মতামত

রক্তে রঞ্জিত মার্চ মাসের গর্বিত অংশীদার

Screenshot 2024 03 26 00 38 55 365 com.android.chrome edit
print news

নেছার আহমদ :

অগ্নিঝরা মাস মার্চ, জাতির অস্তিত্ব রেখা স্বাধীনতার মার্চ। মার্চ অনেক অনেক ইতিহাসের সাক্ষী। মার্চ স্বাধীনতার মাস। মার্চ মাসে তিনটি তারিখ রয়েছে যা বাঙালি জাতির জীবনে ধ্রুবতারার মতো জ্বল জ্বল করে জ্বলছে। আলো ছড়াচ্ছে, পথ দেখাচ্ছে, বাংলাদেশ এবং বাঙালি জাতি সেই আলোর পথ ধরে সামনের পথে এগিয়ে চলেছে। তিনটি আলোকজ্জ্বোল ইতিহাসের অন্যতম হলো ৭ই মার্চ। এ দিন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উত্তাল রেসকোর্সের লাখো জনতার সামনে ঘোষণা করেছিলেন জাতির ম্যাগনাকাটা মুক্তির সনদ। তিনি বজ্রকন্ঠে ঘোষণা করেছিলেন ‘প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ করে তোল, তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে। … এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, জয় বাংলা।’ ৭ই মার্চের ভাষণে সমগ্র বাঙালি জাতিকে নজিরবিহীনভাবে ঐক্যবদ্ধ এবং স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করেছিলেন। এ ভাষণ ‘বিশ্ব–ঐতিহ্য সম্পদ’ হিসেবে স্বীকৃত।

জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো প্যারিসে অনুষ্ঠিত ‘দ্বি–বার্ষিক সম্মেলনে ৩০শে অক্টোবর ২০১৭ ইং তারিখে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণকে ‘বিশ্ব–ঐতিহ্য দলিল’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে তা সংস্থাটির ‘ইন্টারন্যাশনাল মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড রেজিস্টার’ এ অন্তর্ভুক্ত করেছে। সুতরাং ৭ই মার্চ আমাদের জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ।

অপরটি ১৭ই মার্চ, বাংলাদেশের স্থপতি, জাতির পিতা হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে যখন গোটা উপমহাদেশ উপনিবেশবাদের শৃঙ্খলে আবদ্ধ, শোষণের বিরুদ্ধে বিক্ষুদ্ধ জনগণ, জেল–জুলুম, হুলিয়া, নির্যাতন ছিল অন্তহীন, বস্ত্রহীন, স্বাস্থ্যহীন মানুষের নিত্যসঙ্গী। ঠিক এমনই এক প্রতিকুল পরিবেশে গোপালগঞ্জের বাইগার নদীর তীর ঘেঁষে ছবির মতো সাজানো নিভৃত গ্রাম টুঙ্গিপাড়ায় এক শিশুর জন্ম হয়। সংগ্রাম ও স্বাধীনতা তাঁর এতটাই প্রিয় ছিল যে, এই দুয়ের পেছনেই কাটিয়েছেন জীবনের পঁচিশটি বছর। নির্ভীক, নিপীড়িত মানুষের মুক্তির অনুপ্রেরণা, নিংশঙ্কচিত্তে দেদিপ্যমান এক কিংবদন্তি তিনি। রাজনীতির মাঠ থেকে জেল, জেল থেকে রাজনীতির মাঠ– এই ছিল তাঁর জীবন। তিনি নিজে বলতেন, ‘জেল আমার আরো একটি বাড়ি।’

বিশ্ববিদ্যালয় কর্মচারীদের ধর্মঘটকে সমর্থন ও সক্রিয়য় অংশগ্রহণের দায়ে জেল। মুক্তির পরই জানলেন বিশ্ববিদ্যালয়ে আর তাঁর ছাত্রত্ব নেই। সেদিন থেকেই পুরোপুরি শুরু তাঁর ঝঞ্ঝাপূর্ণ রাজনৈতিক জীবন। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫২, ৫৪, ৬৬ কিংবা ৬৯–৭০ এবং ৭১ প্রতিটি আন্দোলন–সংগ্রামেই তাঁর অবদান প্রশ্নাতীত। ৫৫ বছরের জীবনে ১৮ বার কারাভ্যন্তরে কাটাতে হয়েছে তাঁকে। দিন–বছর হিসাব করলে হয় ৪ হাজার ৬৮২ দিন এবং ১২ বছরেরও বেশি সময়।

তিনি বাঙালির হাজার বছরের ধন্য পুরুষ, কোটি কোটি মানুষের জীবন্ত স্মৃতির মিনার, তিনি হলেন শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি জন্মেছিলেন বলেই আজ আমরা স্বাধীন। বঙ্গবন্ধু জীবনের প্রতিটি ধাপেই বাঙালির সার্বিক মুক্তির জয়গান গেয়েছেন। যে স্বাধীন বাঙলার স্বপ্ন তিনি দেখেছিলেন, যে বাংলার জন্য তিনি যৌবনের অধিকাংশ সময় কাটিয়েছেন কারাগারে। ফাঁসির মঞ্চে গেয়েছেন বাঙালির জয়গান। তিনি ৭২ এর ১০ই জানুয়ারি স্বদেশে ফিরে ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে সর্ববৃহৎ জনসমুদ্রে হৃদয়ের অর্ঘ্য ঢেলে আবেগমথিত ভাষায় বলেছিলেন, ‘ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার সময় বলবো, আমি বাঙালি, বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা।’

সেই বাংলা ও বাঙালির জন্য তাঁর ভালোবাসা ছিল অপরিসীম। সমুদ্র বা মহাসমুদ্রের গভীরতা পরিমাপ করা সম্ভব; কিন্তু বাংলা ও বাঙালির জন্য বঙ্গবন্ধুর হৃদয়ের যে দরদ; যে ভালোবাসা তাঁর গভীরতা অপরিমেয়। বাংলার ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক মহাকাব্য। বাংলাদেশ সৃষ্টির ইতিহাসের ঘটনা সমষ্টির সার সংক্ষেপেই হলো তাঁর জীবনী। বাংলার ইতিহাসে তিনি উজ্জ্বল নক্ষত্র। বিশ্বের মানচিত্রে আমরা যে বাংলাদেশকে দেখছি সেই বাংলাদেশের রূপকার স্থপতি তিনি। প্রকারন্তরে তিনিই বাংলাদেশ। সুতরাং ১৭ই মার্চ আমাদের জাতীয় জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ।

তৃতীয় দিনটি হলো ২৬শে মার্চ। আমাদের গৌরবোজ্জ্বল স্বাধীনতা দিবস। ১৯৭১ এর ২৬শে মার্চ, আমাদের অনেকদিনের স্বাধীনতা সংগ্রামের চুড়ান্ত মুহূর্ত। ১৯৭১ এর ২৫শে মার্চ কালো রাতে হঠাৎ করে হামলা শুরু করে বর্বর পাকিস্তানি বাহিনী। বাংলা মানুষ যখন সারাদিনের কাজ শেষে ক্লান্ত–শ্রান্ত এবং নিশ্চিন্তে ঘুমে বিভোর ঠিক সেই মুহূর্তে নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর বন্দুক, মেশিনগান ও ট্যাংক সহ আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। কাপুরুষের মতো আক্রমণ করে তারা নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালায়। রাজারবাগ পুলিশ ক্যাম্প, ঢাকা–চট্টগ্রামসহ সারাদেশে অপারেশন সার্চ লাইট নামে গণহত্যা শুরু করে। চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট সহ সমগ্র বাংলাদেশে সে রাত্রে পাকিস্তানি হানাদাররা হাজার হাজার বাঙালিকে হত্যা করে। ২৫শে মার্চ এর শেষ প্রহর মধ্যরাত ১টা–২০ মিনিটে হানাদার পাকিস্তানি সেনারা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তাঁর ধানমণ্ডির বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারের পূর্ব মুহূর্তে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলার স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণার বার্তা ওয়ারলেসে চট্টগ্রামে তাঁর বন্ধু ও দীর্ঘদিনের সহকর্মী, চট্টগ্রাম শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি, প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য জহুর আহমদ চৌধুরীর নিকট প্রেরণ করেন। স্বাধীনতার ঘোষণাটি তাঁর পারিবারিক সংগ্রহশালায় সংরক্ষিত আছে। ২৬শে মার্চ সকালে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাটি ছোট্ট কাগজে সাইক্লোস্টাইল মেশিনে ছাপিয়ে বিলি করা হয়। ২৬শে মার্চ চট্টগ্রাম বেতার (স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র) থেকে আওয়ামী লীগ নেতা এম.এ হান্নান বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার বাণী স্বকণ্ঠে প্রচার করেন। শুরু হল রক্তাক্ত স্বাধীনতা সংগ্রাম।

মার্চ মাস আমার পারিবারিক জীবনের করুণ ও গর্বিত একটি অংশ। আমার ভাই পটিয়ার আশিয়ার গ্রামের মাহবুব আহমদ চৌধুরী ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের নতুন রিক্রুটকৃত সৈনিক। সবেমাত্র ট্রেনিং শেষ করেছে এবং চট্টগ্রামের নতুন পাড়া ক্যান্টেনমেন্টে ব্যারাকে থাকে। ২৫শে মার্চ রাত প্রায় ১১.৩০ মিঃ দিকে ২০ বালুচ রেজিমেন্টের সেনারা তাদের ব্যারাক হতে বের হয়ে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট সেন্টারের ব্যারাকে ঘুমন্ত বাঙালি সেনাদের অতর্কিত আক্রমণ করে। প্রথমেই তারা অস্ত্রাগার দখল করে এবং সেখানে ডিউটিরত বাঙালিদের হত্যা করে। সকল ঘুমন্ত বাঙালি সৈন্যকে ঘুমন্ত অবস্থায় নৃশংসভাবে হত্যা করে এবং অস্ত্রগার দখল করে ভীবৎস উম্মদনায় তারা মেতে উঠে। এরপর তারা বাঙালিদের ফ্যামিলি কোয়ার্টারে হামলা চালায়। সেখানে তারা নাগালের মধ্যে যাকেই পেয়েছে তাকেই হত্যা করে। এ হত্যাযজ্ঞ হতে যেসব বাঙালি সেনা প্রাণে বেঁচে পালিয়ে আসতে পেরেছে তারা মেজর জিয়ার নেতৃত্বে থাকা ৮ম বেঙ্গলের সৈন্যদেরকে ক্যান্টেনমেন্টে আক্রান্ত সেনাদের এবং সেনা পরিবারের বাচানোর জন্য আকুতি জানায়। মেজর জিয়া সে সময় কোন কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি। সে সময়ে অভাগা হতভাগ্য ৮ম ইস্ট বেঙ্গলের সৈনিকদের একজন ছিলেন আমার ভাই মাহবুব আহমদ। সে রাতে ক্যান্টেনমেন্ট হতে পাকিস্তানি হত্যাযজ্ঞ হতে বেঁচে আসা ক্যাপ্টেন এনাম বর্ণনা করেন। ‘রাত সাড়ে এগারোটার দিকে ২০ বালুচের সৈন্যরা হঠাৎ করে ইবিআরসি দখল করে বাঙালি সব গার্ডকে মেরে ফেলে। ঐ একই সময়ে ২০ বালুচের সৈন্যরা বাঙালি সৈন্যদের ব্যারাক সমূহে এবং তাদের পরিবার পরিজনদের ফ্যামিলি কোয়ার্টার সমুহে আক্রমণ চালায়। ঘটনার আকস্মিকতায় হতচকিত দিশেহারা বাঙালি সৈন্য ও তাদের পরিবার পরিজন আতঙ্কে এদিক ওদিক পালাতে শুরু করে। কিন্তু তাদের অনেককেই পাকিস্তানিরা যেখানে পেয়েছে পাখি শিকারের ন্যায় গুলি করে হত্যা করেছে। এক হাজারের বেশি বাঙালি সৈন্যকে তারা হত্যা করে। সৈন্যদের পরিবার পরিজন, মহিলা শিশু সহ কত জনকে যে তারা নির্বিচারে মেরে ফেলেছে তার কোনো হিসেব নেই। কয়েকশত তো হবেই।”

সে সময়ে সেখানে ৮ম ইস্ট বেঙ্গলের সৈনিক হিসেবে কর্তব্যরত মাহবুব আহমদ চৌধুরী শহীদ হন। বয়সের বা কালের সীমাবদ্ধতার কারণে আমি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে পারিনি। কিন্তু আমার ভাই স্বাধীনতা যুদ্ধের মহান শহীদ স্বাধীন বাংলার লাল সবুজের পতাকায় রয়েছে আমার রক্তের অংশিদারিত্ব। এটাই আমার অহংকার। আমি বাংলার ইতিহাসের গর্বিত অংশীদার। এ অহংকার নিয়ে আমার বেঁচে থাকা। স্বাভাবিকভাবে প্রতি বছর মার্চ মাস আমার জন্য আমার পরিবারের জন্য অন্যরকম এক অনুভূতির নাম।

আমরা যারা এবং আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম কালের সীমাবদ্ধতার কারণে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে পারিনি, তাদের জন্য আরও বড় আরেকটি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের সম্ভাবনা অবারিত রয়েছে। আমার বিশ্বাস, যেদিন এদেশের প্রতিটি মানুষের অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাসস্থান সুনিশ্চিত হবে, সবাই মন–প্রাণ খুলে বলবে, ‘আমি ভালো আছি, সুখ–শান্তিতে বসবাস করছি’ সেদিন বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ বিনির্মাণ সার্থক ও অর্থবহ হবে, এ লক্ষ্যকে সামনে রেখে বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কাজ করে যাচ্ছেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, স্বাধীনতার অঙ্গীকারকে সমুন্নত রেখে সর্বোচ্চ সততা, নিষ্ঠা, আন্তরিকতা ও দেশপ্রেমের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে শহীদদের রক্তদান যাতে বৃথা না যায় সে লক্ষ্য নিয়ে কাজ করতে হবে। সে লক্ষ্যে একটি অসাম্প্রদায়িক শক্তিশালী অর্থনীতির সুখী সমৃদ্ধ বাংলাদেশের প্রত্যাশায় স্বাধীনতা দিবসের এদিনটিকে স্বাধীনতার সকল শহীদদের শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি।

লেখক: প্রাবন্ধিক, সম্পাদক– শিল্পশৈলী।

 

* সর্বশেষ  গুরুত্বপূর্ণ  সব  সংবাদ, ছবি ,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন লেখা পেতে আমাদের  ফেসবুক পেইজে  লাইক  দিয়ে  অ্যাকটিভ  থাকুন।  ভিজিট করুন : http://www.etihad.news

* অনলাইন  নিউজ পোর্টাল  ইত্তেহাদ নিউজে  লিখতে  পারেন  আপনিও। লেখার বিষয়  ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন  [email protected] ঠিকানায়

সংবাদটি শেয়ার করুন....
ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক :

ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক :

About Author

etihad news is one of the famous Bangla news portals published from Abudhabi-UAE. It has begun with a commitment to fearless, investigative, informative, and independent journalism. This online portal has started to provide real-time news updates with maximum use of Smart Technology.

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *