দিনাজপুরে সড়ক প্রশস্তকরণে ৩৪৩ গাছের মৃত্যু, জনমনে ক্ষোভ


ইত্তেহাদ নিউজ,দিনাজপুর : দাবদাহে পুড়ছে উত্তরের জেলা দিনাজপুর। ৩৯ থেকে ৪১ ডিগ্রির মধ্যে ওঠানামা করছে তাপমাত্রার পারদ। এদিকে সড়ক প্রশস্ত করার নামে নির্বিচারে কেটে ফেলা হচ্ছে শত শত গাছ। রাস্তায় ছায়াশীতল পরিবেশ সৃষ্টির পাশাপাশি পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় ভূমিকা পালনকারী এসব বৃক্ষ নির্বিচারে নিধনে ক্ষোভ জানিয়েছেন এলাকাবাসী। তবে দিনাজপুর জেলা পরিষদের প্রতিনিধিরা বলছেন সড়ক প্রশস্ত করতে সরকারি নিয়ম মেনেই এসব গাছ কাটা হচ্ছে।
জানা গেছে, ১৯৯০ সালে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের রাস্তার পাশে জেলা পরিষদ বোচাগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন সড়কের পাশে মেহগনি, বকাইল, পাকুড়, কদম, কৃষ্ণচূড়া, কাঁঠাল, আম, কামরাঙাসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছের চারা রোপণ করেছিল। সেই সড়কগুলো প্রশস্তকরণের কাজ শুরু করে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর। কিন্তু রাস্তা প্রশস্তকরণে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩৫ বছর বয়সী গাছগুলো। গত ৪ ফেব্রুয়ারি জেলা পরিষদ বোচাগঞ্জ উপজেলার পুলেরহাট বাজার, মাধবপুর, ডাকবাংলা অডিটোরিয়াম মোড়, জালগাঁও, বকুলতলা এলাকায় সাতটি লটে ২৯৮টি গাছ বিক্রির ইজারা প্রদান করে। আর গত ১৬ এপ্রিল গাছ কাটার কার্যাদেশ প্রদান করে।স্থানীয় বাসিন্দা শফিকুল ইসলাম বলেন, রাস্তা প্রশস্ত করতে গিয়ে যে গাছ সীমানার মধ্যে পড়বে সেটা কাটুক। কিন্তু রাস্তা থেকে অনেক দূরের গাছগুলো কেন কাটা হচ্ছে? আমরা তাদের বাধা দিলে কোনো কথা শুনে না। তারা তো গাছ কেটে এলাকাকে মরুভূমি বানায় দিচ্ছে। রাস্তার গাছ কাটে কিন্তু নতুন করে রোপণ করে না। দিনাজপুরে অনেক রাস্তা বড় করতে গিয়ে গাছ কাটছে। নতুন করে রাস্তা তৈরি হওয়ার পর বছরের পর বছর পার হলে আর গাছ রোপণ করা হয় না।পথচারী রবিন রায় বলেন, গরমের পর যদি গাছগুলো কাটা হত তাহলে কি তাদের অনেক বড় ক্ষতি হত? কিন্তু তারা এই গরমের মধ্যে গাছগুলো কেটে সাবাড় করে দিল। রাস্তায় গাছগুলোর ছায়া থাকত, দেখতেও সুন্দর লাগে। কিন্তু রাস্তা বড় করতে গিয়ে যে গাছগুলো কাটার দরকার নেই সেগুলোও কেটে নিচ্ছে।বোচাগঞ্জ উপজেলার সমাজকর্মী মাহবুব আলম বলেন, দিনাজপুর-সেতাবগঞ্জ সড়কে প্রায় ৫০ বছর আগে লাগানো শত শত গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে। সড়ক প্রশস্ত করা হোক তাতে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। রাস্তা প্রশস্ত করা হবে দু’দিকে তিন ফুট করে। কিন্তু রাস্তা থেকে ১০ ফুট দূরের গাছগুলোও কেটে ফেলা হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, চলমান তাপপ্রবাহ ও প্রকৃতির যে অবস্থা, এই অবস্থায় গাছগুলো নির্বিচারে কেটে ফেলে আরও একটি দুরবস্থার সৃষ্টি করছে দিনাজপুর জেলা পরিষদ। অবিলম্বে গাছ কাটা বন্ধ করে পরিবেশ রক্ষার দাবি জানাচ্ছি।ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স আনোয়ার এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী আনোয়ার হোসেন বলেন, জেলা পরিষদ থেকে টেন্ডারের মাধ্যমে গাছগুলো কিনে নেওয়া হয়েছে। জেলা পরিষদের কর্মকর্তার তদারকিতে কার্যাদেশ মোতাবেক গাছগুলো কাটা হচ্ছে।দিনাজপুর সড়ক ও জনপথ বিভাগের উপ-সহকারী প্রকৌশলী রইসউদ্দীন জানান, দিনাজপুর-সেতাবগঞ্জ সড়কে আটটি বাজারে সড়ক সম্প্রসারণ করা হচ্ছে। এই সড়কটির প্রশস্ত রয়েছে ১৮ ফুট। আর বাজারগুলোতে এই সড়কের প্রশস্ত করা হবে ২৪ ফুট। তাই আটটি বাজারের সড়কের দুপাশে তিন ফুট করে মোট ছয় ফুট প্রশস্ত করা হবে।দিনাজপুর জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোকলেসুর রহমান বলেন, আমি যোগদানের আগে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর থেকে একটি রিকুইজেশন এসেছিল। রাস্তার উন্নয়নে কাজ করা হবে, তাই এই গাছগুলো সরিয়ে দেন। সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের রিকুইজেশন মোতাবেক বন বিভাগ থেকে মূল্য সংগ্রহ, জেলা প্রশাসক কার্যালয় এবং বিভাগীয় কমিশনার অফিসে অনুমোদন করা হয়েছে। এরপর আমরা টেন্ডার দিয়েছি। কিন্তু আমার কাছে অভিযোগ আসছে যে- কিছু গাছ আছে রাস্তা থেকে অনেক দূরে সেগুলোও কাটা হয়েছে। এ বিষয়ে আমি ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে কথা বলেছি। কিন্তু তারা আমাকে কোনো সঠিক উত্তর দিতে পারেনি। একটি গাছ বড় করতে অনেক সময় লাগে। কিন্তু এভাবে গাছ কাটায় আমি অবাক হয়েছি। আমি বিষয়টি নিয়ে মিটিংয়ে কথা বলেছি। ভবিষ্যতে রাস্তা থেকে দূরের গাছগুলো যেন না কাটা হয়।
সড়কগুলোর বাজার এলাকা ও আশপাশের রাস্তা প্রশস্তকরণের জন্য গাছগুলো কাটার জন্য চিঠি দেয় সওজ। চিঠি অনুযায়ী, গত ৪ ফেব্রুয়ারি জেলা পরিষদ বোচাগঞ্জ উপজেলার জালগাঁও মোড় থেকে ডাকবাংলো অডিটরিয়াম মোড় পর্যন্ত ১৪টি আম, ১৮টি কাঠাল, ৮৭টি মেহগনি, ১৪টি কৃষ্ণচূড়া, ৫টি কড়াই, ৪টি রেইনট্রি, ২টি বট, একটি পাকুড়সহ বিভিন্ন প্রজাতির ১৮৮টি গাছ, পুলেরহাট বাজার এলাকায় ১৭টি আম, ৪টি জাম, ৫টি কাঁঠাল, ৭টি মেহগনি, ৯টি জারুলসহ বিভিন্ন প্রজাতির ৫৬টি গাছ, মাধবপুর বাজার এলাকায় ফলজসহ বিভিন্ন প্রজাতির ৩২টি, এবং বকুলতলা বাজার এলাকায় ২৩টি গাছ মিলে ২৯৯টি গাছ বিক্রির দরপত্র দেয়। এগুলোর মধ্যে ৪৯টি আম, ২৭ টি কাঁঠাল, ৭টি জামগাছ রয়েছে, যেগুলোতে এই মৌসুমে ফল ধরেছে।
এ ছাড়া ১০১টি মেহগনিসহ জারুল, কৃষ্ণচূড়া, খেজুর, পাকুড়, বকুল ফুল, রেইনট্রি, কদমসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ রয়েছে। জেলার কাহারোল উপজেলার জয়নন্দ হাটবাজার পর্যন্ত ৬টি আম, ২০টি আকাশমণি, ৪টি কড়ই, ৩টি মেহগনি, ৫টি কদম, ২টি শিমুলসহ বিভিন্ন প্রজাতির ৪১টি গাছ এবং বীরগঞ্জ ডাকবাংলায় একটি কৃষ্ণচূড়াগাছের ১১টি খণ্ড ও খানসামায় একটি আমগাছ কাটার দরপত্র হয়। মোট ১০টি লটে গাছগুলো দরপত্র দিয়ে গত ১৬ এপ্রিল কাটার কার্যাদেশ দেয় জেলা পরিষদ। কার্যাদেশে ১০ কার্যদিবসের গাছ অপসারণের জন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে নির্দেশনা দেওয়া হয়। কার্যাদেশ পাওয়ার পর কয়েক দিন ধরে গাছ কাটা শুরু করে দরপত্রপ্রাপ্ত ঠিকাদাররা।
সরেজমিনে বোচাগঞ্জ উপজেলা এলাকায় দেখা যায়, দ্রুততার সঙ্গেই চলছে গাছ কাটা। যেসব গাছ কাটা হয়ে গেছে, সেগুলো ট্রাক্টরে করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে করাত কলে। একসময়ে যে গাছগুলো ছায়া দিতো, সেগুলোকে কেটে ফেলায় এখন খাঁ খাঁ করছে পুরো এলাকা। এতে জনমনে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে।
রিকশাচালক আলী হোসেন বলেন, এই যে রাস্তার গাছগুলো কেটে দিচ্ছে, আমাদের চলাচলে খুব অসুবিধা হচ্ছে। কোথাও আমরা আশ্রয় নিতে পারছি না। গাছ থাকলে রাস্তার পাশে দাঁড়াতে পারতাম, যাত্রীদের পার্কিং দিতে পারতাম। আমাদের অনেক সমস্যা হচ্ছে। এমনিতেই এখন রোদের অনেক তাপ, শরীরের জন্য অনেক কষ্ট হচ্ছে। এ সময় গাছ কাটা ঠিক না।
স্থানীয় বাসিন্দা আজাহার উদ্দিন বলেন, প্রচণ্ড গরম, এখন তাপমাত্রা অনেক বেশি। এই গরমের গাছের ছায়া দিয়ে হাঁটতাম, ছায়া পেতাম। কিন্তু এখন গাছগুলো কাটা হচ্ছে। সরকার তো গাছ কাটবে, সমস্যা নাই। কিন্তু হিসেবমতো কাটতো, শীতের সময়ে কাটতো, তাহলে আমাদের উপকার হতো। আমাদের তো ক্ষমতা নেই গাছ কাটা বন্ধ করার।
* সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ সব সংবাদ, ছবি ,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন। ভিজিট করুন : http://www.etihad.news
* অনলাইন নিউজ পোর্টাল ইত্তেহাদ নিউজে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়