মতামত

কেঁচো খুঁড়তে সাপ: ছাগলে বাপ!

news 1718993622733
print news

মোস্তফা কামাল: উচ্চপদস্থ রাজস্ব কর্মকর্তা ড. মতিউর রহমানকে জনে জনে বলতে হচ্ছে, তিনি ১৫ লাখ টাকায় ছাগল কিনে ভাইরাল হওয়া ছেলেটির পিতা নন। ছাগল, পিতৃত্ব বা ১৫ লাখ টাকা আসলে বিষয় নয়। তার আরও কটা বিবি-বাচ্চা আছে তাও ঘটনা নয়। ছাগল আর বাপ খুঁজতে গিয়ে এখন অনেকটা কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে একে একে সাপ বের হয়ে আসছে। আজিজ, বেনজীর, আছাদুজ্জামান মিয়া, ওয়াহিদা, মতিউররাই শেষ। এ সিরিজে এরপর আর কেউ নেই?

মানুষ বা ছাগল কেউই ফাদারলেস নয়। কারও না কারও ঔরসই সবার জন্ম। এ নিয়ে বিতর্কের কিছু নেই। দুনিয়ার কোনো সন্তানই বাপহীন নয়। তা ছাগলের বাচ্চা হলেও। পাঁঠারা তা মনে রাখতে পারে না, বা স্বীকার করার সময় হয় না। মায়েদের কলিজা কাঁদে। ছাগলদেরও এখন এসব শুনে হাসি আসতে পারে। কারণ আগের দিন আর নেই। কোটিতে গরু, লাখে ছাগল, মুরগি হাজার পার। টাকা এখন পদওয়ালাদের পিছু ঘোরে। তা যে কয়েক পায়েরই হোক। নিত্যপণ্যের বাজারের আগুনসহ জরুরি নানান ঘটনা ভুলিয়ে নাগরিকদের ছাগলচর্চায় ব্যস্ত থাকা কারও কারও জন্য সুবিধার বিষয়ও হতে পারে।

আলোচিত রাজস্ব কর্মকর্তা মতিউর রহমান তার এক বিবির সন্তানকে ‘চেনেন না’ বলার মধ্যে সমালোচনার তত উপাদান নেই। ‘দেখিলে চিনিব’ বলেও তো একটা কথা আছে। আফ্রিকার অনেক গোত্রপ্রধানও নিজের সব সন্তানের চেহারা মনে রাখতে পারেন না, পত্নী-উপপত্নীদের নাম মনে রাখতেই তাদের মেমোরি ফুল লোড হয়ে যায়। মায়েরা শুধু জানেন কোন সন্তানের বাবা কে? গরু হারানো যাওয়ায় গোপাল ভাঁড়ের বৌকে মা ডাকার গল্প অনেকেরই জানা। বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গের কোনো কোনো জায়গায়ও জমিজিরাতসহ নানান কিছু রক্ষার স্বার্থে বিয়ের পর বিয়ে করে নিশ্চিন্ত হওয়ার একটা সমাজস্বীকৃত ব্যবস্থা ছিল। তারাও সব সন্তানকে চিনতেন না। সন্তানরা এসে পরিচয় দিত সে কোন ঘরের। এ নিয়ে বহু হাস্যরসের কাহিনি রয়েছে। চট্টগ্রামের এক খানদানি-বনেদি ছিলেন, রাজনীতিতে তিনি কিংবদন্তির মতো। বলা হয়ে থাকে, অধিক বিয়ের কারণে অধিক সন্তানের জনক ছিলেন তিনি। কখনো কখনো দেখামাত্র সবাইকে চিনতে পারতেন না। তাই জানতে চাইতেন, এই সন্তান কোন ঘরের। ‘তুঁই খারার ফোঁয়া ওঁয়াও’।

মাঝেমধ্যে ঘটনাচক্রে এ ধরনের দুয়েকটা ভাইরাল হয়ে গেলে আইজি আর ইন্সপেক্টর তুলনা করার সময়ও হয় না। পদপদবি মনেও থাকে না। নজিরবিহীন মিয়াদের হাতে এত এত সম্পদের বিবরণ শোনার বেশি আর কীইবা সাধ্য আছে আমজনতার। ওই মিয়াদের মধ্যে দেশের প্রতিচ্ছবি দেখে এই জনতারা। আর ভাবে, মিয়া ও মিয়ার বিবি-বাচ্চাদের কেন সবাই মাথায় তুলে রাখে?

রাজনীতিকদের আয়-উন্নতি বৃদ্ধির একটা হাস্যকর নমুনা তবুও মেলে জাতীয় এবং স্থানীয় নির্বাচনের আগে। সেটার নাম হলফনামা। আর হলফনামা কিন্তু আমলনামা নয়। বলাই হয়, হলফনামা প্রদর্শন। মানে দেখানো। শ্বশুরবাড়ি থেকে পাওয়া, বাপের দেওয়া গহনা, সম্পদ, মাছের খামার ইত্যাদির একটা হিসাব তারা দেখান। নির্বাচন কমিশন সেটা দেখে। আর তা জেনে মানুষ একটু বিনোদিত হয়। বেনজীর-আছাদুজ্জামান, মতিউর ইত্যাদি মিয়াদের অর্থনৈতিক জন্মের ফেরও কিছুটা ওই রকমেরই। তবে নমুনায় কিছুটা বাংলা সিনেমার শাকিব খানের পিতৃত্ব স্বীকার টাইপের। সন্তানের বাবার দায়িত্ব শাকিব খানের ওপর চাপিয়ে বসলে তিনি শেষতক অস্বীকার করেন না। মাঝেমধ্যেই বিভিন্ন ঘরে জন্মানো ছেলের দায়িত্ব পড়ে শাকিব খানের ওপর। কচলে ধরলে বেচারা শাকিবও ‘না’ করতে পারেন না। এর আগে কয়েকটা দিন বলেন, এ সন্তান আমার নয়। অথবা ওকে বা ওর মাকেও চিনি না। পরে ‘দেখিলে চেনেন’। কোলে তুলে নেন। আজিজ-বেনজীরদের ক্ষমতাসীনরা বলেন, ওরা আমাদের দলের কেউ না।

 

আরও পড়ুন:

৫২ লাখ টাকার কোরবানি দিয়ে ভাইরাল এনবিআর কর্মকর্তার ছেলে

মতিউর রহমানের শত কোটি টাকার সম্পদের খোঁজ!

এনবিআর কর্মকর্তা ড.মতিউর কীভাবে এত সম্পদের মালিক!

এনবিআরের মতিউরের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ ও অর্থ পাচারের অভিযোগ

কথা তো আলবত সত্য। আজিজ-বেনজীর-মতিউর-আছাদুজ্জামানরা সত্যিই দলের কেউ নন। দলের কোনো পদে নেই তারা। এখন ছাগল খোঁজার ঘটনার অসিলায় আলাদিনের চেরাগের কিছু বাড়তি তথ্য মিলছে মাত্র। কদিন ঘুরেছে বেনজীরের আলাদিনের চেরাগের কিচ্ছা। আছাদুজ্জামান মিয়া-ওয়াহিদার কাহিনি ঘুরতে ঘুরতে এখন মতিউরপুত্রের ছাগলকাণ্ড থেকে শেয়ারবাজার কাণ্ডকীর্তি। নানান ইস্যুর বাঁকে ও ফাঁদে সামনে হয় তো অন্য কোনো ঘটনা চলে আসবে। এসব আজিজ, বেনজীর, মতিউর তখন হয়তো তামাদি হয়ে যাবে। বনের রাজা গনি, স্বাস্থ্যের মিঠু, ড্রাইভার মালেক, ডা. সাবরিনা, সাহেদ বা সম্রাটের ক্যাসিনোকাণ্ডসহ আরও কত ঘটনা মানুষ দিব্যি ভুলে গেছে। মনে করিয়ে দিলে চটে যাওয়ার লোকও আছে। মানুষের এ ভুলে যাওয়াটাও এই আলাদিন এবং চেরাগ আলীদের জন্য একটি আশীর্বাদ। গটদের দড়ির ওপাশে থাকা গডফাদারদের জন্য আরও আশীর্বাদের। তারা যখন যাকে দরকার মাথায় হাত বোলাবেন। দরকারে ছুড়ে ফেলবেন। বলবেন, তিনি এ সন্তানের জনক নন। আবার সময়দৃষ্টে কাছে টেনে নেবেন। ততক্ষণে মানুষ আগের সব কীর্তি ভুলে যাবে। আর শত শত ইফাদের বাপ গজাবে সোনার বাংলায়। বাড়বে বংশীয় ছাগলের ফলন। পাঁচসিকার ছাগল বলা যাবে না তাদের।

মানুষের বিনোদিত হওয়া ছাড়া গতিও নেই। কথায় বলে—‘অল্প শোকে কাতর, অধিক শোকে পাথর।’ প্রবাদটিতে বলা হয়নি, অধিক শোক স্থায়ী হয়ে গেলে মানুষ সবকিছুতেই হাসে। চারপাশের ছাগলামি দেখতে দেখতে অনেকে ওই আলফা লেভেলে চলে গেছেন। মাঝেমধ্যে ঘটনাচক্রে দুয়েকটার তীব্রতা বেশি হলে বা ভাইরাল হলে তখন একটু মোচড়ামুচড়ি দেয়। আর আলাদিনের চেরাগ কাহিনিতে মত্ত হয়। দুয়েকটা বোয়াল ধরায় মুগ্ধ হয়। নজিরবিহীন মিয়াদের এবার আর নাজাত নেই মনে করে কয়েকটা দিন পার করে। ক্রোড়পতি-কোটিপতির আলাপ তাদের বেশ পছন্দ। এক সময় হতো হাজারি-লাখির আলাপ। এখন কোটির নিচে কথা নেই। পথেঘাটে কোটিপতি এখন ছড়ানো-ছিটানো। সংখ্যায় মাঝেমধ্যে তাদের হেরফের হয় মাত্র।

বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, চলতি বছর মার্চ পর্যন্ত ১ কোটি টাকার বেশি আমানত রয়েছে এমন ব্যাংক হিসাব রয়েছে ১ লাখ ১৫ হাজার ৮৯০টি। এসব ব্যাংক হিসাবে মোট জমা আছে ৭ লাখ ৪০ হাজার ১৫০ কোটি টাকা। গত বছর ডিসেম্বর পর্যন্ত ১ কোটি টাকার বেশি আমানত রয়েছে এমন ব্যাংক হিসাবের সংখ্যা ছিল ১ লাখ ১৬ হাজার ৯০৮, মোট জমা ছিল ৭ লাখ ৪১ হাজার ৪৬২ কোটি টাকা। দেশের ব্যাংক খাতের মোট আমানতের ৪২ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ, যা গত ডিসেম্বরে ছিল ৪২ দশমিক ৪ শতাংশ। চলতি বছর মার্চ শেষে ব্যাংক খাতে মোট আমানতকারীর সংখ্যা ছিল ১৫ লাখ ৭১ হাজার ২০২। এসব হিসাবের বিপরীতে আমানত জমা ছিল ১৭ লাখ ৬২ হাজার ৩০৩ কোটি টাকা। ব্যাংকের হিসাবে কোটিপতির সংখ্যা কিছু কমেছে। এসব কোটিপতির সবার সামর্থ্য সমান নয়, ফলে সবার হিসাবে টাকার পরিমাণও কমবেশি আছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর মার্চ পর্যন্ত ১ কোটি ১ টাকা থেকে ৫ কোটি টাকার আমানতকারীর হিসাব সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৯১ হাজার ৬২৩। যেখানে জমা ছিল ১ লাখ ৯৪ হাজার ৫১৭ কোটি টাকা। ৫ কোটি ১ টাকা থেকে ১০ কোটির ১২ হাজার ৪৪৬টি হিসাবে জমার পরিমাণ ৮৮ হাজার ৫৬৮ কোটি টাকা। ১০ থেকে ১৫ কোটি টাকার অ্যাকাউন্ট ৪ হাজার ৩৯৬টি, ১৫ থেকে ২০ কোটির মধ্যে ১ হাজার ৯৬১টি, ২০ থেকে ২৫ কোটির মধ্যে ১ হাজার ২১১টি। ২৫ থেকে ৩০ কোটির মধ্যে রয়েছে ৮৭৫টি আমানত হিসাব। আর ৩০ থেকে ৩৫ কোটি টাকার ৫০১টি, ৩৫ থেকে ৪০ কোটির টাকার ৩৬৯টি ও ৪০ থেকে ৫০ কোটি টাকার হিসাব সংখ্যা ৬৮১টি। ৫০ কোটি টাকার বেশি রাখা অ্যাকাউন্টের সংখ্যা ১ হাজার ৮২৬। এটি মোটেই দেশে প্রকৃত কোটিপতির সঠিক হিসাব নয়। সবাই সব টাকা ব্যাংকে রাখেন না। এই অমিলেই এগিয়ে চলা।

দেশের অর্থনীতি অবশ্যই বড় হচ্ছে। স্বাধীনতার পর যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে বাহাত্তর সালে কোটিপতির সংখ্যা ছিল মাত্র পাঁচজন। তিয়াত্তরে দুর্ভিক্ষের বছরও কোটিপতির সংখ্যা বৃদ্ধিতে ছেদ পড়েনি। পঁচাত্তরে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৪৭ জনে। পাঁচ বছর পর ১৯৮০ সালে দেশে কোটিপতি বনে যান ৯৮ জন। ১০ বছর পরের হিসাবে দেখা যায়, কোটিপতির সংখ্যা ১৯৯০ সালে ৯৪৩ জন। ২০০১ সালে ৫ হাজার ১৬২ জনে। ২০০৮ সালে ১৯ হাজার ১৬৩। এভাবে বাড়তে বাড়তে ২০১৫ সালে কোটিপতির সংখ্যা দাঁড়ায় ৫৭ হাজার ৫১৬। এরপর ২০১৯ সাল থেকে দেশে কোটিপতির সংখ্যা বৃদ্ধির এক আচানক উল্লম্ফন। ২০২০ সালে এ সংখ্যা বেড়ে হয় ৯৩ হাজার ৮৯০ জন। ২০২১ সালে ১ লাখ ১ হাজার ৯৭৬ জন। ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত কোটিপতি আমানতকারীর সংখ্যা হয়ে যায় ১ লাখ ৯ হাজার ৯৪৬টি। করোনা মহামারিও তা রুখতে পারেনি। সর্বশেষ ২০২৪ সালের মার্চ মাসে এ সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১৫ হাজার ৮৯০টি। তারা কারা? ধারণাও কি করা যায় না? ব্যাংক হিসাবের বাইরে থাকা চেরাগের হিসাব আলাদা। তাদের জন্য এ দেশ অবশ্যই স্বর্গভূমি। নিঃসন্দেহে এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো মিয়া সাহেবরা। এখানে কেঁচো বা ছাগল যা-ই খোঁজা হবে, এর কূল-কিনারা মিলবে না। পেছনের দড়িটা শুধু বোঝা যাবে। ধরা যাবে না, ছোঁয়া যাবে না।

লেখক: ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন

 

* সর্বশেষ  গুরুত্বপূর্ণ  সব  সংবাদ, ছবি ,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও লেখা পেতে আমাদের  ফেসবুক পেইজে  লাইক  দিয়ে  অ্যাকটিভ  থাকুন।  ভিজিট করুন : http://www.etihad.news

* অনলাইন  নিউজ পোর্টাল  ইত্তেহাদ নিউজে  লিখতে  পারেন  আপনিও। লেখার বিষয়  ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন  [email protected] ঠিকানায়

সংবাদটি শেয়ার করুন....
ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক :

ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক :

About Author

etihad news is one of the famous Bangla news portals published from Abudhabi-UAE. It has begun with a commitment to fearless, investigative, informative, and independent journalism. This online portal has started to provide real-time news updates with maximum use of Smart Technology.

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *