বাংলাদেশ ঢাকা

ছাগলকাণ্ডে বেরিয়ে এলো টাকার কুমির মতিউর

news 1718993622733
print news

ইত্তেহাদ নিউজ,ঢাকা : কোরবানির জন্য ১৫ লাখ টাকা দিয়ে একটি ছাগল কেনার কাণ্ডে আলোচনায় আসেন মুশফিকুর রহমান ইফাত নামের এক যুবক। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তুমুল আলোচনাশুরু হয়। বলা হয়, তার বাবা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সদস্য এবং কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট আপিলাত ট্রাইব্যুনালের প্রেসিডেন্ট মতিউর রহমান। এরপর আলোচনা চলে মতিউর রহমান ও তার পরিবারের সদস্যদের কোথায় কী পরিমাণ সম্পদ রয়েছেÑ এসব নিয়ে। এসব আলোচনার মধ্যে একের পর এক বেরিয়ে আসছে মতিউর পরিবারের বিপুল বিত্তবৈভবের চাঞ্চল্যকর তথ্য। বিভিন্ন তথ্যসূত্র বলছে, অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে টাকার কুমির বনে গেছেন মতিউর।

এমন পরিস্থিতিতে মতিউরের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) সম্প্রতি জমা পড়া একটি অভিযোগ যাচাই-বাছাইয়ের পর অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত হয়। শিগগিরই এ বিষয়ে অনুসন্ধান টিম গঠন করা হবে বলে জানা গেছে। এ বিষয়ে সুষ্ঠু অনুসন্ধান প্রত্যাশা করছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।

এদিকে ছাগলকাণ্ডে আলোচনায় আসা ইফাত তার সন্তান নয়, বলছেন মতিউর রহমান। যদিও এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তার বিরুদ্ধে বইছে নানা তির্যক বাক্যবাণ। এ ছাড়া গত বৃহস্পতিবার ফেনী-২ আসনের এমপি নিজাম হাজারীও বলেছেন, মতিউর রহমানেরই ছেলে ইফাত। এ বক্তব্য খণ্ডনে মতিউর মুখ খোলেননি।

যার দুর্নীতি-অপকর্ম নিয়ে দেশজুড়ে এত আলোচনা-গুঞ্জন, সেই মতিউর রহমানের কাছে তার বক্তব্য জানতে মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল দেওয়া হলেও অপর প্রান্তের সাড়া মেলেনি। খুদেবার্তা পাঠিয়েও সায় মেলেনি তার।

মতিউরনামা

মতিউর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন্যান্স বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। ১৯৯০ সালে পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশনে (পিকেএসএফ) কর্মজীবন শুরু হয় তার। ১৯৯৩ সালের এপ্রিলে যোগ দেন কাস্টমস বিভাগে। ১৯৯৬-৯৭ সালে বেনাপোল বন্দর কাস্টমসের সহকারী কমিশনারের দায়িত্বে ছিলেন। ২০০৯ সালে তিনি তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানকের ব্যক্তিগত সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ওই বছরই তিনি চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের যুগ্ম কমিশনার হন। ২০১৫ সালে পদোন্নতি পেয়ে হন কমিশনার। পরে গুরুত্বপূর্ণ একাধিক দপ্তরে পদায়ন হয় তার। তিনি বৃহৎ করদাতা ইউনিট (এলটিইউ) ভ্যাটের কমিশনার ছিলেন। ২০২১ সালে তাকে কাস্টমস, এক্সসাইজ ও ভ্যাট আপিলাত ট্রাইব্যুনালে সদস্য (টেকনিক্যাল) হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। চলতি বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি থেকে তিনি এ ট্রাইব্যুনালের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেন। সোনালী ব্যাংকের পরিচালক পদেও রয়েছেন মতিউর।

আরও পড়ুন:

৫২ লাখ টাকার কোরবানি দিয়ে ভাইরাল এনবিআর কর্মকর্তার ছেলে

মতিউর রহমানের শত কোটি টাকার সম্পদের খোঁজ!

এনবিআর কর্মকর্তা ড.মতিউর কীভাবে এত সম্পদের মালিক!

এনবিআরের মতিউরের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ ও অর্থ পাচারের অভিযোগ

 

৩১ বছরেরও বেশি সরকারি চাকরিকালে মতিউরের বিরুদ্ধে পাঁচবার দুদকে অভিযোগ জমা পড়ে। ২০০০ সালে প্রথম একটি অভিযোগের ভিত্তিতে অনুসন্ধান করে দুদক। কিন্তু তথ্যপ্রমাণ না পাওয়ায় সে যাত্রায় অব্যাহতি পান তিনি। এরপর আরও তিনবার তার বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। কিন্তু প্রতিবারই তথ্যপ্রমাণের অভাবে আইনের ফাঁক গলে বেরিয়ে যান। ২০০৮, ২০১৩ ও ২০২১ সালে এ তিনটি অভিযোগ পরিসমাপ্তির ঘোষণা দেয় দুদক।

সর্বশেষ, চলতি মাসের শুরুতে পঞ্চমবারের মতো মতিউরের বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের একটি অভিযোগ জমা পড়েছে দুদকে। দুদকের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা আমাদের সময়কে জানান, অভিযোগটি যাচাই-বাছাই কমিটির মাধ্যমে খতিয়ে দেখা হয়েছে। কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্তও গ্রহণ করা হয়েছে। শিগগিরই অনুসন্ধান টিম গঠন করা হবে। তিনি যোগ করেন, ইতিপূর্বে মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে চারবার অভিযোগ জমা পড়লেও তথ্যপ্রমাণের অভাবে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি।

বেরিয়ে আসছে বিত্তবৈভবের চাঞ্চল্যকর তথ্য

এনবিআর সদস্য মতিউর রহমান দুই বিয়ে করেছেন। প্রথম স্ত্রীর নাম লায়লা কানিজ লাকি। তিনি নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান। তাদের এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে। তারা হলেন তৌফিকুর রহমান অর্ণব ও ফারজানা রহমান ইপসিতা।

লায়লা কানিজ লাকি সরকারি কলেজের সহযোগী অধ্যাপক ছিলেন। পরে চাকরি ছেড়ে রাজনীতিতে যোগ দেন। কথিত আছে, তিনি স্বামীর পদ-পদবির প্রভাব খাটিয়ে ২০২৩ সালে অনুষ্ঠিত উপনির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। এর আগে, একই প্রভাবে নরসিংদী জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও দুর্যোগবিষয়ক সম্পাদকের পদও বাগিয়ে নেন লায়লা। লাকির নামে নরসিংদীর রায়পুরার মরজালে বিশাল এলাকাজুড়ে ‘ওয়ান্ডার পার্ক’ নামে একটি রিসোর্ট রয়েছে। এ ছাড়াও নরসিংদীর নাগরিয়াকান্দির গোল্ডেন স্টার পার্কে রয়েছে অংশীদারত্ব। তার নামে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় বহুতল ভবন রয়েছে। এই পরিবারের সদস্যদের নামে টঙ্গীতে এসকে ড্রিম ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেডসহ অন্তত এক ডজন কোম্পানিতে বিনিয়োগ রয়েছে বলে জানা যায়। পুঁজিবাজারের ব্রোকারেজ হাউসের অংশীদারত্ব রয়েছে এই পরিবারের। মতিউর রহমান অঢেল সম্পত্তি কিনেছেন তার প্রথম স্ত্রীর সূত্রে শ্বশুরবাড়ি নরসিংদীতেও। ঢাকা, ময়মনসিংহের ত্রিশাল ছাড়াও গাজীপুরের পূবাইলে রিসোর্ট, শুটিংস্পট, বাংলো বাড়ি, জমিসহ নামে-বেনামে রয়েছে অঢেল সম্পদ। বরিশালেও রয়েছে তার সম্পদ। শুধু দেশে নয়, বিদেশেও বাড়ি রয়েছে তার। তার ছেলের রয়েছে বিশ্বের নামিদামি ব্র্যান্ডের গাড়ির কালেকশন। এ ছাড়া লাকির নামে পার্ক-রিসোর্ট থেকে শুরু করে রয়েছে বাণিজ্যিক এলাকায় কোটি কোটি টাকার জমি-প্লট। এ ছাড়া রাজধানীর বসুন্ধরার ডি ব্লকের ৭/এ রোডের ৩৮৪ নম্বর বাড়িতে স্ত্রী লায়লা কানিজের নামে রয়েছে একটি ফ্ল্যাট।

এ ছাড়া রাজধানী ঢাকা, সাভার, গাজীপুর সদরের সাড়ে আটশ শতক জমি রয়েছে। সম্পত্তি গড়তে গিয়ে জায়গা দখলের অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে।প্রাপ্ত তথ্য বলছে, মতিউরের দ্বিতীয় স্ত্রীর সন্তান মুশফিকুর রহমান ইফাত। ফেসবুকে মতিউরের সঙ্গে ইফাতের যুগলবন্দি অনেক ছবিও দেখা গেছে। ইফাতের পোস্ট করা ছবি ও ভিডিওর মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া দুটি গাড়ির রেজিস্ট্রেশন তার পারিবারিক মালিকানাধীন কোম্পানি এসকে ট্রিমস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড ও গ্লোবাল ম্যাক্স প্যাকেজিং ইন্ডাস্ট্রিজের নামে। এই দুটি প্রতিষ্ঠানের মালিকানায় রয়েছেন প্রথম স্ত্রীর দুই সন্তান অর্ণব ও ইপসিতা। ইপসিতার কানাডায় ল্যাম্বারগিনি নামে বিলাসবহুল গাড়ি ব্যবহারের ছবিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। যার দাম বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৪ কোটি টাকা।

সুষ্ঠু অনুসন্ধান প্রত্যাশা টিআইবির

মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগের সুষ্ঠু অনুসন্ধান প্রত্যাশা করে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান আমাদের সময়কে গতকাল বলেন, তদন্তে যদি দেখা যায় কেউ অসামঞ্জস্য সম্পদ অর্জন করেছেন, তিনি যে-ই হোন, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। তিনি বলেন, এ ক্ষেত্রে নির্মোহ থেকে, কোনো প্রকার চাপের ঊর্ধ্বে থেকে, অভিযুক্তের প্রাতিষ্ঠানিক পরিচয় ও পদ-পদবি বিবেচনায় না নিয়ে মানদণ্ড বজায় রেখে দুদক দায়িত্ব পালন করবে বলে আমাদের প্রত্যাশা।

প্রসঙ্গত, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ইফাতের পোস্ট করা ভিডিওতে ঈদুল আজহা উপলক্ষে কোরবানির জন্য ৩৭ লাখ টাকায় একটি গরু এবং ১৫ লাখ টাকায় ছাগল কেনার তথ্য ওঠে আসে। এ খবর দ্রুতই ছড়িয়ে পড়ার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঝড় ওঠে। এ যুবক এত টাকা কোথায় পেলেন? এমন প্রশ্ন সামনে রেখে একের পর এক আলোচনার ঝড় ওঠে এবং একপর্যায়ে খবরের কেন্দ্রে চলে আসেন সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা মতিউর রহমান।

 

* সর্বশেষ  গুরুত্বপূর্ণ  সব  সংবাদ, ছবি ,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও লেখা পেতে আমাদের  ফেসবুক পেইজে  লাইক  দিয়ে  অ্যাকটিভ  থাকুন।  ভিজিট করুন : http://www.etihad.news

* অনলাইন  নিউজ পোর্টাল  ইত্তেহাদ নিউজে  লিখতে  পারেন  আপনিও। লেখার বিষয়  ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন  [email protected] ঠিকানায়

সংবাদটি শেয়ার করুন....
ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক :

ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক :

About Author

etihad news is one of the famous Bangla news portals published from Abudhabi-UAE. It has begun with a commitment to fearless, investigative, informative, and independent journalism. This online portal has started to provide real-time news updates with maximum use of Smart Technology.

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *