সুন্দরবনের ‘খাঁটি মধু’ নামে ‘ভেজাল মধু’তে বাজার সয়লাব


ইত্তেহাদ নিউজ,খুলনা :বিশ্বের একক বৃহত্তম লবণাক্ত পানির বন ভূমি সুন্দরবন। যেখান থেকে বছরের দুই মাস মধু আহরণের অনুমতি পান মৌয়ালরা। মধু ব্যবসায়ী, মৌয়াল ও বন বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সুন্দরবন থেকে যে মধু পাওয়া যায় তা সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক। তাই এই মধুর চাহিদা সবচেয়ে বেশি। তবে সেখান থেকে পর্যাপ্ত জোগান না হওয়ায় অসাধু ব্যবসায়ীরা বাজারে ভেজাল মধুকে সুন্দরবনের মধু হিসেবে সরবরাহ করে চাহিদা মিটিয়ে যাচ্ছেন। ১২ বছর ধরে সুন্দরবনের মধুর ব্যবসা করছেন সৈয়দ মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, কৃত্রিমভাবে বাক্সের মাধ্যমে মৌমাছি রেখে, সরিষা, লিচু বা অন্যান্য ফুলের মধু উৎপাদন করা হয়, তাতে রাসায়নিকের উপস্থিতি থাকতে পারে। কারণ এখন ফলন বাড়ানোর জন্য ফসলে নানা রকমের রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়। তবে সুন্দরবনের গাছের ফুলে কোনো প্রকার রাসায়নিক ব্যবহার করা হয় না। তাই সেখানের মধু পুরোপুরি প্রাকৃতিক ও খাঁটি। আর এ কারণেই বাজারে এর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। ফলে সুন্দরবনের মধুর নামে সহজেই ভেজাল মধু বিক্রি করা যায়।
দেশে প্রতি বছর কী পরিমাণ মধুর চাহিদা রয়েছে তার হিসাব বেরিয়ে এসেছে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) বার্ষিক প্রতিবেদনে। বিসিকের উদ্যোগে ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশে ৭,৩২৮ দশমিক ২৫ মেট্রিক টন মধু উৎপাদিত হয়েছে। এ ছাড়া বন বিভাগের তথ্য মতে, ওই অর্থবছরে সুন্দরবন থেকে মধু আহরণ হয়েছে ১২২ দশমিক ৫ মেট্রিক টন। ব্যবসায়ী মিজানুর রহমান আরও বলেন, এ পরিসংখ্যান দেখলে বোঝা যায়, বাজারে কী পরিমাণ মধুর চাহিদা রয়েছে। আর ভোক্তারা যে পরিমাণ সুন্দরবনের মধু চাচ্ছেন, সে তুলনায় এই বন থেকে খুবই সামান্য পরিমাণ মধু আহরণ হচ্ছে। এদিকে বিপুল পরিমাণ চাহিদার বিপরীতে পর্যাপ্ত জোগান না হওয়ায় খুলনা শহরসহ উপকূলীয় উপজেলাগুলোতে গড়ে উঠেছে একাধিক ভেজাল মধুর কারখানা এবং অসাধু ব্যবসায়ীরা ভেজাল মধুর রমরমা ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। ফলে ভোক্তারা প্রতারণার শিকার হচ্ছেন।
গত বছরের ১২ সেপ্টেম্বর খুলনা শহরের খালিশপুরে ‘খুলনা মধুঘর’ নামের একটি কারখানায় অভিযান চালায় নগর গোয়েন্দা পুলিশ। সেখান থেকে তারা ৬শ লিটার ভেজাল মধু জব্দ করে। এ ছাড়া বিভিন্ন সময় ভেজাল কারখানার বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বিপুল পরিমাণ মধু জব্দ করে। গত ১১ সেপ্টেম্বর ১০৫ লিটার ভেজাল মধু জব্দ করে নগর গোয়েন্দা পুলিশ। কয়রা থানা পুলিশ ২০২৩ সালের ১১ জানুয়ারি ১৫ মণ, ২০২২ সালের ৯ নভেম্বর ১৫ মণ, ২০২০ সালের ১২ মে ২৩ মণ ভেজাল মধু জব্দ করে।
যারা ভেজাল মধু তৈরি করেন এমন কয়েকজন মৌয়ালের সঙ্গে কথা বললে তারা জানিয়েছেন, ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশ চিনির সঙ্গে ২০ থেকে ২৫ শতাংশ পানিসহ উত্তপ্ত করে তার সঙ্গে ‘হানি এথেন্স’ নামের এক প্রকার রাসায়নিক ফ্লেভার মিশ্রত করা হয়। যার ফলে ভেজাল মধু তৈরি করা হয়। ওই মধুর সঙ্গে সুন্দরবন থেকে আহরণ করা প্রাকৃতিক মধু মিশ্রিত করা হয়। তারা জানান, মধু আসল কিংবা নকল তা স্বাভাবিকভাবে কেউ অনুমান করতে পারে না। দুটির স্বাদ-ঘ্রাণ প্রায় একই রকমের হয়ে থাকে। শুধু যে উপকূলীয় মৌয়ালদের বাড়ি বা মধু ব্যবসায়ীদের বাড়িতে ভেজাল মধু তৈরি হয় তা নয়। অসাধু মৌয়ালরা বনের মধ্যে গিয়েও ভেজাল মধু তৈরি করে থাকে বলে অভিযোগ রয়েছে।
২০২১ সালের ২২ মে সুন্দরবনের কালাগাছি এলাকা থেকে ৭৫০ কেজি চিনিসহ সাত মৌয়াল আটক করেছিল বন বিভাগ। তারা বন বিভাগ থেকে মধু সংগ্রহের অনুমতি নিয়ে সুন্দরবনে গিয়ে ভেজাল মধু তৈরির প্রচেষ্টা চালিয়েছিল। খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক মিহির কুমার দো বলেন, ‘চাক থেকে কীভাবে মধু কাটতে হবে, কীভাবে বেশি মধু আহরণ করা যায়, এসব নিয়ে মৌয়ালদের আমরা মাঝে মধ্যে প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকি। একই সঙ্গে মধুর মৌসুমে কঠোর নজরদারি করা হয়, যাতে বনের মধ্য কেউ ভেজাল মধু তৈরি করতে না পারে। তবে অসাধু ব্যবসায়ীরা যদি বাড়িতে তৈরি করে, সেখানে আমাদের কিছু করার থাকে না।’ জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের খুলনা বিভাগীয় উপ-পরিচালক মোহাম্মদ সেলিম বলেন, আসল আর নকল মধু নির্ণয় করার সহজ কোনো উপায় নেই। আমরা এ ধরনের অভিযান চালাতে গেলে বিএসটিআইয়ের সহায়তা নিয়ে থাকি। যাচাই-বাছাই করে সবার মধু কেনা উচিত বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
এদিকে প্রতিবারের মতো এ বছরও এপ্রিলের শুরুতে সুন্দরবনে মধুর মৌসুম শুরু হয়েছে। ৩১ মে পর্যন্ত মৌয়ালরা সেখান থেকে মধু আহরণ করবেন। বন বিভাগ জানায়, চলতি অর্থবছরে ২ লাখ ৫০ হাজার কেজি মধু ও ৭৫ হাজার কেজি মোম আহরণের লক্ষ্যমাত্র নির্ধারণ করা হয়েছে। এর বিপরীতে বনের রাজস্ব আয় হবে ৬০ লাখ টাকারও বেশি। তবে মৌয়ালরা বলছেন সুন্দরবন থেকে কী পরিমাণ মধু আহরণ করা যাবে তা নির্ভর করে মৌসুমে কী পরিমাণ বৃষ্টিপাত হয় তার ওপর। সুন্দরবন সংলগ্ন কালাবগি গ্রামের মৌয়াল মোজাহিদ বলেন, ‘এই বছর মধুর মৌসুমে একেবারেই বৃষ্টিপাত হয়নি। ফলে গাছের ফুল শুকিয়ে পড়ে যাচ্ছে। যার কারণে আমরা পর্যাপ্ত পরিমাণ মধু পাচ্ছি না।
তিনি আরও বলেন, গত বছরেও মধুর মৌসুমে তেমন বৃষ্টিপাত না হওয়ায় বন থেকে আমরা পর্যান্ত পরিমাণ মধু পাইনি। একটি চাক থেকে মধু কাটার পর অন্তত ১৫ দিন পর আবার মধু কাটা যায়। বৃষ্টি ভালো হলে বড় চাক থেকে ২০ কেজিরও বেশি মধু পাওয়া যায়। আর বৃষ্টি না হলে ৭ থেকে ১০ কেজি মধু পাওয়া যায় বলে তিনি জানান। আবহাওয়া অধিদপ্তরের খুলনা কার্যালয় থেকে পাওয়া তথ্য অনুসারে, এ বছর মধুর মৌসুম শুরু হওয়ার পর খুলনা অঞ্চলে মাত্র ৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে, যা অন্যান্য বছরের তুলনায় খুবই কম। সিনিয়র আবহাওয়াবিদ আমিরুল আজাদ বলেন, ‘আবহাওয়া স্বাভাবিক থাকলে অন্যান্য বছর এপ্রিলে খুলনা অঞ্চলে সাধারণত ৫০ মিলিমিটারের কাছাকাছি বৃষ্টি হয়ে থাকে।’
বৃষ্টিপাতের সঙ্গে মধু উৎপাদনের সম্পর্ক রয়েছে বলে স্বীকার করে পশ্চিম বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) আবু নাসের মোহসিন হোসেন বলেন, গত বছর মধুর সিজনে কোনো বৃষ্টি হয়নি। বৃষ্টির সঙ্গে মধু উৎপাদনের একটা সম্পর্ক আছে। পর্যাপ্ত বৃষ্টি না হলে ফুল ঝরে যায় ও ফুলে মধুর পরিমাণ কমে আসে। তাই গত বছর বৃষ্টি না হওয়ায় সুন্দরবনে মধু কম পাওয়া গেছে। এ বছরও বৃষ্টিপাত কম, তবে মে মাসে বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস রয়েছে। যদি ভালো বৃষ্টি হয় তবে মধু আহরণের পরিমাণ বাড়বে। খুলনা ও সাতক্ষীরার একাধিক মৌয়ালের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত না হওয়ায় অনেকে মৌয়াল প্রথমবার মধু আহরণ করতে গিয়ে লোকসান গুনছেন। মে মাসে যদি পর্যাপ্ত বৃষ্টি না হয় তাহলে তারা মধু আহরণ করতে বনে যাবেন না।
খুলনা জেলা নিরাপদ খাদ্য কর্মকর্তা বলেন, ভেজাল মধু তৈরিতে মূলত ৫টি জিনিস ব্যবহার করে। চিনি, ফিটকিরি, ফ্লেভার, রং ও আঠালো গ্লুকোজ সিরাপ ব্যবহার করা হয়। ভেজাল মধু তৈরির জন্য অসাধু ব্যবসায়ীরা প্রথমে হাড়িতে পানি দিয়ে চিনি জ্বালিয়ে নেয়। এর মধ্যে ফিটকিরি দেয়, যাতে চিনি জ্বালানোর পর লালচে রং ধারণ না করে। মধুটা স্বচ্ছ হয়। যে ব্রান্ডের মধু তারা বানাবে ওই ব্রান্ডের রং ও ফ্লেবার মিশিয়ে নেয়। সুন্দরবনের মধু ও কালিজিরা মধু এই দুটি ব্রান্ডের মধু তারা বেশি ভেজাল তৈরি করে। এই মধুর চাহিদা বেশি এবং দামও বেশি। লিচু, সরিষা ও বরই ফুলের মধু ভেজাল কম হয়। এগুলোর দাম কম, যেকারণে ভেজাল করে তাদের লাভ হয় না। তবে সরিষা ফুলের মধু পুরাতন হলে তার সঙ্গে চিটাগুড় ও কালিজিরা পাউডার মিশিয়ে কালিজিরা মধু তৈরি করে। নিরাপদ খাদ্য কর্মকর্তা বলেন, বাঙালিদের একটা ঐতিহ্য আছে শিশু জন্ম নিলে তার মুখে প্রথমে মধু দেয়। তাহলে জন্মের পর যদি চিনি ফিটকিরি দিয়ে বানানো ভেজাল মধু দেওয়া হয়। তারমানে একটি শিশুর জন্মের পর তার মুখে ভেজাল খাবার দেওয়া হল। আমরা মধু খেয়ে থাকি রোগের প্রতিষেধক হিসেবে। ভেজাল মধু খেয়ে আমরা মধুর পুষ্টিগুণ এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত হচ্ছি। এই ধরনের মধু প্রধানত সমস্যা সৃষ্টি করে কিডনিতে। বিভিন্ন ভেজাল খাবার খেয়ে কিডনি রোগ দিন দিন বেড়েই চলেছে। ফিটকিরি যুক্ত মধু যদি প্রতিনিয়ত খাওয়া হয় তাহলে পেটের মধ্যে ক্ষত তৈরি করতে পারে। সেই ক্ষত থেকে আলসার এবং আলসার থেকে ক্যান্সারও হতে পারে। এর দীর্ঘ মেয়াদী প্রভাব রয়েছে।
* সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ সব সংবাদ, ছবি ,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন। ভিজিট করুন : http://www.etihad.news
* অনলাইন নিউজ পোর্টাল ইত্তেহাদ নিউজে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়