ইত্তেহাদ এক্সক্লুসিভ

টাকা কিংবা ক্ষমতা না থাকলে মিলে না সেবা

5ca4a8b2c38cb4a30ea9cf3c7d4b1fbe 65f3461a6eff5
print news

আবুল খায়ের: দেশে পুলিশের যেমন সুনাম আছে, তেমনি দুর্নামও আছে। সুনামের ধারা ধরে রাখতে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের আন্তরিকতার কোনো কমতি নেই। তবে থানার চিত্র উলটো। সেখানে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে সুনামের চেয়ে দুর্নামই বেশি। টাকা নয়তো ক্ষমতা, এই দুটির একটি না থাকলে মিলছে না সেবা। অধিকাংশ থানায় জিডি করতে গেলেই টাকা লাগে। মামলার বাদী-বিবাদী উভয়ের কাছ থেকেই টাকা নেওয়া হয়। তদন্তের নামে চলছে অর্থ উপার্জন। টাকা ছাড়া অধিকাংশ থানায় তো সেবা মেলেই না, উপরন্তু পুলিশের দ্বারা প্রায়শই হয়রানির শিকার হচ্ছে সাধারণ মানুষ। পুলিশের এই অবস্থা শুধু এই সরকারের আমলে নয়, বিএনপি-জামায়াত চার দলীয় জোট সরকারের আমলেও একই চিত্র ছিল। তখনো রাজনৈতিক নেতাদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার হয়েছিল পুলিশ। এখন পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে গেছে। প্রকাশ্যে রাজনৈতিক নেতার হয়ে কাজ করছে থানা পর্যায়ের পুলিশ। এমনকি নিরীহ-অসহায় মানুষের জায়গা-জমি দখলও করছে। টাকার বিনিময়ে মানুষকে হয়রানি করার ঘটনা প্রায় ঘটছে। নিরীহ মানুষ থানায় গেলে পাত্তা পায় না। অথচ টাকাওয়ালারা কিংবা ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতা থানায় গেলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করে। তখন আসামি দোষী কিনা তা তদন্তের আগেই গ্রেফতার করতে তৎপর হয়ে পড়ে। থানা মানে টাকা ছাড়া কোন কাজ হয় না-এটা মানুষের মনে গেথে গেছে। টাকার মাধ্যমে তদন্ত উল্টে যায়। যারা আসামি তারা টাকা দেয়, আর ছাড়া পায়। এভাবে অনেক অপরাধী ছাড়া পাচ্ছে।

বর্তমানে সারাদেশে প্রতি পাড়া-মহল্লায় কিশোর-গ্যাং হয়েছে। তারা ছিনতাই, চাঁদাবাজি, খুন-খারাবি করছে। কেউ ঘরবাড়ি করলে কিংবা জমি কিনলে কিশোর গ্যাংদের চাঁদা দিতে হয়। স্থানীয় এক শ্রেণীর রাজনৈতিক নেতা, ইউপি চেয়ারম্যান, মেম্বারসহ এক শ্রেণীর জনপ্রতিনিধিরা তাদের পৃষ্ঠপোষক। গ্রাম পর্যায়ে সন্ত্রাসী কার্যক্রম বর্তমানে ভয়াবহ রূপ নিয়েছ। অধিকাংশ থানা বসে বসে শুধু ঘুষ নেয়। একেকটি এসআইকে একেকটি ইউনিয়নের দায়িত্ব দেওয়া হয় আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি মনিটরিং করার জন্য। তারা মূলত টোল কালেকটর হিসেবে এখন ভূমিকা পালন করে। অর্থাৎ তাকে ওই ইউনিয়নের মাদক ব্যবসায়ী, চাঁদাবাজ ও বিভিন্ন অপরাধীরা তাকে নিয়মিত চাঁদা দেয়। আবার অনেক থানাও আছে ভালো। যেখানে মানুষ কাঙ্ক্ষিত সেবা পাচ্ছে ঘুষ প্রদান ছাড়াই। তবে বেশিরভাগ থানায় সেবা মেলে না। অথচ এই পুলিশরাই দেশ ও জাতির যেকোন ক্লান্তিকালে দিনরাত ২৪ ঘণ্টা মানুষের পাশে থাকেন। পুলিশের অনেক কার্যক্রম প্রশংসাও কুড়াচ্ছে। করোনার সময় সম্মুখযোদ্ধা হিসেবে বাংলাদেশের পুলিশ সদস্যদের ভূমিকা সারা দেশে বেশ প্রশংসিত হয়েছে। প্রসূতিকে হাসপাতালে পৌঁছে দিয়েছে পুলিশ। করোনায় মৃত রোগীকে দাফন করায় পুলিশ। যাদের রক্তের প্রয়োজন হয়েছিল, রক্তও দিয়েছিল পুলিশ। এই দুর্যোগকালে বাংলাদেশ পুলিশ মানবিকতার যে উদাহরণ সৃষ্টি করেছে, তা সত্যিই বিস্ময়কর এবং অনুপ্রেরণাদায়ীও।

একজন ওসির পোস্টিং নিতে গেলে মোটা অঙ্কের টাকা লাগে। সেই টাকা উঠাতে ঘুষ ছাড়া উপায় নেই। বাদি-বিবাদি উভয়ের কাছ থেকে তারা টাকা নেয়। জমি নিয়ে সালাশি কাজ করার বিধান নেই, তারপরও সেই কাজ করে টাকা দিচ্ছে পুলিশ। মামলা হওয়া মানে খেজুর গাছ। আদালতে মামলা করলে তা নিস্পত্তি করতে যেমন দীর্ঘদিন লাগে। একই সময় লাগছে থানায়। সম্প্রতি তুরাগ থানার এক এসআইয়ের ঘুষ কেলেঙ্কারি ধরা পড়ে। তার ছিল নিজস্ব আদালত। সেই আদালতে যে কত কিস্তিতে ঘুষের টাকা দিবে সেটা নির্ধারণ হতো। এক ফ্রিল্যান্সারকে তুলে এনে তিন কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনায় গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) ছয় সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি)। সিএমপি কমিশনার কৃষ্ণপদ রায় এক আদেশে বরখাস্তের পাশাপাশি তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করারও নির্দেশ দিয়েছেন।

অপরাধের কারণে প্রতি বছরের আড়াই থেকে তিন হাজারের পুলিশের চাকরি চলে যায়। অপরাধ করে পার পাওয়ার সুযোগ নেই। তারপরও পুলিশে অপরাধ বাড়ছে। এলাকার মাদক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে মাস শেষে নির্ধারিত হারে টাকা পায় পুলিশ। প্রতিটি ওয়ার্ডে মাদক বেচাকেনা হচ্ছে। কিন্তু নিয়ন্ত্রণের কোন বালাই নেই। মাদকের কারণে উঠতি বয়সীরা কিশোর গ্যাংয়ে জড়িয়ে পড়ছে। এ কারণে অপরাধ বাড়ছে ভয়াবহ। এটা নিয়ে গ্রামের মানুষ এখন ভীত-সন্ত্রাস্ত। তারা বলেন, এক সময় পুলিশ দেখেছি, সেই পুলিশ এটা নয়। পুলিশ মামলা নেয় না, টাকা নেয়, আসামি ধরে ছেড়ে দেয়। এমন অভিযোগ ইত্তেফাকে প্রতিনিয়ত আসছে। এর নেপথ্যে কারণ হলো, এক শ্রেণীর এমপি-মন্ত্রী ও রাজনৈতিক নেতারা তদ্বির করে নিজ থানায় ওসি নিয়ে যান। এ কারণে তারা ওই নেতার বাইরে যায় না। নেতা যা বলে তাই শোনে। দুই থেকে তিন বছরের বেশি থানায় থাকতে পারে না ওসিরা। এই সময়ের মধ্যে মোটা অঙ্কের ঘুষ দিয়ে থানায় আসায় ওই টাকা তাদের তুলতে হবে। জেলার সকল থানার মনিটরিংয়ের দায়িত্বে রয়েছেন এসপি। তবে বেশিরভাগ এসপি মনিটরিং করেন না। এসপি ওসির বাইরে যেতে পারে না, কারণ ওসিরা প্রতি মাসে অধিকাংশ এসপিকে নিয়মিত টাকার প্যাকেট দিয়ে থাকেন। রেঞ্জের অধিকাংশ ডিআইজি সঠিকভাবে মনিটরিং, সুপারভিশন ও কাউন্সিলিং করেন না। তারা যদি কোন ব্যত্যয় ঘটলে দ্রুত ব্যবস্থা নিতেন তাহলে মাঠ পর্যায়ে এমন ভয়াবহ চিত্র থাকতো না।

ওসির ওপরে দুই থানার সার্কেলে একজন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার থাকেন। তার ওপরে পুলিশ সুপার। এসপির সঙ্গে এক জন কিংবা দুই জন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার থাকেন। এসপির ওপরে থাকেন সাত-আটটি জেলা মিলে রেঞ্জের একজন ডিআইজি। এর সঙ্গে কয়েক জন অতিরিক্ত ডিআইজি থাকেন। ডিআইজি ও এসপিরা যদি সঠিকভাবে মনিটরিং করেন, তাহলে থানার পুলিশ দিয়ে মানুষের হয়রানি থাকবে না। অর্থাৎ সব কিছু সুন্দর সিস্টেম রয়েছে। কিন্তু সিস্টেমগুলো কাজ করে না। এ কারণে থানায় গেলেই হয়রানি। ন্যায় বিচার থেকে বঞ্চিত। ঘুষ খেয়ে চার্জশিট দেয় দুর্বল। অবশ্য একেক জন এসপি পদে পোস্টিং নিতে অনেক টাকা লাগে। যার কারণে দুই তিন বছরের মধ্যে সেই টাকা উঠানোয় ব্যস্ত থাকে তারা। যেখানে টাকা দিয়ে পদ বাগিয়ে নিতে হয় কিংবা অনেক বড় তদবির করে পদ নিতে হয়, সেখানে তো আর ভালো সার্ভিস আশা করা যায় না। পোস্টিং নিয়ন্ত্রণ করে একটি বড় সিন্ডিকেট। তারা কোটি কোটি টাকার বাণিজ্য করছে। যোগ্য, সততা, জ্যেষ্ঠতার মূল্যায়ন হয় না। সরকার ব্যাপক উন্নয়ন করেছে, কিন্তু এই সিন্ডিকেটের কারণে মানুষ পুলিশ থেকে কাঙ্ক্ষিত সেবা পাচ্ছে না। পুলিশের সুযোগ-সুবিধা ও যানবাহন চাহিদার তুলনায় সীমিত। তবে যা দিয়েছে, তাই দিয়ে সেবা দেওয়া সম্ভব। তারপরও বর্তমান সরকার পুলিশের মান উন্নয়নে অনেক করছেন।

পুলিশের আইজি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন বলেন, অপরাধ করে পার পাওয়ার সুযোগ নেই। যারা অপরাধ করবে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে এবং নিচ্ছি। সেইভাবে মনিটরিং করছি। যাতে মানুষ সুন্দর সেবা পায়, সেটা । কিন্তু এর মধ্যে কোন ব্যত্যয় ঘটলে কোন ছাড় নেই।

সাবেক আইজিপি নূর মোহাম্মদ বলেন, মানুষ কার কাছে যাবে, যদি সেবা না পায়। সেবা পাওয়া তার নাগরিক অধিকার। কিন্তু সেবা না পাওয়া দুঃখজনক। রাষ্ট্র যদি সঠিকভাবে এটা মনিটরিং করে তাহলে জনগণ সেবা পেতে বাধ্য। মনে হচ্ছে যেন নৈতিক মূল্যবোধ হারিয়ে যাচ্ছে। শুধু পুলিশে নয়, অন্যান্য প্রশাসনেও এটা ঘটছে। শ্যান, সাওকত ও জৌলুসে পড়েছে, এর থেকে বের হয়ে আসতে হবে। পুলিশের মধ্যে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে সাধারণ মানুষকে তারা তোয়াক্কা করছে না। এটা সব সরকারের আমলে হচ্ছে। এ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। শীর্ষ কর্মকর্তার কোমড়ে জোর না থাকলে তার প্রভাব মাঠ পর্যায়ে পড়বে। আমি ওমুককে ধরলাম, স্যার কি মনে করলো-এই মনোভাব পরিবর্তন করতে হবে। যেটা সঠিক সেটা করতে হবে। সঠিক তদন্ত নিশ্চিত করতে পারলে সাধারণ মানুষ ন্যায়বিচার পাবে।

