দখলে ভরাটে বিলীন ৯০ শতাংশ পুকুর


ঢাকা প্রতিনিধি : রাজধানীর পুরান ঢাকার ডিআইটি পুকুর। ব্রিটিশ আমলে পুকুরটি খনন করেন সতি বাবু (স্থানীয় ভাষায়) নামে এক ধনাঢ্য ব্যক্তি। এলাকার আদি বাসিন্দাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, পুকুরটির আয়তন ছিল প্রায় দুই একর। শতবর্ষী এ পুকুরটি এলাকার মানুষের নানান কাজে লাগত। খাওয়ার পানি সংগ্রহ, গোসল ও থালাবাসন ধোয়া থেকে শুরু করে বিভিন্ন কাজে পুকুরটির পানি ব্যবহার হতো। আশপাশে কোথাও আগুন লাগলে এ পুকুরের পানিই ছিল ভরসা। এরই মধ্যে কেটে গেছে ১০০ বছর। এ সময়ে পুকুরটির চারপাশে যেন পাল্লা দিয়ে বেড়েছে জনবসতি। সেই সঙ্গে একটু একটু করে দখল হতে শুরু করে পুকুরের চারপাশ।
এলাকাবাসী জানান, ১৫ বছর আগেও পুকুরটি ব্যবহার করতেন তারা। কিন্তু তখন থেকে পুকুরটি দখলের পাঁয়তারা শুরু করে স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি। তারা ধীরে ধীরে পুকুরের পাড় দখল করতে থাকে। একে একে চারপাশে গড়ে তোলা হয় খানকা শরিফ, মিনি পার্ক, মার্কেট, গ্যারেজসহ নানা ধরনের অবকাঠামো। একই সঙ্গে চলে নিয়মিত বর্জ্য ফেলা। শেষ পর্যন্ত পুকুরটিকে ময়লার ভাগাড়ে পরিণত করা হয়।
এমন পরিস্থিতিতে কয়েক বছর ধরে পুকুরটি রক্ষায় আন্দোলন চালিয়ে আসছেন এলাকার সচেতন বাসিন্দারা। শুরুতে পুকুর রক্ষায় চলে বিভিন্ন দপ্তরে চিঠি চালাচালি। কিন্তু তাতে কোনো কাজ না হওয়ায় শুরু হয় পুকুর রক্ষার আন্দোলন। আন্দোলনের মুখে রাজধানী উন্নয়ন কর্র্তৃপক্ষের (রাজউক) উদ্যোগে পুকুরের পাড়ে ভাঙা হয় নির্মাণাধীন ভবন। পুকুরটি রক্ষায় উচ্চ আদালতে রিটও করা হয়। সিটি করপোরেশন থেকে আশ্বাস দেওয়া হয় পুকুরটি শুরুর অবস্থায় ফিরিয়ে দেওয়ার। কিন্তু এতকিছুর পরও এখনো দখলদারদের সম্পূর্ণভাবে বিতাড়ন করা সম্ভব হয়নি।
টানা আন্দোলনের মুখে ডিআইটি পুকুর কোনোমতে টিকে থাকলেও গত তিন দশকে রাজধানী থেকে হারিয়ে গেছে কয়েকশ পুকুর। এসব পুকুর ভরাট করে নির্মাণ করা হয়েছে আবাসিক ভবন, মার্কেটসহ নানা স্থাপনা। আর হাতেগোনা যেসব পুকুর টিকে রয়েছে, সেগুলোরও প্রাণ যায় যায় দশা।
সরেজমিনে দেখা যায়, ডিআইটি পুকুরের চারপাশে ছড়িয়ে আছে ময়লা-আবর্জনা। দক্ষিণ-পশ্চিম পাশের অংশে পুকুরের জায়গা দখল করে নির্মাণ করা হচ্ছে ফ্যামিলি গার্ডেন নামে একটি ফুড কর্নার। তার পাশেই পুকুরের জায়গা দখল করে আগেই নির্মাণ করা হয়েছে খানকাহ শরিফ। এ ছাড়া পূর্বপাশের পুরো অংশ জুড়ে রিকশা ও গাড়ির গ্যারেজ উঠিয়ে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। আর পশ্চিম পাশে রাজউকের ভেঙে ফেলা ভবনের ধ্বংসাবশেষ এখনো সরানো হয়নি।
ডিআইটি পুকুর রক্ষা কমিটির সংগঠক ইব্রাহিম হোসেন রিপন বলেন, ‘আমাদের দীর্ঘদিন আন্দোলন করতে হয়েছে পুকুরটি রক্ষার জন্য। রাজউকের উদ্যোগে পুকুরের কিছু অংশ উদ্ধার করা হয়েছে, তবে পুরোটা এখনো সম্ভব হয়নি। আমরা মেয়রের কাছে আবেদন জানিয়েছিলাম পুকুরটি যেন পুরোপুরি উদ্ধার করে সংস্কারের পর আবারও ব্যবহার উপযোগী করে দেয়। না হলে আমরা যতই চেষ্টা করি, পুকুরটি রক্ষা করা যাবে না।’
রাজধানী ঢাকার সীমানা ১৯২৪ সালের টপোগ্রাফি মানচিত্রে ছিল অনেক ছোট। উত্তরে শাহবাগ, দক্ষিণে চর ইউসুফ ও চর কামরাঙ্গী, পশ্চিমে ধানম-ি এবং পূর্বে ছিল মতিঝিল ও ইংলিশ রোডের অবস্থান। এসব এলাকার মধ্যবর্তী অংশকে দেখানো হয় ওই মানচিত্রে। আর এ ছোট সীমানার মধ্যেও অন্তত ১২০টি পুকুর ছিল।
এরপর ১৯৮৫ সালে ঢাকা শহরের পুকুর নিয়ে একটি গবেষণা করে মৎস্য বিভাগ। ওই সময় তাদের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ঢাকায় পুকুরের সংখ্যা ছিল দুই হাজারেরও বেশি। অথচ এর পরের তিন দশকে এসব পুকুরের ৯০ শতাংশই হারিয়ে গেছে। জানা গেছে, যে ১ হাজার ৯০০ সরকারি-বেসরকারি মালিকানার পুকুর ও জলাধার ভরাট হয়েছে তাতে জমির পরিমাণ ছিল ৭০ হাজার হেক্টর।
সর্বশেষ ২০২১ সালে রাজধানীর পুকুর নিয়ে জরিপ করে রিভার অ্যান্ড ডেলটা রিসার্চ সেন্টার (আরডিআরসি) নামে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। তাদের গবেষণায় বলা হয়, ঢাকায় এখন সাকল্যে ২৪১টি পুকুর কোনোমতে টিকে আছে। এর মধ্যে পুরান ঢাকায় রয়েছে ২৪টি।
ওই গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যে ২৪১টি পুকুর টিকে আছে তার বড় অংশই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মসজিদ ও মন্দিরসহ নানা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের আওতায় রয়েছে। এজন্য প্রভাবশালীরা দখল করতে পারছে না। টিকে থাকা ২৪১টি পুকুরের মধ্যে আবার ৮৬টি পুকুর সরকারি-বেসরকারি সংস্থাগুলোর দখলে চলে গেছে। এর মধ্যে সরকারি সংস্থা দখল করে আছে সাতটি পুকুর আর বেসরকারি সংস্থা দখল করেছে ৭৯টি।
রিভার অ্যান্ড ডেলটা রিসার্চ সেন্টারের জরিপের তথ্য থেকে জানা যায়, একসময় শাহবাগে বড় দুটি পুকুর ছিল, যার একটি ভরাট করে গড়ে তোলা হয়েছে আজিজ সুপার মার্কেট। আর অন্যটিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু হল ও জিয়া হল করা হয়েছে।
আজিজ সুপার মার্কেটের পশ্চিম পাশেও একটি পুকুর ছিল, যেখানে পাওয়ার হাউজ করা হয়েছে। শান্তিনগরের পীর সাহেবের গলিতেও বড় একটি পুকুর ছিল। চারদিক থেকে ভরাট করার কারণে এটা এখন ছোট্ট ডোবায় পরিণত হয়েছে। জিগাতলা, রায়েরবাজার এলাকায় প্রচুর ডোবা ছিল। এখন সে ডোবাগুলোর ওপর দাঁড়িয়ে আছে বহুতল ভবন। বাসাবো, খিলগাঁও ও রাজারবাগ এলাকার প্রায় সব পুকুরই সরকারিভাবে ভরাট করা হয়েছে। এ ছাড়া রাজারবাগ পুলিশ লাইনসের পুকুর, কমলাপুর রেলস্টেশনের পূর্বদিকে রেলের ঝিল ও আহমদবাগ ঝিলের নাম মানচিত্র থেকে মুছে গেছে। পুরান ঢাকার শতবছরের ঐতিহ্য সিক্কাটুলী পুকুরটিও হুমকির মুখে।
ঢাকার উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণে পরিবেশের বিষয়টি তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। ফলে দখল ও ভরাট হয়েছে জলাশয়। ব্রিটিশ আমলের মানচিত্রে থাকা আদি ঢাকার পুকুরগুলোও ভরাট হয়েছে সমানতালে। বর্তমানে যেসব পুকুর টিকে রয়েছে সেগুলোরও আয়তনও বেশ ছোট হয়ে গেছে।
জলাধার রক্ষা আইন অনুযায়ী, কোনো অবস্থায় খাল, বিল, নদী-নালা, পুকুর ও প্রাকৃতিক জলাশয়ের স্বাভাবিক গতি ও প্রকৃতি পরিবর্তন করা যাবে না। এমনকি সড়ক-মহাসড়ক, ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণকালেও প্রাকৃতিক জলাশয়, জলাধার, খাল-নদী ইত্যাদির স্বাভাবিকতা নষ্ট করা যাবে না। জনস্বার্থে ও একান্ত প্রয়োজন হলে সরকারের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে। কিন্তু জলাধার আইনের তোয়াক্কা না করেই জলাশয়গুলো দ্রুত দখল ও ভরাট করে স্থাপনা গড়ে তোলা হয়েছে।
রিভার অ্যান্ড ডেলটা রিসার্চ সেন্টারের (আরডিআরসি) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ বলেন, ‘আমরা পুকুর খুঁজতে গিয়ে দেখলাম মাত্র তিন দশকে শত শত পুকুর উধাও হয়ে গেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দখল হয়েছে ব্যক্তি মালিকানাধীনে থাকা পুকুরগুলো। এরপর অনেক সরকারিভাবে খনন করা পুকুরও ভরাট হয়ে গেছে ভবন নির্মাণের নামে। আমরা যেসব পুকুরের অস্তিত্ব পেয়েছে তার মধ্যে ৭০ শতাংশ পুকুরের স্বাস্থ্য ভালো। বাকিগুলো দখল করার জন্য ময়লা-আবর্জনার ভাগাড় বানানো হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘একটি পুকুর চাইলেই কেউ উধাও করে দিতে পারে না। এটি সিটি করপোরেশনের সঙ্গে সম্পৃক্ত, মৎস্য অধিদপ্তরের সঙ্গে সম্পর্কিত, ভূমি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত। ২০০০ সালে ভূমি বিধিমালা তৈরি করা হয়। এ বিধিমালা গত ২৪ বছরে যথাযথভাবে প্রয়োগ করা হয়নি। রাতারাতি সব ভরাট হয়ে গেছে। এভাবে চললে যেগুলো এখনো টিকে আছে, সেগুলোরও অস্তিত্ব থাকবে না।’
যেকোনো শহরকে বাসযোগ্য করতে জলাধার বড় ভূমিকা রাখে বলে জানান স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ও বিশ্ববিদ্যালয়টির বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার। তিনি বলেন, ‘যেসব শহরে প্রাকৃতিক জলাধার নেই, সেখানে কৃত্রিম জলাধার তৈরি করা হয়। এ জলাধার একটি শহরকে কয়েকভাবে বাসযোগ্য হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে। যত বেশি জলাধার থাকবে, ততবেশি ওই শহরের তাপমাত্রা ঠা-া থাকবে। কোনো এলাকায় জলাধার থাকলে ওই এলাকায় বায়ুদূষণ কমানোর ক্ষেত্রেও তা ভূমিকা রাখে। এ ছাড়া প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা আগুন লাগলে তা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রেও জলাধারের বড় ভূমিকা রাখছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘একটি শহরের ১৫-২০ ভাগ জলাধার থাকলে সেটাকে আদর্শ শহর বলা হয়। একটা সময় আমাদের শহরে পুকুর ছিল, লেক ছিল, নদীগুলো দখলমুক্ত ও দূষণমুক্ত ছিল। কিন্তু দিনে দিনে পুকুরগুলো ভরাট হচ্ছে, দখল হচ্ছে। আইন অনুযায়ী কোনো পুকুর যদি ব্যক্তি মালিকানাধীনও হয়, তাও তা ভরাট করা যাবে না। অনুমোদন নিয়ে হোক বা না নিয়ে হোক, পুকুর ভরাট করার কোনো সুযোগ নেই।’
বিলীন হওয়া বা বিলীনের পথে থাকা পুকুরগুলো রক্ষায় বড় ধরনের উদ্যোগ নেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে বলে মনে করেন নগর পরিকল্পনাবিদ ও স্থপতি ইকবাল হাবিব। তিনি বলেন, ‘সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে শহর থেকে অসংখ্য জলাশয় ও পুকুর হারিয়ে গেছে। এখন সময় হয়েছে সেসব পুকুর ও জলাশয় উদ্ধার করে যথাযথ ব্যবহারের। যার মধ্যে রয়েছে এগুলোর পানি দিয়ে অগ্নিনির্বাপণের হাইড্রেন ব্যবস্থা তৈরি করা। এসব জলাধার উদ্ধারে বড় ধরনের পদক্ষেপ শুরু করা দরকার। ইতিমধ্যে পুকুরগুলো রক্ষার জন্য রাজউক উদ্যোগ নিয়েছে। ঢাকার ডিটেইল এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ) বাস্তবায়নের সময় এ বিষয়ে আরও কঠোর হতে হবে। কারণ সিটি করপোরেশনগুলো খালের নেটওয়ার্ক উদ্ধার না করে খণ্ডিতভাবে খাল উদ্ধারের চেষ্টা করছে। তারা সফল হচ্ছে না। আমরা মনে করি, ব্লু নেটওয়ার্ক (ঢাকার ১ হাজার ৩২৭ কিলোমিটার নদীপথ) পুরোপরি উদ্ধার করলে পুকুর জলাশয় রক্ষা করা সম্ভব।
* সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ সব সংবাদ, ছবি ,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন। ভিজিট করুন : http://www.etihad.news
* অনলাইন নিউজ পোর্টাল ইত্তেহাদ নিউজে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়