‘নিয়োগের রানি’ ছিলেন চবির সাবেক উপাচার্য শিরীণ : ছিলেন আলোচিত, সমালোচিত ও বিতর্কিত


চট্টগ্রাম প্রতিনিধি : চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) সদ্য সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক শিরীণ আখতার। দায়িত্ব পালনকালে চার বছরে সবসময়ই ছিলেন আলোচিত, সমালোচিত ও বিতর্কিত। যার কেন্দ্রে ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগে অনিয়ম। যেখানে অধিকাংশই ছিল অবৈধ দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে নিয়োগ। তার আমলে রেজিস্ট্রার বিল্ডিং ও উপাচার্যের বাসভবন পরিচিতি পায় ‘নিয়োগের বাজার’ নামে। আড়ালে তাই অনেকে উপাচার্য শিরীণকে ডাকতেন ‘নিয়োগের রানি’।বিশ্ববিদ্যালয়ের সূত্র মতে, উপাচার্য তার চার বছরে প্রায় পাঁচ শতাধিক শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগ দিয়েছেন। শেষ তিন মাসে এমন নিয়োগের সংখ্যা ১১৭। আর নিজের শেষ কর্মদিবসে নিয়োগ দিয়েছেন ৪০ জনকে। নিয়োগ পাওয়া অধিকাংশই বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা, কর্মচারীদের আত্মীয়স্বজন এবং শাখা ছাত্রলীগের সাবেক-বর্তমান নেতাকর্মী। গত মঙ্গলবার (১৯ মার্চ) চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন উপাচার্য হিসেবে ড. মো. আবু তাহেরকে নিয়োগের মধ্য দিয়ে শেষ হয় বহুল বিতর্কিত শিরীণ অধ্যায়।দৈনিকভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়ার বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। ২০২০ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর সংস্থাটি দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে তাদের অনুমতি ছাড়া অ্যাডহক, দৈনিকভিত্তিক জনবল ও মাস্টাররোলে নিয়োগ না দেওয়ার জন্য নির্দেশনা দিয়েছিল। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটেও দৈনিকভিত্তিতে নিয়োগের ব্যাপারে একটি প্রস্তাবনা পাস হয়েছিল। কিন্তু এগুলোর কোনোটিই মানেননি সদ্য সাবেক এ উপাচার্য।রেজিস্ট্রার দপ্তর সূত্রে জানা যায়, অবৈধ এসব দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে নিয়োগ হয় রেজিস্ট্রারের স্বাক্ষরে ও উপাচার্যের অনুমোদনে। শূন্য ও সৃষ্ট এসব পদের বেতন-ভাতা দেওয়া হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব তহবিল থেকে। এরপর শূন্য পদের বিপরীতে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করলে নিয়োগপ্রাপ্তরা স্থায়ী হন। কিন্তু সৃষ্ট পদের জন্য প্রয়োজন হয় ইউজিসির বাজেট অনুমোদন।উপাচার্য তার চার বছরে প্রায় পাঁচ শতাধিক শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগ দিয়েছেন। শেষ তিন মাসে এমন নিয়োগের সংখ্যা ১১৭। আর নিজের শেষ কর্মদিবসে নিয়োগ দিয়েছেন ৪০ জনকে। নিয়োগ পাওয়া অধিকাংশই বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা, কর্মচারীদের আত্মীয়স্বজন এবং শাখা ছাত্রলীগের সাবেক-বর্তমান নেতাকর্মীএর আগে নিজের দায়িত্বকালীন পুরো সময়ে নিয়োগ নিয়ে সমালোচিত ছিলেন সদ্য সাবেক উপাচার্য। এরমধ্যে ২০২২ সালের ৩ মার্চ ফার্সি বিভাগের শিক্ষক নিয়োগ সংক্রান্ত তিনটি অডিও ফাঁস হয়। এতে জড়িত থাকার প্রমাণ মেলে উপাচার্যের ব্যক্তিগত সহকারী (পিএস) খালেদ মিসবাহুল মোকর রবীনের বিরুদ্ধে। কিন্তু শাস্তির বদলে তাকে ‘উপ-পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক’ হিসেবে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছিল। ওই ফাঁস হওয়া অডিওতে বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির পদে ১২ লাখ, চতুর্থ শ্রেণির পদে ৮ লাখ, অফিসার পদে ১৫ লাখ ও শিক্ষক নিয়োগে ১৬ লাখ টাকার বেশি লেনদেন হয়েছে বলে অডিও ক্লিপগুলোতে উঠে আসে। যা তখন আলোচনার জন্ম দেয় সারাদেশে।এছাড়া, ২০২২ সালের ৬ আগস্ট আরও দুটি ফোনালাপ ফাঁস হয়, তাতে দেখা যায় নিম্নমান সহকারী পদের কর্মচারী মানিক চন্দ্র দাস নিজেকে সেকশন অফিসার পরিচয় দিয়ে তিন চাকরি প্রার্থীর কাছ থেকে ৮ লাখ ২০ হাজার টাকা আদায় করেছেন।উপাচার্য শিরীণের শেষ সময়ে নিয়োগের ব্যাপারে তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী সেলের প্রধান সৈয়দ মনোয়ার আলী জাগো নিউজকে বলেন, আমি শুনেছি শেষ দুদিনে প্রায় ৪০ জনের কাছাকাছি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তবে আমি বুধ ও বৃহস্পতিবার অসুস্থতার কারণে অফিসে যাইনি। তাই ঠিক কতজনের যোগদানপত্র এসেছে তা সুনির্দিষ্টভাবে বলতে পারবো না।এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য প্রফেসর ড. নঈম উদ্দিন হাছান আওরঙ্গজেব জাগো নিউজকে বলেন, উপাচার্য বারবার বলতেন আমাদের অসংখ্য লোকের প্রয়োজন। কিন্তু ইউজিসি লোকবল দিচ্ছে না, তাই আমি লোক পাঠাচ্ছি। তখন আমরা ৫৪৫তম সিন্ডিকেটে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম একটি নির্দিষ্ট নিয়মের মাধ্যমে নিয়োগ দিতে। একটি কমিটি করা হয়েছিল, যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব অনুষদে দেখবেন আসলেই কত লোক প্রয়োজন। তাদের রিপোর্টের ভিত্তিতে প্রয়োজন অনুসারে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে নিয়োগ দিতে হবে। কিন্তু তিনি সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্ত না মেনে অপ্রয়োজনীয় নিয়োগ দিয়েছেন।তিনি আরও বলেন, যথাযথ প্রক্রিয়ায় নিয়োগ না হওয়ায় অসংখ্য মানুষ এই সুযোগ গ্রহণ বা আবেদন করা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। পাশাপাশি এখানে সিন্ডিকেটের একটি সিদ্ধান্ত রয়েছে। সেটিও মান্য করা হয়নি। তাই বলা যায় এসব নিয়োগ অপ্রয়োজনীয় এবং প্রশ্নবিদ্ধ।সিন্ডিকেট সদস্য ড. শামীম উদ্দিন বলেন, তিনি (উপাচার্য) সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্ত না মেনে নিজের মনগড়া নিয়োগ দিয়ে গেছেন। সিন্ডিকেটে কমিটি গঠনের ওই তারিখের পর থেকে এ রকম দৈনিকভিত্তিতে যতগুলো নিয়োগ হয়েছে সব অবৈধ।নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেকজন সিন্ডিকেট সদস্য বলেন, দৈনিকভিত্তিতে নিয়োগ হলে এই টাকা দেওয়া হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব তহবিল থেকে। তাই এর আর্থিক খাতের চিত্রটা পরিষ্কার নয়। তবে আমরা বুঝতে পারছি বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনৈতিক অসামঞ্জস্য তৈরি হচ্ছে। আমরা দেখছি ইদানিং শিক্ষকদের বিভিন্ন কাজের পারিতোষিক বন্ধ করে রাখা হচ্ছে অর্থের সংস্থান করতে না পেরে। আসলে এখানে খুবই মারাত্মক একটি বিশৃঙ্খলা ম্যাডাম (সাবেক উপাচার্য) অপ্রত্যাশিতভাবে তৈরি করে গেছেন, যা দুর্ভাগ্যজনক।
যোগ্যতার ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। একজন অযোগ্য ব্যক্তিকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিলে তিনি ৪০ বছর ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষতি করবেন। নিয়োগের ক্ষেত্রে কোনো ছাড় নেই। যে কোনো মূল্যে ভালো শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। অফিসার থেকে শুরু করে যারাই দক্ষ ও যোগ্য তাদের নিতে হবেবিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক আব্দুল হক বলেন, তিনি (উপাচার্য) নিশ্চিত ছিলেন তিনি আর নেই। এ ধরনের পরিস্থিতিতে নিজের ব্যক্তিগত স্বার্থ না থাকলে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থে কেউ আসলে নিয়োগ দেয় না। তিনি উপাচার্যের পদকে ব্যাবহার করে এবং অনেকটা খাটো করে এ নিয়োগগুলো দিয়েছেন।এ বিষয়ে জানতে সদ্য সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক শিরীণ আখতার এবং রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) কে এম নূর আহমদের সঙ্গে বেশ কয়েকবার যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তারা ফোনকল রিসিভ করেননি।
এদিকে এক আলোচনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন উপাচার্য অধ্যাপক ড. আবু তাহের নিয়োগ প্রসঙ্গে বলেছেন, যোগ্যতার ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। একজন অযোগ্য ব্যক্তিকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিলে তিনি ৪০ বছর ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষতি করবেন। নিয়োগের ক্ষেত্রে কোনো ছাড় নেই। যে কোনো মূল্যে ভালো শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। অফিসার থেকে শুরু করে যারাই দক্ষ ও যোগ্য তাদের নিতে হবে। এটি প্রশাসন পরিচালনার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
* সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ সব সংবাদ, ছবি ,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন। ভিজিট করুন : http://www.etihad.news
* অনলাইন নিউজ পোর্টাল ইত্তেহাদ নিউজে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়