মতামত

মিল্টন সমাদ্দারের ভেতর-বাহির

109104 milton
print news

বদরুল হুদা সোহেল : ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রকৃতির কবি হিসেবে খ্যাত ইংরেজ কবি উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ-এর ‘লন্ডন, ১৮০২’ নামে একটি সনেট রয়েছে। তার জীবদ্দশার এক পর্যায়ে ইংল্যান্ডের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অগ্রগতিতে স্থবিরতা ও অনগ্রসরতা উপলব্ধি করে এ থেকে জাতিকে উত্তরণের কথা ভাবেন। সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথিতযশা কবি জন মিল্টনের শূন্যতা উপলব্ধি করে জাতির জন্য মিল্টনের মতো লেখকের আবশ্যকতা উক্ত সনেটে তুলে ধরেন। আমাদের দেশেও আজ মানবতার উপস্থিতি যেমন খড়ের গাদায় সুঁই খুঁজে পাওয়ার মতো অবস্থা, ঠিক তখনই মিল্টন নামের এক চরিত্রের সন্ধান পাই আমরা।
বিজ্ঞাপন
মানবতার ফেরিওয়ালাখ্যাত এই মিল্টন সমাদ্দার দু’দিন আগেও ছিলেন বয়োবৃদ্ধ ও অসহায়দের ত্রাণকর্তা ও আশ্রয়দাতা। আজ পাহাড়সম অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। ডিবি পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হলেন তিনি। তার অগণিত অপরাধের মধ্যে একটি হলো, তিনি প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে জাল মৃত্যুসনদ বানিয়েছেন। তার আশ্রমের টর্চার সেলে মানুষকে নির্মমভাবে মারধরসহ রয়েছে শিশু পাচারের অভিযোগ। তার অধীনে পরিচালিত ‘চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ার’- এর মাধ্যমে তার এসব কর্মকাণ্ড পরিচালনার অভিযোগে এখন পর্যন্ত ৩টি মামলা হয়েছে।

মিল্টন সমাদ্দারের উত্থানের গল্প তিনি নিজেই ব্যক্ত করেন। রাস্তায় পড়ে থাকা অসুস্থ ও অবহেলিত বৃদ্ধদের তার আশ্রমে এনে তাদের দেখভাল করতেন, ওষুধ দিতেন, খাবার দিতেন। এই সেবাদানকে পুঁজি করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তা প্রচার করে মানুষের বিবেককে নাড়া দিতে পেরেছিলেন তিনি। অসুস্থ মানুষকে চিকিৎসা ও সেবাশুশ্রূষার জন্য মানুষের সহায়তা হিসেবে পেতেন কোটি কোটি টাকা। এর মধ্যে তার আশ্রমে থেকে মৃত্যুবরণ করার ঘটনায় মরদেহ দাফন করতে গিয়ে বাধে সব বিপত্তি। অভিযোগ হলো- মিল্টনের অধীনে দাফনকৃত লাশগুলোতে থাকতো কাটা-ছেঁড়ার দাগ। তাছাড়া লাশ দাফনের সঠিক হিসাবও তিনি ডিবি পুলিশের কাছে দিতে পারছেন না। এসব লাশের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কেটে নিয়ে বিক্রি করতেন বলেও গুরুতর অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। মিল্টন সমাদ্দারের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ নিয়ে বিস্তারিত আমরা আরও জানবো। এ ব্যাপারে ডিবি পুলিশসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগ তৎপর রয়েছে। কিন্তু আমার কিছু প্রশ্ন অন্যদিকে। তাহলো, জানা যায় মিরপুর ও সাভারে তার প্রতিষ্ঠিত ‘চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ার’ নামের দুটি আশ্রম তিনি সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে অনুমতি নিয়েছিলেন। অনুমতি নিয়ে থাকলে কিছু প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক। সমাজসেবা অধিদপ্তর উক্ত আশ্রম দুটিতে নিয়মানুযায়ী পরিদর্শন বা মনিটরিং কার্যক্রম পরিচালনা করেছিলেন কিনা? অধিদপ্তরটি যেহেতু সাধারণ মানুষের দানের টাকায় পরিচালিত অলাভজনক প্রতিষ্ঠানকে অনুমোদন দেয়, তাহলে নিয়মানুযায়ী তার আশ্রম দু’টি নিরপেক্ষ কোনো প্রতিষ্ঠান দিয়ে অডিটকার্য নিয়মিত করানোর ব্যাপারে সমাজসেবা অধিদপ্তর লক্ষ্য রেখেছিল কিনা? মোবাইল ব্যাংকিংসহ বিভিন্ন বেসরকারি ব্যাংকের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের দানকৃত টাকা মিল্টন সমাদ্দারের কাছে আসতো। অডিট যদি হয়েও থাকে তাহলে এসব ব্যাপারে ছলচাতুরীর আশ্রয় সে কীভাবে নিলো? সরকারি সংস্থা কেন তদারকি করেনি?
এবার আসি শারীরিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কেটে বিক্রয়ের অভিযোগ প্রসঙ্গে। শারীরিক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কেটে সংগ্রহ করে বিক্রি করা কোনো সাধারণ কাজ নয়। এ কাজের জন্য বিশেষজ্ঞ ডাক্তার, আনুষঙ্গিক উন্নত সরঞ্জামসহ বিশেষ ল্যাব বা অপারেশন থিয়েটারের প্রয়োজন পড়ে। জানা গেছে, এক ডাক্তার ওখানে মাসে মাসে ভিজিট করতেন কিন্তু মিল্টন সমাদ্দার ভুয়া মৃত্যুসনদ তৈরিতে ওই ডাক্তারের নাম ও সিল ব্যবহার করতেন যা ডাক্তার জানতেন না। অবশ্য তিনি এগুলো না জানারই কথা। যেখানে মিল্টনের স্ত্রী মিল্টনের অপকর্মের ব্যাপারে সাংবাদিকদের কাছে কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি সেখানে ডাক্তার কীভাবে তার অপকর্মের কথা জানবেন। মিল্টন পড়াশুনা না করলেও তার স্ত্রী একজন নার্স, সরকারি চাকরি করেন। পড়াশোনা করেছেন। কীভাবে সাংবাদিকদের প্রশ্নের প্রাসঙ্গিকতা এড়িয়ে উত্তর দেয়া যায় তা তিনি ভালো করেই জানেন। ওই ডাক্তার মহোদয় মাসে একটি নির্দিষ্ট ফি’র বিনিময়ে আশ্রমে গিয়ে পরিদর্শন করে তিনি মিল্টনকে কী কী পরামর্শ দিতেন? অন্য কোনো ডাক্তার ওখানে যাতায়াত করতেন কিনা? কারণ আগেই বলেছি বিশেষজ্ঞ ডাক্তার ছাড়া অঙ্গ প্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপনের জটিল কাজ নিশ্চয়ই মিল্টনের মতো একজন আনাড়ি লোকের পক্ষে সম্ভব নয়। আর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কাটার কাজে মিল্টন জড়িত থাকলে নিশ্চয়ই সেগুলো কোনো না কোনো হাসপাতাল বা ক্লিনিকে সরবরাহ করার ঘটনা রয়েছে। সে ব্যাপারে কোনো খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে কিনা? অঙ্গ- প্রত্যঙ্গ চুরির কাজে তার সম্পৃক্ততা থাক বা না থাক, তার আশ্রমে সাজানো টর্চার সেলে অসুস্থ, বৃদ্ধ, বিকলাঙ্গ ও অসহায়দের এনে হাত-পা কেটে নির্যাতনের পৈশাচিক আনন্দ পাওয়ার ঘটনা ইতিমধ্যে ডিবি পুলিশ প্রকাশ করেছে। মিল্টন যে অপরাধ ও অন্ধকার জগতের একজন মাফিয়া সদস্য তা ক্রমেই স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। যে ব্যক্তিটি গ্রামে নিজের বাবাকে মারধর করে শহরে চলে আসে এবং শহরে এসে ফার্মেসিতে চুরির অপরাধে কাজ থেকে বহিষ্কৃত হয়। কোনো ব্যক্তি মানবতা ও সততার চাদরে নিজেকে যতই মোড়াক তার চরিত্রের খোলস তো সাপের মতো পাল্টাতে পারে না। রাতারাতি আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ বনে যাওয়া মিল্টনের অপরাধের আর কী কী জগৎ আছে তা আবিষ্কার করা দরকার।
সততা বা সাধুতার মুখোশে মিল্টন সমাদ্দারের সহযোগী আরও কোনো প্রেতাত্মা আছে কিনা তা ঘাঁটতে হবে। পুলিশের জালে মিল্টন আটকে থাকার কারণে ওই প্রেতাত্মারা হয়তো অদৃশ্য হয়ে অপেক্ষা করছে। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা না নিলে সুযোগ পেলেই আবার এই অশরীরী আত্মারা মানবতার সাইনবোর্ড লাগিয়ে মিল্টনরূপে আমাদের সমাজে ফিরে আসতে পারে।

জানা যায়, ২০১৪ সাল থেকে মিল্টন তার এই কার্যক্রম শুরু করেছেন। সরকারি কোনো প্রতিষ্ঠান তার কাণ্ডকীর্তি কেন এত বছর খেয়াল করেনি? ব্যাঙ বছরে ছয়মাস শীতনিদ্রায় থাকলেও আমাদের সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো বোধ হয় এখন বারোমাসই শীতনিদ্রায় থাকে। ডিবি পুলিশ তার অপরাধের জগৎ জনতার সামনে আনার জন্য ওঠেপড়ে লাগলেও সমাজসেবা অধিদপ্তরের এখনো কেন ঘুম ভাঙছে না তা আমাদের বোধগম্য নয়।

যে আদর্শ ও নীতিকে বুকে ধারণ করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অস্থায়ী সরকারে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ তাজউদ্দীন আহমেদের ওপর ন্যস্ত হয়, সেই মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত সমাজসেবা অধিদপ্তর মিল্টনের দুর্নীতি নিয়ে মুখ না খোলার বিষয়টি কষ্টের।
সাধারণ মানুষের দেয়া কোটি কোটি টাকা আশ্রমে আশ্রয়গ্রহণকারীদের পেছনে খরচ না করে ওই অর্থ মিল্টন কোথায় কোথায় লোপাট করেছে তার হিসাব পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে নেয়া দরকার। জানা যায়, অর্থাভাবে বর্তমানে আশ্রমের বৃদ্ধ রোগীরা খাদ্যাভাবে দিন কাটাচ্ছেন। তাদের দেখভালের বিষয়টি নিয়ে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় কী এখন ভাবছে?

লেখক: সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ইংরেজি বিভাগ
ঈশা খাঁ ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি
কিশোরগঞ্জ।

 

* সর্বশেষ  গুরুত্বপূর্ণ  সব  সংবাদ, ছবি ,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন লেখা পেতে আমাদের  ফেসবুক পেইজে  লাইক  দিয়ে  অ্যাকটিভ  থাকুন।  ভিজিট করুন : http://www.etihad.news

* অনলাইন  নিউজ পোর্টাল  ইত্তেহাদ নিউজে  লিখতে  পারেন  আপনিও। লেখার বিষয়  ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন  [email protected] ঠিকানায়

সংবাদটি শেয়ার করুন....
ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক :

ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক :

About Author

etihad news is one of the famous Bangla news portals published from Abudhabi-UAE. It has begun with a commitment to fearless, investigative, informative, and independent journalism. This online portal has started to provide real-time news updates with maximum use of Smart Technology.

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *