মতামত

সাংবাদিকদের কি হেলমেট লাগে না?

journalist
print news

এস এম জাহিদ :   সংবাদ সংগ্রহের জন্য সর্বদাই সাংবাদিকদের দ্রুততার সাথে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাতায়াত করতে হয়। আর এ সময়ে জীবনের ঝুঁকি থাকার পরেও মোটরসাইকেল চালানোর সময়ে হেলমেট পরিধানে অনীহা সৃষ্টি হয়েছে সংবাদকর্মীদের মাঝে।শুধু আইন থেকে রক্ষার জন্য হেলমেট না, জীবনের সুরক্ষার জন্যও প্রয়োজন হেলমেট।
বরিশালে শতকরা প্রায় ৯০ ভাগ সংবাদকর্মী হেলমেট বিহীন মোটরসাইকেলে যাতায়াত করে বরিশালের মহাসড়ক সহ বিভিন্ন অলিতে-গলিতে । সরেজমিনে প্রত্যক্ষ ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বশীল পুলিশ সদস্যরা সাংবাদিক লেখা স্টিকার দেখলেই মোটরসাইকেল না থামিয়ে উল্টো না দেখার ভান করে তাকিয়ে থাকছেন বিপরীত দিকে ফলে ঝুঁকিতে সংবাদকর্মীদের প্রাণ ।

হেলমেট মাথার সুরক্ষার জন্য ব্যবহৃত একধরনের শিরোস্ত্রাণ বা মাথার বর্ম বিশেষ। হেলমেট মাথাকে বাইরের আঘাত থেকে রক্ষা করে। সর্বপ্রথম খ্রিস্টপূর্ব ৯০০ সালে অ্যাসিরীয় সৈন্যদের হেলমেট ব্যবহারের কথা জানা যায়। এই হেলমেট গুলো মোটা চামড়া বা ব্রোঞ্জ দিয়ে তৈরি করা হতো এবং যুদ্ধক্ষেত্রে ভোঁতা বস্তু, তলোয়ার ও তীরের আঘাত থেকে মাথার সুরক্ষার জন্য ব্যবহার করা হতো। সৈন্যরা এখনও হেলমেট ব্যবহার করে, কিন্তু এখনকার হেলমেটগুলো সাধারণত প্লাস্টিক বা এ জাতীয় হালকা উপাদান দিয়ে তৈরি করা হয়। আধুনিক সমাজে মোটরসাইকেল দূর্ঘটনা প্রতিরোধের ক্ষেত্রে হেলমেটের ব্যবহার অপরিহার্য করা হয়েছে। গত বছর ২০২৩ সালে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ঘটেছে প্রায় ২ হাজার ৫৩২টি, নিহত হয়েছেন ২ হাজার ৪৮৭ জন এবং আহত হয়েছেন ১ হাজার ৯৪৩ জন। নিহতদের মধ্যে এক হাজার ৯০৯ জন (৭৫ দশমিক ৩৯ শতাংশ) ১৪ থেকে ৪৫ বছর বয়সী। নিহত বা আহতের মাঝে সংবাদকর্মীর সংখ্যা রয়েছে শতাধিক।  বরিশালের ট্রাফিক আইন রক্ষায় নিয়োজিত পুলিশের দায়ীত্বশীলরা একটু সোচ্চার হলেই দুর্ঘটনা কমে আসবে। সাংবাদিকতা পেশার সাথে জড়িতদের আইন মানতে বাধ্য করার বিকল্প নাই। তবে এমন ঘটনার তীব্র বিরোধিতা করে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ট্রাফিক সার্জেন্ট প্রতিবেদককে জানান সাংবাদিকদের সাথে ঝামেলায় জড়াতে চান না তারা। কিন্তু কি এমন দুর্বলতা পুলিশের? কি কারণে সাংবাদিকদের যানবাহনে মামলা করতে অনীহা ট্রাফিকের?

সকল দুর্বলতার পিছনে রয়েছে ট্রাফিক পুলিশের ঘুষ ও অবৈধ বিট বানিজ্য । নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পিকআপ ভ্যান মালিক জানান,ট্রাফিকের এক পুলিশ কর্মকর্তাকে মাসিক মাসোয়ারা দিয়ে ২ টি গাড়ি চালাচ্ছেন তিনি। এ ছাড়াও কাগজপত্র বিহীন অটোরিকশা, গ্যাসের গাড়ি, সিএনজি, বাস, ট্রাক থেকে ও মাসোয়ারা আসে বরিশালের ট্রাফিকে কর্মরত অসাধু কর্মকর্তাদের পকেটে। এমনকি ফুটপাতের বাজার থেকে ও মাসোয়ারা তোলেন তারা।
জানা গেছে এ সকল মাসোয়ারার ভাগ বাটোয়ারায় জড়িয়ে পরেছেন একাধিক সংবাদকর্মীরা। আর সেখানেই মূল দুর্বলতা বরিশালের ট্রাফিক বিভাগের। নিজেদের দুর্বলতা ঢাকতেই সাংবাদিকদের সাথে ঝামেলায় জড়াতে নারাজ তারা৷ তবে এ সকল কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে কেউ কোন অভিযোগ না করায় তাদের বিরুদ্ধে কোনরূপ ব্যবস্থা নিতে পারছেন না বরিশাল ট্রাফিক পুলিশের উর্ধতন কর্মকর্তারা। আর তাতেই ঝুঁকিতে থেকে যাচ্ছে বরিশালের শতকরা প্রায় ৯০ ভাগ সংবাদকর্মীর প্রাণ। তবে হেলমেট পরিধানে বরাবরই সতর্ক করে যাচ্ছে বরিশাল ট্রাফিক পুলিশ।  নিজের জীবন রক্ষায় সংবাদকর্মীদের পাশাপাশি সকলকেই ট্রাফিক আইন মেনে সার্টিফাইড নিরাপদ হেলমেট পরিধান করার বিকল্প কিছু নেই বলে মতামত সিনিয়র সাংবাদিকদের ও বিশ্লেষকদের।

এদিকে অভিযোগ অস্বীকার করে বরিশাল ট্রাফিক পুলিশের অতিরিক্ত উপ পুলিশ কমিশনার রুনা লায়লা বলেন, হেলমেট ব্যবহার নিশ্চিত করতে আমরা কঠোরভাবে অভিযান চালিয়ে যাচ্ছি। সংবাদকর্মী হোক অথবা পুলিশ সদস্য কাউকেই ছাড় দেয়া হচ্ছে না। তবে সকলেরই নিজ নিজ জায়গা থেকে সচেতন হওয়া উচিৎ।

সড়ক পরিবহন আইন :

সড়ক পরিবহন আইন অনুযায়ী,মোটরসাইকেলে যাত্রী থাকলে চালকসহ দুই জনকেই হেলমেট পরতে হবে।বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী মোটরসাইকেল চালক এবং যাত্রী উভয়ই হেলমেট ব্যবহার না করলে জরিমানা করার বিধান রয়েছে।মোটরসাইকেলে যাত্রা করতে হলে চালক ও যাত্রীদের মাথায় হেলমেট বাধ্যতামূলক। কারোর হেলমেট না থাকলে তিন মাসের কারাদণ্ড, ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান আছে। মোটরযান চলাচল আইনের ৪৯-চ ধারায় বলা হয়েছে, ‘চালক ছাড়া মোটরসাইকেলে একজনের অধিক সহযাত্রী বহন করা যাবে না। চালক ও সহযাত্রীকে যথাযথভাবে হেলমেট ব্যবহার করতে হবে। যদি কোনও ব্যক্তি এই বিধান লঙ্ঘন করেন, তাহা হইলে উক্ত লঙ্ঘন হইবে একটি অপরাধ। এজন্য তিনি অনধিক ৩ (তিন) মাসের কারাদণ্ড, বা অনধিক ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড, বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন এবং, চালকের ক্ষেত্রে, অতিরিক্ত হিসাবে দোষসূচক ১ (এক) পয়েন্ট কাটা যাবে’।

তবে প্রশ্ন উঠেছে, হেলমেটের মান নিয়ে। দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পেতে জীবন রক্ষার জন্য হেলমেট পরায় বাধ্যবাধকতা থাকলেও, তা দাঁড়িয়েছে ‘নিয়ম রক্ষার’। বিশেষ করে আরোহীর মাথায় যে হেলমেট, তাতে জীবনের ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে। আরোহীর মাথায় পরা হেলমেট হালকা এবং নিম্নমানের। এ ধরনের হেলমেট ব্যবহারে উদ্দেশ্য সাধন তো হচ্ছেই না বরং ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে।সড়ক পরিবহন আইনে মোটরসাইকেল আরোহী প্রত্যেকের জন্য হেলমেট পরিধান বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ব্যবহূত হেলমেটে কী কী নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্য থাকতে হবে তা বলা হয়নি। এই ফাঁক পূরণে খসড়া বিধিমালায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই) মোটরসাইকেল হেলমেটের মানদণ্ড বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়ার পাশাপাশি মানদণ্ড পরিমাপ করার যথার্থ পদ্ধতি বিষয়ে বিশদ নির্দেশনা প্রণয়নের কাজে নেতৃত্ব দেবে।

বিশ্বব্যাংক ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা কেন্দ্রের (এআরআই)  এক যৌথ গবেষণায় দেশে মোটরসাইকেল চালক ও যাত্রীদের হেলমেট ব্যবহারের একটি চিত্র ফুটে উঠেছে। গবেষণাপত্র থেকে জানা গেছে, দেশের সড়কে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মোট মৃত্যুর ৮৮ শতাংশই মারা যাচ্ছেন হেলমেট না পরার কারণে। আর হেলমেট পরিহিত অবস্থায় মারা যাচ্ছেন ১২ শতাংশ চালক-আরোহী।যে হারে মোটরসাইকেল সড়কে নামছে এবং দুর্ঘটনায় মানুষ মারা যাচ্ছে, এতে সরকারের দায়িত্বশীলদের সড়কে দুর্ঘটনারোধে আরও বেশি গুরুত্ব দেওয়া জরুরি। হেলমেটের মান যাচাইয়ে সরকারি সংস্থাগুলোর উদ্যোগ নিতে হবে। মানহীন অনিরাপদ হেলমেট ব্যবহারকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বাজারে ভালো হেলেমেট নিশ্চিত করতে হবে। যাতে নিম্নমানের সস্তা হেলমেট বিক্রি না হয়, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। সব থেকে বড় বিষয় হচ্ছে, মোটরসাইকেল চালক ও যাত্রীরা সচেতন না হলে দুর্ঘটনা ও মৃত্যু থেকে কোনোভাবেই রেহাই পাওয়া যাবে না। একটি ভালো হেলমেট কমাতে পারে দুর্ঘটনায় হতাহতের আশঙ্কা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, যথাযথভাবে হেলমেট ব্যবহারে দুর্ঘটনা মৃত্যুঝুঁকি ৪০ শতাংশ কমে যায়। আর জখম থেকে সুরক্ষা পাওয়া যায় ৭০ শতাংশ।

নো হেলমেট নো ফুয়েল :

সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে ‘নো হেলমেট, নো ফুয়েল’ কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য মাঠপর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।বৃহস্পতিবার (১৬ মে) পুলিশ সদর দপ্তরে অনুষ্ঠিত মাসিক (এপ্রিল-২০২৪) অপরাধ পর্যালোচনা সভায় সভাপতিত্বকালে এ নির্দেশনা দেন অতিরিক্ত আইজিপি (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) মো. আতিকুল ইসলাম।অতিরিক্ত আইজিপি সড়ক দুর্ঘটনা মামলার তদন্ত সুষ্ঠু ও সঠিকভাবে সম্পন্ন করার জন্য পুলিশ কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়ে বলেন, ফিটনেসবিহীন গাড়ির বিরুদ্ধে বিশেষ অভিযান অব্যাহত থাকবে। এ সময় মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার, রেঞ্জ ডিআইজি ও জেলার পুলিশ সুপাররা অনলাইনে যুক্ত ছিলেন।

লেখক : সাংবাদিক,বরিশাল ।

 

* সর্বশেষ  গুরুত্বপূর্ণ  সব  সংবাদ, ছবি ,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন লেখা পেতে আমাদের  ফেসবুক পেইজে  লাইক  দিয়ে  অ্যাকটিভ  থাকুন।  ভিজিট করুন : http://www.etihad.news

* অনলাইন  নিউজ পোর্টাল  ইত্তেহাদ নিউজে  লিখতে  পারেন  আপনিও। লেখার বিষয়  ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন  [email protected] ঠিকানায়

সংবাদটি শেয়ার করুন....
ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক :

ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক :

About Author

etihad news is one of the famous Bangla news portals published from Abudhabi-UAE. It has begun with a commitment to fearless, investigative, informative, and independent journalism. This online portal has started to provide real-time news updates with maximum use of Smart Technology.

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *