয়া হয় এ বিষয়টা আমার জানা নেই। বিষয়টি খতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

ঝুঁকিতে নাগরিকের তথ্য : দেশে ১৮ বছর বা তার বেশি বয়সী প্রত্যেক নাগরিককে জাতীয় পরিচয়পত্র দেয় সরকার। ইসির সর্বশেষ হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে ভোটার ১২ কোটি ১৮ লাখ ৫০ হাজার ১৬০ জন। তাদের প্রতিটি পরিচয়পত্রই অনন্য (ইউনিক)। এ পরিচয়পত্র দিয়ে নাগরিকরা ড্রাইভিং লাইসেন্স, পাসপোর্ট, জমি কেনাবেচা, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা এবং অন্যান্য পরিষেবা পেয়ে থাকেন। ইসিতে ভোটারদের ছবি, আঙুলের ছাপসহ অন্তত ৪০টি তথ্য সংবলিত তথ্যভাণ্ডার সংরক্ষিত রয়েছে।

হারিয়ে যাওয়া এনআইডি তোলা বা সংশোধনের ক্ষেত্রে ইসির প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে নাগরিকরা চক্রগুলোর দ্বারস্থ হওয়ার বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)-এর সাধারণ সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার  বলেন, ‘ভোগান্তির কারণে নাগরিকরা এরকম অসদুপায় অবলম্বন করে। নির্বাচন কমিশনের ভুলের কারণে এনআইডি জটিলতা নিয়ে ভোগান্তি ও আর্থিক দুভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হয় নাগরিকরা। আর তার সুযোগ নিচ্ছে কমিশনের অসাধু কর্মী ও দালাল চক্র। ফলে এতে করে নাগরিকের ব্যক্তিগত তথ্যও ঝুঁকিতে রয়েছে। কমিশনের উচিত এদের বিরুদ্ধে আরও কঠোর হওয়া।

 

* সর্বশেষ  গুরুত্বপূর্ণ  সব  সংবাদ, ছবি ,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন লেখা পেতে আমাদের  ফেসবুক পেইজে  লাইক  দিয়ে  অ্যাকটিভ  থাকুন।  ভিজিট করুন : http://www.etihad.news

* অনলাইন  নিউজ পোর্টাল  ইত্তেহাদ নিউজে  লিখতে  পারেন  আপনিও। লেখার বিষয়  ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন  [email protected] ঠিকানায়

সংবাদটি শেয়ার করুন....
ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক :

ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক :

About Author

etihad news is one of the famous Bangla news portals published from Abudhabi-UAE. It has begun with a commitment to fearless, investigative, informative, and independent journalism. This online portal has started to provide real-time news updates with maximum use of Smart Technology.

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *