অধিকতর সম্পদশালী হওয়ার প্রেরণা ও প্রযত্ন


ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ: কারও কারও অধিকতর ধনী হওয়ার ক্ষেত্রে, এমনকি অনেক বড় বড় অর্থনীতির দেশকে ও অঞ্চলকে টপকে এই করোনা-উত্তরকালেও আনন্দ-সর্বনাশের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার কারণ হিসেবে অব্যাহত রয়েছে। বড় বড় দাগে দুর্নীতি, অর্থ আত্মসাৎ ও বিদেশে অর্থ পাচারের প্রবণতা ও প্রবাহ চলমান থাকার প্রেক্ষাপটে নতুন জাতীয় বাজেটের মোড়ক উন্মোচিত হয়েছে। ভোজ্যতেল, জ্বালানি, বিদ্যুৎ এবং এমনকি ডলারের মূল্যবৃদ্ধির টালমাটাল অবস্থায় বেশ কিছু লক্ষণ স্পষ্ট হচ্ছে যে, অর্থনীতিতে বৈষম্য বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। ১৯৪৩-এর দারুণ দুর্ভিক্ষের প্রাক্কালে যেসব প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়েছিল তার প্রচ্ছন্ন উপস্থিতি শুধু বাংলাদেশে নয় অনেক অর্থনীতিতেও, ১৯৩০ সালের গ্রেট ডিপ্রেশন কিংবা এই নিকট অতীতে ১৯৯৭ সালের এশীয় ক্রাইসিস এবং ২০০৭-০৮ সালের অর্থনৈতিক মন্দার কারণ ও প্রভাবের ভূত দেখা যাচ্ছে। ঠিক এ সময়ে সমাজে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের আয়-ব্যয়ে স্বচ্ছতা আনয়নে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বা সংস্থায় দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে অধিষ্ঠিত কর্তাব্যক্তিদের দায়িত্ব পালনে অর্পিত ক্ষমতা প্রয়োগে প্রতিশ্রুত ও দৃঢ়চিত্ততার প্রয়োজনীয়তার প্রসঙ্গও উঠে আসছে। নিজেদের অধিক্ষেত্রে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালনের পরিবর্তে আদিষ্ট হয়ে যদি তাদের কর্মধারা পরিচালিত হয়, সেক্ষেত্রে কোনো প্রতিষ্ঠান কার্যকরভাবে জবাবদিহিমূলক ভূমিকা পালন করতে পারে না। এক্ষেত্রে স্বেচ্ছাচার ও স্বচ্ছতার অভাবে আকীর্ণ হয়ে উঠতে পারে, স্বেচ্ছচারিতার অজুহাত যৌক্তিকতা এমনকি স্বজনপ্রীতির পরিবেশ বা ক্ষেত্র তৈরি হয়। সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এটি প্রধান প্রতিবন্ধকতা।
যারা নীতি প্রণয়ন করে, নীতি উপস্থাপন করে তাদের প্রত্যেকেরই নিজস্ব দৃঢ়চিত্ততা এবং নীতি-নিয়ম পদ্ধতির প্রতি দায়িত্বশীলতা প্রত্যাশিত থেকে যাবে। তাদের মাধ্যমে, তাদের থেকে স্বচ্ছতা-জবাবদিহির নিশ্চয়তা না এলে কারও পক্ষে জবাবদিহির পরিবেশ সজন সম্ভব হয় না। সুশাসন, স্বচ্ছতা-জবাবদিহি প্রয়োজন সবার স্বার্থে, গণতন্ত্রের স্বার্থে, অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বার্থে এবং বর্তমানে পরিলক্ষিত চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলার জন্য। কারণ এটা পরস্পরের পরিপূরক। আরেকটি বিষয় নীতিনির্ধারকরা বাস্তবায়নকারীদের দিয়ে, তাদের ভুল বা ব্যত্যয়ধর্মী নীতি বা সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত করিয়ে নিতে তাদের ওপর চাপ সৃষ্টি কিংবা প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ ও তদারকির, ক্ষেত্রবিশেষে তাদের নানান সুযোগ-সুবিধা পাইয়ে দিয়ে প্রলুব্ধ করতে পারেন, তাদের স্বার্থ উদ্ধার করিয়ে নিয়ে আবার ক্ষেত্রেবিশেষে ষড়যন্ত্রের টোপে ফেলে বিব্রতও করতে পারেন। কায়েমি স্বার্থ উদ্ধারের জন্য এ ধরনের ‘রাজনৈতিক’ উৎকোচ কিংবা নিপীড়নের প্রথা প্রাচীনকাল থেকে কম-বেশি ছিল বা আছে, তবে তা মাত্রাতিক্রমণের ফলে সেটি প্রকারান্তরে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিমূলক পরিস্থিতির প্রতিবন্ধকতা হিসেবে প্রতিভাত হয়ে থাকে। যেকোনো সমাজে বা অর্থনীতিতে কতিপয়ের অস্বাভাবিক অর্থপ্রাপ্তির সুযোগ ও প্রযত্ন প্রদান বৈষম্য বৃদ্ধির অন্যতম উপসর্গ। আর এই বৈষম্য বৃদ্ধিতে নানান আত্মঘাতী প্রবণতার প্রবৃদ্ধি ঘটে।
নানান আঙ্গিকে পরীক্ষা-পর্যালোচনায় দেখা যায়, শিক্ষক-চিকিৎসক-আইনজীবী-ব্যবসায়ী এমনকি অতিক্ষমতাধর চাকরিজীবীদেরও বাঞ্ছিতভাবে জবাবদিহির আওতায় আনা সম্ভব হয় না। অতিমাত্রায় কোটারি, সিন্ডিকেট বা দলীয় বা রাজনীতিকীকরণের কারণে পেশাজীবী, সংস্থা সংগঠন এবং এমনকি সুশীল সেবকরাও প্রজাতন্ত্রের হয়ে দল-নিরপেক্ষ অবস্থানে থাকতে তাদের হিমশিম খেতে হয়, গলদঘর্ম হতে হয়। এ ধরনের পরিস্থিতিতে এমন একটা পরিবেশ তৈরি হয়, যার ছত্রছায়ায় নানাভাবে অবৈধ অর্জনের পথ সুগম হতে পারে। সেবক প্রভুতে পরিণত হলে সম্পদ আত্মসাৎ, ক্ষমতার অপব্যবহারের দ্বারা অর্জিত অর্থ দখলের লড়াইয়ে অর্থায়িত হয়ে এভাবে একটা ঘূর্ণায়মান দুষ্টচক্র বলয় হয়ে থাকে। অর্থাৎ সুশাসনের অভাবে স্বচ্ছতা-অস্বচ্ছতায় ঘুরেফিরে পুরো প্রক্রিয়াকে বিষিয়ে তোলে। সুতরাং সবক্ষেত্রে সর্বাগ্রে উচিত স্বচ্ছতা-জবাবদিহি নিশ্চিত করা। এটা প্রয়োজন গণতন্ত্র ও সার্বিক উন্নয়নের স্বার্থে। বলার অপেক্ষা রাখে না, সুশাসন স্বচ্ছতা-জবাবদিহি নিশ্চিত না হলে কোনো উন্নয়ন অর্থবহ ও টেকসই হবে না। উন্নয়নে আস্থা প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। এটা পরস্পরের পরিপূরক। স্বচ্ছতা-অস্বচ্ছতায় যে উন্নয়ন হয় তাতে জনগণের সুফল নিশ্চিত হতে হলে উন্নয়নের উপযোগিতা বা রিটার্ন দ্রুত পাওয়ার আবশ্যকতা দেখা দেবে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কোনো কাজ শেষ করার কথা এবং বরাদ্দ সেভাবেই দেওয়া আছে। কিন্তু সেই কাজ শেষ করতে যদি বছরের পর বছর সময় লেগে যায়, দ্রব্যমূল্য ও নির্মাণসামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধিজনিত কারণে ও অজুহাতে যদি তিন-চার গুণ টাকা খরচ করতে হয় সেটা তো সুশাসন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার দুর্বল পরিস্থিতিরই পরিচায়ক। আলোচ্য অর্থ দিয়ে একই সময়ে হয়তো আরও অতিরিক্ত দুটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা যেত। সময়ানুগ না হওয়া এবং দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির অজুহাতে তিন প্রকল্পের অর্থ খরচ করে একটা প্রকল্প বাস্তবায়ন করার প্রেক্ষাপটটি জনগণের কাছে ব্যাখ্যা থাকা দরকার। বলাবাহুল্য, অবকাঠামোটি যথাসময়ে নির্মিত হলে সংশ্লিষ্ট খাতে সক্ষমতা বৃদ্ধির ফলে উপযোগিতা সৃষ্টি হয়ে জিডিপিতে অবদান রাখতে পারত। যথাসময়ে নির্মাণ-উত্তর প্রাপ্য সেবা ও উপযোগিতার আকাঙ্ক্ষা হাওয়া হয়ে যাওয়ায় প্রাপ্তব্য উপযোগিতা মেলেনি যথাসময়ে। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় অধিকতর ও অতিরিক্ত ব্যয়ের টাকা যদি বেহাত হয়ে থাকে, এমন হাতে যদি যেয়ে থাকে যারা সুশাসন ও জবাবদিহির পরিস্থিতি সৃষ্টিকে অসম্ভব করে তুলতে সেই অর্থ ব্যয় করে থাকে। অধিকতর ধনীরা নীতি-নৈতিকতা ন্যায়-নীতিনির্ভরতার পরিবেশকে কলুষিত করে পুরো সমাজ ও অর্থনীতিকে দরিদ্রের মুখে ঠেলে দেয়।
জিডিপি প্রবৃদ্ধির মূল কথা হলো- যে অর্থই ব্যয় করা হোক না কেন তা আয়-ব্যয় বা ব্যবহারের দ্বারা অবশ্যই পণ্য ও সেবা উৎপাদিত হতে হবে। পণ্য ও সেবা উৎপাদনের লক্ষ্যে যে অর্থ আয় বা ব্যয় হবে সেটাই বৈধ। আর যে আয়-ব্যয় কোনো পণ্য ও সেবা উৎপাদন করে না সেটা অবৈধ, অপব্যয় বা অপচয়। জিডিপিতে তার থাকে না কোনো ভূমিকা। আরও খোলসা করে বলা যায় যে, আয় পণ্য ও সেবা উৎপাদনের মাধ্যমে অর্জিত হয় না এবং যে ব্যয়ের মাধ্যমে পণ্য ও সেবা উৎপাদিত হয় না সেই আয়-ব্যয় জিডিপিতে কোনো অবদান রাখে না। কোনো প্রকার শ্রম বা পুঁজি বিনিয়োগ ছাড়া যে আয় তা সম্পদ বণ্টন-বৈষম্য সৃষ্টিই শুধু করে না, সেভাবে অর্জিত অর্থ ব্যয়ের ক্ষেত্রেও সুশাসন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির ধার ধারা হয় না। ফলে তা সৃষ্টি করে আর্থিক বিচ্যুতি। এভাবে যে অর্থ আয় বা খরচ করা হয়, তা প্রকারান্তরে অর্থনীতিকে পঙ্গু ও পক্ষাঘাতগ্রস্ত করে।
সাম্প্রতিককালেরই আলোচ্য বিষয়, জাতীয় বাজেটে বিশেষ অ্যামনেস্টি দিয়ে কালো টাকা সাদা করার সুবিধা প্রদান এবং বিদেশে অর্থপাচার বৃদ্ধির প্রসঙ্গে অধিকতর ধনী হওয়ার আনন্দ বিষাদের প্যাথলজিক্যাল প্রতিবেদন দৃষ্টিসীমায় আসছে। সংগত কারণে এটা উঠে আসছে যে, দুর্নীতিজাত কালো টাকা লালন থেকে সরে না এলে আয় ও সম্পদ বণ্টনের বৈষম্য বাড়তেই থাকবে।
এটাও প্রণিধানযোগ্য যে, কর ইনসাফ প্রতিষ্ঠা না করলে কর আহরণে উন্নতি আসবে না। কর-জিডিপি অনুপাতে বাংলাদেশ যে তলানিতে, তার কারণটাই হলো এভাবে এ সমাজে কর এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। মানে কাউকে ট্যাক্স দিতে বাধ্য করা হচ্ছে না বলে এমনটিই হচ্ছে। দুর্নীতিজাত অর্থ অর্থনীতির মূল ধারায় আনার উদ্যোগ ইতিবাচক। কিন্তু যথাযথ হারে কর ও জরিমানা পরিশোধ করে, সময়সীমা বেঁধে দিয়ে এবং এমনেস্টি উত্তরকালে কঠোর ব্যবস্থায় যাওয়া হবে এমন প্রত্যয় প্রকাশ করে, তা আনাই হবে ন্যয় ও নীতিসংগত এবং রাজস্ব আয় বৃদ্ধির অনুকূল। এ অর্থ কীভাবে উপার্জিত হলো, কীভাবে এল, তা নিয়ে প্রযোজ্য ক্ষেত্রে বিচারের বিষয়টি এখনই আগাম ছাড় দিয়ে দিলে সম্পদ পুনর্বণ্টনের কাজটি করা কঠিন হবে। অর্থাৎ বৈষম্য উসকে দেওয়া হবে, যদি টাকা কীভাবে উপার্জিত হচ্ছে, তা নিয়ে কোনো ব্যাখ্যা বা প্রশ্নের মাধ্যমে বাধা না দেওয়া হয়, তাহলে তা হবে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিকে নিরুৎসাহিত করার নামান্তর।
দেখা যাচ্ছে, ২০১০ সালের পর থেকে বাংলাদেশের সমাজ ও অর্থনীতিতে সম্পদের একটা বিরাট বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে। জিডিপির সংখ্যাভিত্তিক পরিমাল বেড়েছে এবং সেভাবে পারক্যাপিটা জিডিপিও বেড়েছে বলে দেখানো হচ্ছে, কিন্তু বাস্তবতায় ‘গরুর হিসাব শুধু কাজির খাতায়, গোয়ালে তেমন গরু নেই’ পরিস্থিতি। ২০১৭ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশে খুব দ্রুত ধনীর সংখ্যা বাড়ছে।
করোনা-উত্তরকালে রাশিয়া-ইউক্রেন সমরের এই সম্মোহিত সময়ে দেশে দেশে জীবন ও জীবিকার সংগ্রাম সন্ধিক্ষণে আর্থসামাজিক পরিবেশ-পরিস্থিতিতে যে উদগ্র উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে এবং আসন্ন মন্দায় মানবিক বিপর্যয়ের যে ইশারা বা লক্ষণ দেখা দিচ্ছে সে প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে আয় বৈষম্যের উপসর্গটি বিষফোড়ায় যেন পরিণত না হয় সে প্রত্যাশা প্রবল হওয়াই স্বাভাবিক। প্রকৃতির প্রতিশোধ প্রতিক্রিয়ায় মানবভাগ্যে মহামারি বিপর্যয় আসে, বৈশ্বিক বিপর্যয় প্রতিরোধ নিয়ন্ত্রণ নিরাময়ের নামে মনুষ্যসৃষ্ট রাজনৈতিক অর্থনীতির সমস্যাগুলো ঘৃতে অগ্নিসংযোগের শামিল হয়ে দাঁড়ায়।
লেখক : সাবেক সচিব ও এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান