অন্ধকার জগতের ‘লেডি ডন’ পাপিয়ার উত্থান যেভাবে


ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক : কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারে দীর্ঘদিন বন্দি থাকার পর জামিনে মুক্তি পেয়েছেন নরসিংদী জেলা যুব মহিলা লীগের বহিষ্কৃত নেত্রী শামীমা নূর পাপিয়া। সোমবার সন্ধ্যা ৬টার দিকে তিনি কারাগার থেকে মুক্তি পান। জেল সুপার আবদুল্লাহ আল মামুন বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, সোমবার সন্ধ্যা ৬টায় পাপিয়াকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। জামিনের সব কাগজপত্র যাচাই-বাছাই শেষে কারামুক্ত করা হয় তাকে। এর আগে, কাশিমপুর কারাগারে ছিলেন পাপিয়া। সেখানে এক নারী বন্দির ওপর নির্যাতনের অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। ২০২৩ সালের ৩ জুলাই তাকে গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় মহিলা কারাগার থেকে কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারে স্থানান্তর করা হয়। ২০২০ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে জাল টাকা বহন এবং অবৈধ টাকা পাচারের অভিযোগে পাপিয়াসহ চার জনকে গ্রেফতার করে র্যাব।
পাপিয়ার উত্থান যেভাবে……….
অভিজাত এলাকায় জমজমাট নারী ব্যবসাসহ ভয়ঙ্কর সব অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত শামীমা নূর পাপিয়া। এই নারী রাজধানীর অভিজাত এক পাঁচ তারকা হোটেলে বিশাল অঙ্কের বিল পরিশোধ করতে গিয়ে গোয়েন্দাদের চোখে পড়েন। একের পর এক বেরিয়ে আসতে থাকে তার সব অপকর্মের কাহিনী। জানা যায়, আলোচিত এ নারী নরসিংদী জেলা যুব মহিলা লীগের বহিষ্কৃত সাধারণ সম্পাদক। তার স্বামী মফিজুর রহমান চৌধুরী সুমন।
আরও পড়ুন: আলোচিত নেত্রী পাপিয়া কারাগার থেকে মুক্তি পেলেন
পাঁচ তারকা হোটেলে নারী ও মাদক ব্যবসাই পাপিয়ার আয়ের মূল উৎস। দেশের অভিজাত কিছু মানুষ ও বিদেশিরাই এর গ্রাহক। ইন্টারনেটে স্কট সার্ভিস খুলে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে শিক্ষিত সুন্দরী তরুণীদের সংগ্রহ করে খদ্দেরদের কাছে পাঠাতেন পাপিয়া। পাপিয়ার সব কর্মকাণ্ডের অন্যতম অংশীদার তার স্বামী মফিজুর রহমান চৌধুরী সুমন। নরসিংদী শহর ছাত্রলীগের সাবেক আহ্বায়ক সুমন এক সময় নরসিংদীর প্রয়াত পৌর মেয়র লোকমানের বডিগার্ড ছিলেন।
নরসিংদীবাসী জানান, নরসিংদী শহরের ব্রাক্ষন্দী মহল্লার মতিউর রহমানের ছেলে মফিজুর রহমান চৌধুরী সুমন। শৈশব থেকেই সন্ত্রাস কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন সুমন। ২০০৯ সালে প্রেমের সম্পর্কে পর পাপিয়া চৌধুরীকে বিয়ে করেন সুমন। এরপর রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন পাপিয়া।
২০১৮ সালে নরসিংদী জেলা যুব মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদক হন পাপিয়া। নরসিংদীর শহরের ভাগদী এলাকায় কেএমসি কার ওয়াশ নামে একটি গাড়ির সার্ভিস সেন্টার রয়েছে তার স্বামী সুমনের। পাপিয়ার স্বামী সুমনের ঢাকায় সন্ত্রাসের পাশাপাশি অস্ত্র ব্যবসার সঙ্গেও সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগ রয়েছে। নরসিংদীতে রয়েছে সুমন ও তার স্ত্রী পাপিয়ার বিশাল কর্মীবাহিনী। মাঝেমধ্যেই তারা বিশাল শোডাউন দেন আওয়ামী লীগের মিছিল-মিটিংয়ে।

কে এই পাপিয়া?…………………..
নরসিংদী জেলা যুব মহিলা লীগের বহিষ্কৃত সাধারণ সম্পাদক শামীমা নূর পাপিয়া চৌধুরী পিউ ও তার স্বামী মফিজুর রহমান চৌধুরী সুমন ওরফে মতি সুমনের নাম এখন সবার মুখে। রাজনীতির আড়ালে অস্ত্র, মাদক ও দেহব্যবসা করে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন এ দম্পতি।
অবৈধ অস্ত্রের ব্যবসা, রাজধানীর অভিজাত হোটেলগুলোতে সুন্দরী তরুণী সরবরাহ, মাদক চোরাচালান, চাকরির তদবির, জবরদখল, দেশ-বিদেশে ক্যাসিনো ব্যবসা– এমন কোনো অভিযোগ নেই যা তার বিরুদ্ধে নেই। সুন্দর অবয়বের আড়ালে পাপিয়ার পাপের সাম্রাজ্য আড়ালেই ছিল। দেশবাসীর কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠে তার অপরাজ জগতের বিস্তৃতি।
গ্রেফতারের পর পাপিয়ার মোবাইল ফোন তদন্ত করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তার ফোনটি অশ্লীল ভিডিওতে ঠাসা। এসব ভিডিওতে সুন্দরী তরুণীদের সঙ্গে উঠতি শিল্পপতি ও ব্যবসায়ী ছাড়াও আমলা এবং কয়েকজন রাজনৈতিক নেতার অশ্লীল ছবি রয়েছে। এরই মধ্যে কয়েকটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে।
রাজনীতির আড়ালে মাদক ও নারীদের নিয়ে ‘বাণিজ্য’ করতেন পাপিয়া। রাজধানীর তারকা হোটেলগুলোয় মাঝেমধ্যেই ‘ককটেল পার্টি’র আয়োজন করতেন। এসব পার্টিতে উপস্থিত হতেন সমাজের উচ্চস্তরের লোকজন। মদের পাশাপাশি পার্টিতে উপস্থিত থাকত উঠতি বয়সী সুন্দরী তরুণীরা।
মদের নেশায় টালমাটাল আমন্ত্রিত অতিথিদের সঙ্গে কৌশলে ধারণ করা হতো ওই তরুণীদের অশ্লীল ভিডিও। পরে ওইসব ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে দেয়ার ভয় দেখিয়ে বিভিন্ন সময়ে মোটা অঙ্কের অর্থ দাবি করতেন পাপিয়া। বনিবনা না হলেই ফেসবুকে ছড়িয়েও দেয়া হতো।
পাপিয়ার কাছ থেকে বেরিয়ে আসছে একের পর এক মাথা ঘুরিয়ে দেয়া খবর। পাপিয়ার অপকর্মের সঙ্গীদের ধরতে এরই মধ্যে একাধিক অভিযান চালানো হয়েছে। অভিযান চলছে।

রাজধানীর ফার্মগেটে ইন্দিরা রোডে পাপিয়ার বাসায় অভিযান চালিয়ে ১টি বিদেশি পিস্তল, ২টি ম্যাগাজিন, ২০ রাউন্ড গুলি, ৫ বোতল বিদেশি মদ, ৫৮ লাখ ৪১ হাজার টাকা, ৫টি পাসপোর্ট, ৩টি চেক, বেশকিছু বিদেশি মুদ্রা ও বিভিন্ন ব্যাংকের ১০টি এটিএম কার্ড উদ্ধার করা হয়।
গ্রেফতারের পর পরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যায় বাইজি সর্দারনী বেশে পাপিয়ার অশ্লীল ভিডিও। ইতিমধ্যে তার অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের কথা বের হতে শুরু করেছে। মুখ খুলতে শুরু করেছেন সাধারণ মানুষ।
সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, পতিতা ব্যবসার পাশাপাশি ব্ল্যাকমেইল করে পাপিয়া ও তার স্বামী গড়ে তুলেছেন সম্পদের পাহাড়। অনৈতিক কার্যকলাপের ভিডিও ধারণ করে ধনাঢ্য ব্যক্তিদের কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নিতেন তারা। অপরাধে জড়িয়ে পড়া পাপিয়াকে ইতোমধ্যে সংগঠন থেকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করা হয়েছে। ক্ষমতাসীন দলের নেতারা বলছেন– পাপিয়ার পাপের শাস্তি তাকে বহিষ্কারের মধ্যেই সীমিত থাকবে না। তার বিচার রাজনৈতিক পরিচয়ে নয়, হবে অপরাধ বিবেচনায়।
চাকরিপ্রত্যাশী নারীদের দেহব্যবসায় বাধ্য করতেন শামীমা নূর পাপিয়া। আর অনৈতিক কর্মের ভিডিও ধারণ করে ব্যবসায়ীদের ব্ল্যাকমেইল করতেন। এ দুই উপায়ে তিনি শত শত কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। অস্ত্র ও মাদক মজুদের পাশাপাশি কিউঅ্যান্ডসি নামে ক্যাডার বাহিনীও গঠন করেছেন।
তিনি জানান, পুলিশের এসআই ও বাংলাদেশ রেলওয়ের বিভিন্ন পদে মানুষকে চাকরি দেয়ার কথা বলে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন গ্রেফতার হওয়া পাপিয়া ও তার স্বামী সুমন। শুধু তাই নয়, জমির দালালি, সিএনজি পাম্পের লাইসেন্স দেয়া, গ্যাসলাইন সংযোগের নামেও সাধারণ মানুষের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন তারা। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন ব্যাংকে নামে-বেনামে বিপুল পরিমাণ অর্থ রেখেছেন এই দম্পতি। প্রাথমিক তদন্তে ফার্মগেটে পাপিয়ার দুটি বিলাসবহুল ফ্ল্যাট, নরসিংদী শহরে দুটি ফ্ল্যাট, ২ কোটি টাকা মূল্যের দুটি প্লট, চারটি বিলাসবহুল গাড়ি এবং গাড়ি ব্যবসায় প্রায় দেড় কোটি টাকা বিনিয়োগের তথ্য পাওয়া গেছে।
এ ছাড়া বিভিন্ন দেশের ব্যাংকে নামে-বেনামে বিপুল পরিমাণ অর্থ গচ্ছিত থাকার কথা জানা গেছে। পাপিয়া ও তার স্বামী সুমন চৌধুরী রেলওয়ে ও পুলিশে চাকরির প্রলোভনে ১১ লাখ টাকা, একটি কারখানায় অবৈধ গ্যাস সংযোগ দেয়ার কথা বলে ৩৫ লাখ টাকা, একটি সিএনজি পাম্পের লাইসেন্স করে দেয়ার কথা বলে ২৯ লাখ টাকা নিয়েছেন বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে।
এর বাইরে নরসিংদী এলাকায় চাঁদাবাজি, মাদক ও অস্ত্র ব্যবসাসহ বিভিন্ন অপরাধের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা উপার্জন করেছেন তারা।পাপিয়ার আয়ের অন্যতম উৎস নারীদের দিয়ে জোরপূর্বক অনৈতিক কাজ করানো। ঢাকার বিভিন্ন বিলাসবহুল হোটেলে কম বয়সী মেয়েদের অনৈতিক কাজে বাধ্য করতেন তিনি।
যাদের অধিকাংশকে নরসিংদী এলাকা থেকে চাকরির প্রলোভনে ঢাকায় আনা হয়েছিল। অনৈতিক কাজে বাধ্য না হলে তাদের নানাভাবে নির্যাতন করা হতো। পাপিয়ার সঙ্গে বিশিষ্টজনদের ছবির বিষয়ে জানতে চাইলে ওই র্যাব কর্মকর্তা বলেন, বর্তমানে যদি কেউ কারও সঙ্গে ছবি তুলতে চায় তাহলে বিষয়টি সাধারণত এড়ানো যায় না। তাই কারও সঙ্গে ছবি থাকা মানেই সখ্য নয়।
যুবলীগ নেত্রী পাপিয়া পিউ নামেই বেশি পরিচিত। এই নেত্রীর প্রকাশ্য আয়ের উৎস গাড়ি বিক্রি ও সার্ভিসিংয়ের ব্যবসা। এর আড়ালে জাল মুদ্রা সরবরাহ, বিদেশে অর্থপাচার এবং অবৈধ অস্ত্র রাখাসহ নানা অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। তড়িঘড়ি করে দেশত্যাগের চেষ্টা করেন পাপিয়া। তবে শেষ রক্ষা হয়নি। সহযোগীসহ গ্রেফতার হন তিনি। গাড়ির ব্যহবসার আড়ালে তিনি অবৈধ অস্ত্র, মাদক ব্যবসা ও চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত। সমাজসেবার নামে তিনি নরসিংদীর অসহায় নারীদের অনৈতিক কাজে লিপ্ত করে আসছিলেন। তিনি গুলশানের একটি অভিজাত হোটেলের প্রেসিডেন্ট স্যুট নিজের নামে বুক করে নানা ধরনের অসামাজিক কার্যকলাপ চালিয়ে আসছিলেন।
রাজধানীর পাপের রাজ্যের একচ্ছত্র অধিপতি শামীমা নূর পাপিয়া ওরফে পিউ গ্রেফতার হওয়ার পর অপরাধ জগতের চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসছে। একটি সাধারণ ঘরের মেয়ে পাপিয়া ৫ বছরে কয়েক কোটি টাকা ও বিপুল অর্থবিত্তের মালিক বনে যান। প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় অল্প সময়ে হয়ে উঠেন অপরাধ জগতের মুকুটহীন সম্রাজ্ঞী।
ঢাকা ও নরসিংদীতে একাধিক ফ্ল্যাট-প্লট ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মালিক পাপিয়ার বাবা একজন অটো গ্যারেজের মালিক। বাবা কষ্টে জীবনযাপন করলেও অবৈধ টাকায় ঢাকায় আয়েশী জীবনযাপন করতেন পাপিয়া। মদ-জুয়া নিয়ে ফূর্তি ও মাস্তিতে সারাক্ষণ মেতে থাকতে পছন্দ করতেন পাপিয়া।
পাপিয়ার উত্থানের পেছনে রয়েছে কালো অধ্যায়। পাপিয়া নরসিংদীর বাগদী এলাকায় পেট্রোবাংলার অবসরপ্রাপ্ত গাড়িচালক সাইফুল বারীর মেয়ে। বর্তমানে তার বাবার নিজ এলাকায় একটি অটোর গ্যারেজ রয়েছে। সেখানে বেশ কয়েকটি অটো গাড়ি ভাড়া দিয়ে চলে সাইফুলের সংসার।
* সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ সব সংবাদ, ছবি ,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন। ভিজিট করুন : http://www.etihad.news
* অনলাইন নিউজ পোর্টাল ইত্তেহাদ নিউজে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়