সাবেক আইজিপি শহীদুল হক বলেন, সুপারভিশন, মনিটরিং ও কাউন্সিলিং সঠিকভাবে পালন করতে হবে। এরমধ্যে কোন ঘাটতি থাকলে থানা পর্যায়ে মানুষ সেবা পেতে গিয়ে হয়রানি হতে পারে। তবে পুলিশে অপরাধ করে পার পাওয়ার সুযোগ নেই। এখন শিক্ষিত ছেলে-মেয়েরা পুলিশে নিচ্ছি। আগে অষ্টম শ্রেনী পাশ নেওয়া হতে, এখন এটা হয় না। তবে পুলিশে অপরাধ বাড়া-এটা দুঃখজনক। মানবিক হিসেবে সবাইকে সেবা করতে হবে। নিজের বাবা-মা সেবা করার মতো মানসিকতায় জনগণকে সেবা দেওয়া উচিত।

রাজধানীতে বেশিরভাগ ওসি দীর্ঘদিন ধরে আছে। এখানে পোস্টিং নিতে মোটা অঙ্কের টাকা লাগে, পাশাপাশি লাগে তদবির। রাজধানীসহ বিভিন্ন মেট্রোপলিন থানার অবস্থা অনুরূপ। শিক্ষিতের হার বেশি, শীর্ষ প্রশাসনসহ সব অফিস এখানে। এখানে থানায় হয়রানির শিকার হওয়া সত্যিই দুঃখজনক। তবে ভালো পুলিশ কর্মকর্তার উদাহরণও রয়েছে। ইতিমধ্যে লালবাগ জোনে একজন ডিসি গেছে, যিনি সৎ অফিসার হিসেবে প্রশংসা কুড়িয়েছেন। লালবাগ থানা এলাকায় সহস্রাধিক ফুটপাতের দোকান রয়েছে। আগে ফুটপাতের প্রতিটি দোকান থেকে প্রতিদিন ৫০০ টাকা করে নিতো পুলিশ। তবে এখন আর নেওয়া হয় না। ফুটপাতের ব্যবসায়ীরা বলেন, নতুন স্যার ঘুষ নেন না। এই স্যার খুব ভালো মানুষ। তাদের মনে এই ধারণা।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার হাবিবুর রহমান বলেন, ঢাকা রেঞ্জে থাকাবস্থায় ঢাকা বিভাগের সব থানাকে নিয়মিত মনিটর করতাম একটা রুম থেকে। একই সিস্টেম রাজধানী ঢাকার থানাগুলোকে নিয়মিত মনিটরিংয়ের আওতায় নিয়ে আসবো। মানুষ থানায় গিয়ে সেবা পায় কিনা সেটা সরাসরি দেখতে পারবো। জিডি করলে সঙ্গে সঙ্গে একটা কপি আমার কাছে পাঠাতে হবে। মামলাটা সঠিকভাবে নেওয়া হয়েছে কিনা দেখা হবে। চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি) কমিশনার কৃঞ্চপদ রায় বলেন, পুলিশে অপরাধ দুঃখজনক ঘটনা। এটা কোনভাবে কাম্য নয়। তবে অপরাধ করলে ছাড় পাওয়ার সুযেগা নেই। এক ফ্রিল্যান্সারকে তুলে এনে তিন কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনায় ছয় পুলিশ সদস্যকে সাসপেন্ড করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে মামলা নিয়েছি। ইত্তেফাক

 

* সর্বশেষ  গুরুত্বপূর্ণ  সব  সংবাদ, ছবি ,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন লেখা পেতে আমাদের  ফেসবুক পেইজে  লাইক  দিয়ে  অ্যাকটিভ  থাকুন।  ভিজিট করুন : http://www.etihad.news

* অনলাইন  নিউজ পোর্টাল  ইত্তেহাদ নিউজে  লিখতে  পারেন  আপনিও। লেখার বিষয়  ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন  [email protected] ঠিকানায়

সংবাদটি শেয়ার করুন....
ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক :

ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক :

About Author

etihad news is one of the famous Bangla news portals published from Abudhabi-UAE. It has begun with a commitment to fearless, investigative, informative, and independent journalism. This online portal has started to provide real-time news updates with maximum use of Smart Technology.

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *