ইত্তেহাদ এক্সক্লুসিভ

কক্সবাজার জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর দুর্নীতির আখড়া

image 786068 1710733522
print news

কক্সবাজার প্রতিনিধি :  দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে কক্সবাজার জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর। টেন্ডারের গোপন রেইট ফাঁস, নিজস্ব ঠিকাদার দিয়ে কাজ ভাগিয়ে নেওয়া, ঘুস গ্রহণ, কমিশন বাণিজ্য, টেন্ডার নিয়ে নানা অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত হওয়ার অভিযোগ রয়েছে এখানকার নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মোস্তাফিজুর রহমানের বিরুদ্ধে। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী কক্সবাজার সফর ঘিরে জরুরি কাজ দেখিয়ে তিন দফায় টাকা আত্মসাৎ করেছেন তিনি। আর এই ঘুস-দুর্নীতির পক্ষে যুক্তিও দেখান তিনি। বলেন, ‘দুই কোটি টাকা দিয়ে পোস্টিং নিয়েছি, ঘুস না নিলে ওই টাকা তুলব কীভাবে?’

অনিয়ম-দুর্নীতি সুবিধার্থে এই কর্মকর্তা সাবেক কর্মস্থল চুয়াডাঙ্গা থেকে কক্সবাজারে বদলি করে এনেছেন সহযোগী ক্যাশিয়ার গৌতম কুমার পাল ও প্রাক্কলনিক রাজীব হোসেন রাজুকে। এখন তারাই ঠিক করে দেন, কে কত টাকার টেন্ডারের রেইট দেবে এবং কোন ঠিকাদার কোন কাজটা পাবেন। এ নিয়ে মোস্তাফিজুর রহমানের বিরুদ্ধে দুদক, স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন ভুক্তভোগী ঠিকাদার সোহেল জাহান চৌধুরী এবং কক্সবাজারের সচেতন নাগরিক কমিটি নামের একটি সংগঠন। সংগঠনটির সভাপতি অজিৎ দাশ ও সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুর রহমান অভিযোগে স্বাক্ষর করেছেন। যদিও সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন নির্বাহী প্রকৌশলী মোস্তাফিজুর রহমান।

যত অভিযোগ মোস্তাফিজুর রহমানের বিরুদ্ধে : কক্সবাজারের নয়টি উপজেলার স্থায়ী বাসিন্দাদের জন্য স্যানিটেশন এবং বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের ইএমসিআরপি প্রকল্প, রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং প্রকল্প, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে স্যানিটেশন, গভীর নলকূপ, টয়লেট, পয়ঃবর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও ওয়াটার রিজার্ভার স্থাপন প্রকল্প থেকে কয়েক কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে মোস্তাফিজুর সিন্ডিকেট। এ ছাড়াও আরএফকিউ টেন্ডারে কোনো প্রকার নোটিশ ছাড়া নিজস্ব ঠিকাদারের লাইসেন্স ব্যবহার করে কাজ করানো, টেন্ডার ছাড়া গুদামের মাল বিক্রি, ভুয়া কাজ দেখিয়ে বিভিন্ন প্রকল্পের টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে আর বিরুদ্ধে। অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, মোস্তাফিজুর রহমান মোটা অঙ্কের ঘুস দিয়ে ২০২২ সালের আগস্ট মাসে কক্সবাজার জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী হিসাবে যোগ দেওয়ার পর থেকে ওই টাকা তুলতে বেপরোয়া হয়ে ঘুসবাণিজ্য, টেন্ডারবাণিজ্য ও কমিশনবাণিজ্যসহ বিভিন্ন অনিয়মে জড়িয়ে পড়েন। তিনি ঠিকাদার ও কর্মকর্তা কর্মচারীদের কথায় কথায় হাঁকডাক দিয়ে বলেন, ‘দুই কোটি টাকা দিয়ে পোস্টিং নিয়েছি, ঘুস না নিলে টাকা তুলব কীভাবে?’

কয়েজন ঠিকাদারের অভিযোগ, বিভিন্ন প্রকল্পের অর্থ পরিশোধের জন্য বিল প্রস্তুত করে জেলা হিসাবরক্ষণ কার্যালয়ে পাঠানো হয়। নিয়মানুযায়ী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো হিসাবরক্ষণ কার্যালয় থেকে চেক গ্রহণ করবে। অথচ নির্বাহী প্রকৌশলী মোস্তাফিজুর রহমান তার অনিয়মের সহযোগী ক্যাশিয়ার গৌতম কুমার পালের মাধ্যমে ঠিকাদারের কাছ থেকে কমিশনের নামে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেন। পছন্দের ঠিকাদারের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের উৎকোচ নিয়ে ২০ ভাগ কাজ করিয়ে ৮০ ভাগ অগ্রিম বিল পরিশোধ করেন। এ ছাড়াও কাজের কার্যাদেশ প্রদানের জন্য অতিরিক্ত অর্থ আদায় করেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে কক্সবাজার জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরে ইএমসিআরপি প্রকল্পের অধীনে কক্সবাজার জেলার নয়টি উপজেলার স্থায়ী বাসিন্দাদের স্যানিটেশন এবং বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের লক্ষ্যে এক হাজার ৮০০ গভীর নলকূপ, আট হাজার ৮০০ টয়লেট, এক হাজার বায়োফিল টয়লেট, গ্রামীণ পাইপড ওয়াটার সাপ্লাই স্কিম ৩১টি এবং ২০টি পাবলিক টয়লেট স্থাপন করা হচ্ছে। নিয়ম অনুযায়ী গভীর নলকূপ স্থাপনে ৯০০ ফুট থেকে এক হাজার ফুট বোরিং করার কথা থাকলেও করা হচ্ছে ৭০০ ফুট থেকে ৭৫০ ফুট। নলকূপে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান বা যুক্তরাজ্যের ৬০ হাজার টাকা সাবমার্সিবল পাম্প দেওয়া কথা থাকলেও দেওয়া হচ্ছে দেশীয় নিুমানের ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকার পাম্প। এসব নলকূপের পানি ও পাম্প বুয়েটের ল্যাব কর্তৃক পরীক্ষা করার কথা থাকলেও সেখানেও নেওয়া হয়েছে প্রতারণার আশ্রয়। কয়েকটি ভালো নলকূপের পানি পরীক্ষা করিয়ে রিপোর্ট প্রদান করা হয়েছে। অথচ অনেক নলকূপের পানিতে অতিরিক্ত আয়রণ, লবণাক্ত, আর্সেনিক ও জীবাণু পাওয়া যাচ্ছে এবং অনেক নলকূপের গভীর কম হওয়ায় গ্রীষ্মকালে পানিও পাওয়া যাচ্ছে না বলে অভিযোগ করেছেন উপকারভোগীরা।

রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং প্রকল্পেও অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। কাজের বিবরণীর বিওকিউতে ভালো কোম্পানির ট্যাংক দেওয়ার কথা থাকলেও তা মানা হয়নি। দেওয়া হয়েছে নিুমানের পানির ট্যাংক। ঠিকাদারের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের ঘুস নিয়ে ২০ ভাগ কাজ করা হলেও দেওয়া হয়েছে ৮০ ভাগ বিল। ফলে কার্যাদেশের মেয়াদ শেষ হলেও শেষ হয়নি বেশির ভাগ কাজ।

জনসাস্থ্য অধিদপ্তরের গুদাম পরিষ্কার করতে পরিত্যক্ত মালমাল বিক্রির ক্ষেত্রেও মানা হয়নি সরকারি নিয়ম। টেন্ডারের মাধ্যমে মালমাল বিক্রি করার নিয়ম থাকলে তা করা হয়নি। প্রাক্কলনিক রাজীব হোসেন রাজুর মাধ্যমে কোনো বিজ্ঞপ্তি বা কোটেশন ছাড়াই নিজস্ব লোকজনদের মাধ্যমে মোটা অঙ্কের কমিশন নিয়ে মালামাল বিক্রি করে দেওয়া হয়। যে কারণে সরকার কোটি টাকার রাজস্ব হারিয়েছে।

রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর সফর ঘিরে কোটি টাকা আত্মসাৎ : অভিযোগ আছে, রাষ্ট্রপ্রতি ও প্রধানমন্ত্রী কক্সবাজার সফর ঘিরে কক্সবাজার জনসাস্থ্য অধিদপ্তরের স্টাফ কোয়ার্টার মেরামতের বরাদ্দ এনে কাজ না করে বিপুল অঙ্কের টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। সূত্রমতে, ২০২২ সালের ডিসেম্বর মাসে কক্সবাজারে প্রধানমন্ত্রীর সফরকালে জরুরি কাজ দেখিয়ে ২৪ লাখ টাকা, ২০২৩ সালের জুলাই মাসে রাষ্ট্রপতি কক্সবাজার সফরকালে জরুরি কাজ দেখিয়ে ২৯ লাখ টাকা এবং ২০২৩ সালের নভেম্বর মাসে প্রধানমন্ত্রীর কক্সবাজার সফরকালীন জরুরি কাজ দেখিয়ে ২১ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেন নির্বাহী প্রকৌশলী মোস্তাফিজুর রহমান। এ ছাড়াও ২০২৩ সালে দুর্যোগকালীন সময়ে তিন উপজেলায় সাইক্লোন শেল্টার মেরামতের কাজ দেখিয়ে কয়েক কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়।

নিজস্ব ঠিকাদার এনে কাজ করানোর অভিযোগ : মোস্তাফিজুর রহমান বিভিন্ন জেলা থেকে তার নিজস্ব ঠিকাদার এনে একটি সিন্ডিকেট তৈরি করেছেন। প্রাক্কলনিক রাজীব হোসেন রাজুর মাধ্যমে তাদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের কমিশন নিয়ে দরপত্রের গোপন রেইট বলে দেন মোস্তাফিজুর। এরপর তাদের কাজ দিয়ে নিুমানের সামগ্রী ব্যবহার ও অনিয়মের মাধ্যমে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন মিলেমিশে। সম্প্রতি নবগঠিত ঈদগাঁও উপজেলায় নিরাপদ পানি সরবরাহ, স্যানিটেশন, ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনা সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন প্রকল্পের দরপত্রে বড় ধরনের দুর্নীতি করা হয়েছে।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাহী প্রকৌশলী মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, আমার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ সত্য নয়। দুই কোটি টাকা ঘুস দিয়ে কক্সবাজারে এসেছি ঘুস না নিলে টাকা তুলব কীভাবে-এসব কথা কখনো বলিনি। তিনি বলেন, যাদের বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছিল তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কারণে তারা আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে। মোস্তাফিজুর আরও বলেন, ভালো কাজ করতে গিয়ে আজ আমাকে ষড়যন্ত্রের মুখোমুখি হতে হচ্ছে।

 

* সর্বশেষ  গুরুত্বপূর্ণ  সব  সংবাদ, ছবি ,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন লেখা পেতে আমাদের  ফেসবুক পেইজে  লাইক  দিয়ে  অ্যাকটিভ  থাকুন।  ভিজিট করুন : http://www.etihad.news

* অনলাইন  নিউজ পোর্টাল  ইত্তেহাদ নিউজে  লিখতে  পারেন  আপনিও। লেখার বিষয়  ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন  [email protected] ঠিকানায়

সংবাদটি শেয়ার করুন....
ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক :

ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক :

About Author

etihad news is one of the famous Bangla news portals published from Abudhabi-UAE. It has begun with a commitment to fearless, investigative, informative, and independent journalism. This online portal has started to provide real-time news updates with maximum use of Smart Technology.

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *