ইত্তেহাদ এক্সক্লুসিভ

ফুটবল খেলোয়াড় থেকে ঝিনাইদহ-৪ আসনের এমপি আনার

dba2a41fb0fe4b7dcd5d864e2d3e7902
print news

বাংলা ট্রিবিউন: ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনারের মরদেহ এখনও পায়নি ভারত পুলিশ। তবে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের মহাপরিদর্শক (সিআইডি) অখিলেশ চতুর্বেদী বুধবার বিকালে সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ‘আমরা কিছু সুনির্দিষ্ট তথ্য পেয়েছি, যার ভিত্তিতে মনে করছি তাকে হত্যা করা হয়েছে।’

তবে মরদেহ না পাওয়া নিয়ে নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে স্থানীয় নেতাকর্মীদের মনে। তাকে হত্যা করে লাশ গুম করে ফেলা হয়েছে, নাকি দেহ খণ্ড খণ্ড করে ফেলা হয়েছে; তা নিয়েও সন্দেহ আছে তাদের। এই মৃত্যু ঘিরে রহস্য দেখা দিয়েছে। উঠছে নানা প্রশ্নও। তবে সব প্রশ্নের ভিড়ে একটি বিষয় সবাই জানতে চায়। কে এই এমপি আনার, তাকে ঘিরে এত আলোচনা কেন?

স্বজন ও স্থানীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত ১২ মে ঝিনাইদহ থেকে সড়কপথে ব্যক্তিগত গাড়িতে করে দর্শনা চেকপোস্ট পর্যন্ত যান আজীম। দুপুর ২টা ৪০ মিনিটে দর্শনা-গেদে ইমিগ্রেশন পার হয়ে ভারতে প্রবেশ করেন। সীমান্ত থেকে একটি ভ্যানযোগে হাস্যোজ্জ্বলভাবে যেতে দেখা যায় একটি ভিডিও ফুটেজে। পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া সীমান্ত অতিক্রমের পর সন্ধ্যায় কলকাতার অদূরে ব্যারাকপুর কমিশনারেট এলাকার বরানগর থানার ১৭/৩ মন্ডলপাড়া লেনের স্বর্ণ ব্যবসায়ী গোপাল বিশ্বাসের বাড়িতে পৌঁছান। গোপাল বিশ্বাস আজীমের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। এই স্বর্ণ ব্যবসায়ীর সঙ্গে তার দুই দশকের বেশি সময় ধরে সখ্য ছিল। রাতে তার বাড়িতেই ছিলেন। পরদিন দুপুর ১টা ৪০ মিনিটে ওই বাড়ি থেকে কিছুটা হেঁটে বিধান পার্ক কলকাতা পাবলিক স্কুলের সামনে গিয়ে একটি গাড়িতে ওঠেন। ওই সময়েও হাস্যোজ্জ্বল ছিলেন। সেই দৃশ্য দেখেছেন গোপাল বিশ্বাসের পরিচিতজন শুভজিৎ মান্না। বিষয়টি ভারতীয় পুলিশকে জানিয়েছেন তিনি।

গোপাল বিভিন্ন গণমাধ্যমকে জানান, তার বাড়িতে ওঠার পরদিন ১৩ মে দুপুরে ‘বিশেষ প্রয়োজনের’ কথা বলে আজীম বেরিয়ে যান। দুপুরের দিকে বিধান পার্ক এলাকা থেকে ভাড়া করা গাড়িতে উঠে চলে যান। সন্ধ্যায় ফিরে আসার কথা থাকলেও আর ফেরেননি। ওই দিন সন্ধ্যায় তার হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর থেকে গোপালের নম্বরে মেসেজ আসে, ‘বিশেষ কাজে দিল্লি চলে যাচ্ছি এবং পৌঁছে ফোন করবো, তোমাদের ফোন করার দরকার নেই।’ এরপর আর ফোনে পাওয়া যায়নি। ১৪ মে সকাল সোয়া ১১টায় শেষ মেসেজ করে জানান, দিল্লি পৌঁছে গেছেন। তার সঙ্গে ভিআইপিরা আছেন। বরানগর থানায় ১৮ মে লিখিত নিখোঁজ ডায়েরিতে এসব তথ্য উল্লেখ করেন বন্ধু গোপাল বিশ্বাস।

এদিকে, ১৪ মে থেকে পরিবার ও দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে আজিমের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল। ব্যবহৃত হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরটিও বন্ধ ছিল। পরে পরিবারের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে যোগাযোগ করা হয়। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে থেকে দিল্লিতে বাংলাদেশ দূতাবাস ও কলকাতায় উপ-দূতাবাসে যোগাযোগ করে খোঁজ নিতে বলা হয়। এ অবস্থায় তার ভাতিজা সাইমন ও একই এলাকার আশিকুর রহমান সোহাগ খোঁজ নিতে ভারতে চলে যান। এসব বিষয় নিশ্চিত করেছেন এমপি আনারের ব্যক্তিগত সহকারী আব্দুর রউফ। ঘটনার ১০ দিন পর বুধবার সকালে হত্যাকাণ্ডের খবর পেলেন স্বজনরা।

দুপুরে ঢাকার মিন্টো রোডে ডিবি কার্যালয়ে গিয়ে কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেছেন আজীমের মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন। বাবার হত্যাকারীদের বিচার চেয়ে তিনি বলেছেন, কারা তাকে এতিম করেছে, তাদের তিনি দেখতে চান। সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘আমি যেন আমার বাবা হত্যার বিচার পাই। কারা এটা করেছে, কেন করেছে, এর সুষ্ঠু তদন্ত চাই। আমি এর শেষ দেখতে চাই যে তারা কেন করেছে? আমি দেখতে চাই, আমি বিচার চাই।’

এরপর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান সাংবাদিকদের বলেন, ‘এমপি আজীম ভারতে খুন হয়েছেন। এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যমতে, বাংলাদেশিরাই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। এ ঘটনায় তিন জনকে গ্রেফতার হয়েছে।’

বিকালে পশ্চিমবঙ্গ সিআইডির প্রধান অখিলেশ চতুর্বেদী জানান, পূর্ব কলকাতার নিউ টাউন অঞ্চলে যে ফ্ল্যাটে আনোয়ারুল আজীম উঠেছিলেন, সেটি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আবগারি দফতরের কর্মকর্তা সন্দীপ কুমার রায়ের। সন্দীপের কাছ থেকে ফ্ল্যাটটি ভাড়া নিয়েছিলেন আখতারুজ্জামান নামের এক ব্যক্তি। আখতারুজ্জামানই ওই ফ্ল্যাটে আজীমের থাকার ব্যবস্থা করেছিলেন কিনা, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

কে এই আনার?

ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার নিশ্চিন্তপুর মধুগঞ্জ বাজারের মৃত ইয়াকুব বিশ্বাসের ছেলে আনোয়ারুল আজীম আনার। ১৯৬৮ মালের ৩ মে জন্মগ্রহণ করেন। পরিবারে চার ভাই ও ছয় বোন। আনার ছিলেন চার ভাইয়ের মধ্যে সবার ছোট। পেশায় ছিলেন ব্যবসায়ী।

ফুটবল খেলোয়াড় থেকে এমপি

আনার ছিলেন তুখোড় ফুটবল খেলোয়াড়। এলাকায় বেশ সুনাম ছিল। ভালো ফুলবল খেলায় সবার কাছে জনপ্রিয় ছিলেন। সেই জনপ্রিয়তা থেকে ১৯৯৩ সালে এলাকাবাসীর অনুরোধে প্রার্থী হয়ে কালীগঞ্জ পৌরসভার কমিশনার নির্বাচিত হন। ২০০৯ সালে কালীগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এরপর ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে আওয়ামী লীগ থেকে এমপি নির্বাচিত হন। পাশাপাশি কালীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও পরে সভাপতি হয়েছেন।

এলাকায় আছে সুনাম

জনপ্রতিনিধি হিসেবে ছিলেন জনপ্রিয়। উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড ও সামাজিক কাজের জন্য জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। এমপি হলেও প্রটোকল নিয়ে এলাকায় চলাফেরা করতেন না। তিন দশকের বেশি সময় ধরে মানুষের সেবা করেছেন। একাই মোটরসাইকেলে চড়ে কখনও একজনকে নিয়ে এলাকার মানুষের খোঁজ নিতেন। অ্যাম্বুলেন্সের চালক না থাকায় নিজেই অসুস্থ রোগীর অ্যাম্বুলেন্স চালিয়ে হাসপাতালে পৌঁছে দিতেন। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত নির্বাচনি এলাকার গ্রামে গ্রামে গিয়ে মানুষের সঙ্গে দেখা করেছেন, সমস্যার কথা শুনেছেন এবং সমাধান করেছেন। সবচেয়ে আলোচিত বিষয় এলাকায় যেকোনো ব্যক্তি মারা গেলে তার বাড়িতে যেতেন এবং শোকাহত পরিবারকে সান্ত্বনা দিতেন। এমনও হয়েছে একদিনে একাধিক মৃত ব্যক্তির বাড়িতে গিয়ে স্বজনদের সান্ত্বনা দিয়েছেন।

স্থানীয় নেতাকর্মীদের অনেকে মনে করছেন, পুরোনো ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব কিংবা চোরাকারবারের কোনও বিষয় নিয়ে তাকে হত্যা করা হয়েছে। এর সঙ্গে তার পূর্বপরিচিত কেউ জড়িত থাকতে পারে।

হত্যাকাণ্ড নিয়ে যা বলছেন দলের নেতাকর্মীরা

কালীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সাধারণ সম্পাদক ও ১ নম্বর সুন্দরপুর-দুর্গাপুর ইউপির চেয়ারম্যান ওহিদুজ্জামান ওদু বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এই হত্যাকাণ্ডে আমরা মানসিকভাবে কষ্ট পেয়েছি। একজন সংসদ সদস্য চিকিৎসার জন্য ভারতে গিয়ে খুন হবেন কখনও ভাবিনি। তার মৃত্যুতে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হলাম, কালীগঞ্জ আওয়ামী লীগ ক্ষতিগ্রস্ত হলো। আমরা খুনিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।’

উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান ৮০ দশকের ছাত্রলীগ নেতা মতিয়ার রহমান মতি বলেন, ‘যখনই জানতে পারলাম তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, তখনই প্রশাসনকে বিষয়টি জানিয়েছি। কিন্তু তাকে উদ্ধারে কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তা আমরা জানতে পারিনি। দুঃখজনক হলেও পরে জানতে পারলাম নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। এ হত্যার কারণ জানতে চাই। যারাই হত্যাকাণ্ডে জড়িত তাদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি দেওয়ার দাবি জানাই।’

কালীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম  বলেন, ‘তিনি ভারতে গিয়েছিলেন কানের চিকিৎসার জন্য। ১০ দিন পর হত্যাকাণ্ডের কথা শুনে স্তব্ধ, হতভম্ব হয়ে গেছি। আমরা ব্যথিত ও মর্মাহত। তার পরিবার কিংবা স্বজনদের সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণাালয় এবং ভারতে বাংলাদেশের দূতাবাস আমাদের ধোঁয়াশার মধ্যে রেখেছে। ফলে এখনও জানতে পারছি না, আসলে মরদেহ উদ্ধার হয়েছে কিনা। এ নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে চাই না।’

কালীঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মতিয়ার রহমান মতি বলেন, ‘শুনেছি, এখনও মরদেহ পাওয়া যায়নি। কারা কেন হত্যা করেছে, তাও জানি না। তবে আমরা হত্যাকারীদের বিচার চাই।’

কালীগঞ্জ পৌরসভার সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলর বিনা খাতুন বলেন, ‘তার এই হত্যাকাণ্ড কোনও ভাবেই মেনে নিতে পারছি না। আমরা হত্যার বিচার চাই। যারা এই ঘটনা ঘটিয়েছে, তাদের দেখতে চাই।’

এমপি আনারের রাজনৈতিক কার্যালয়ের সিঁড়িতে বসে বিকালে কান্না করছিলেন সহযোগী রুবেল হোসেন। তিনি বলেন, ‘ভারত যাওয়ার আগে এমপির সঙ্গে সর্বশেষ কথা হয়েছিল। তখন বলেছিলেন, চেকগুলো তুলে রাখ। গরিব মানুষের চেক এগুলো। আমি ফিরে এসে চেকগুলো সব একসঙ্গে বিতরণ করবো। তিনি চলে গেলেন, এখন গরিব মানুষকে নিয়ে ভাববে কে।

সংবাদটি শেয়ার করুন....
ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক :

ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক :

About Author

etihad news is one of the famous Bangla news portals published from Abudhabi-UAE. It has begun with a commitment to fearless, investigative, informative, and independent journalism. This online portal has started to provide real-time news updates with maximum use of Smart Technology.

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *