সংবাদ আন্তর্জাতিক

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর প্রতি অ্যামনেস্টির মহাসচিবের খোলাচিঠি

a0b2ed6acb13763f9e1118867442c99c 66a93e02544f6
print news

ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ককোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সংঘর্ষে প্রাণহানির ঘটনা নিয়ে পর্যবেক্ষণ ও কিছু দাবি তুলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্দেশে একটি খোলাচিঠি লিখেছেন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মহাসচিব অ্যাগনেস ক্যালামার্ড।

মঙ্গলবার (৩০ জুলাই) এই চিঠি অ্যামনেস্টির ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে। ওই চিঠির শুরুতে ক্যালামার্ড লিখেছেন, বাংলাদেশে কোটা সংস্কার আন্দোলনে সাম্প্রতিক সহিংস দমনাভিযানের বিষয়ে গভীর উদ্বেগ নিয়ে আমি আপনাকে লিখছি। সহিংসতা বন্ধ, ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা এবং বিক্ষোভের সময় ২০০ জনের বেশি মানুষের মৃত্যুর জন্য জবাবদিহি নিশ্চিত করতে জরুরি ও দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য আপনার প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।

চিঠিতে ক্যালামার্ড লিখেছেন, বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গত ২৮ জুলাই এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে বলেছেন যে সহিংসতায় ১৪৭ জন নিহত হয়েছেন। যদিও বেসরকারি সূত্র যেমন প্রথম আলোর তথ্য অনুযায়ী, সহিংসতায় কমপক্ষে ২১১ জনের মৃত্যু হয়েছে। এটা বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে প্রাণঘাতী বিক্ষোভ দমনাভিযানের অন্যতম হয়ে উঠেছে। বিক্ষোভ শান্ত করতে দেশজুড়ে পুলিশের পাশাপাশি র‌্যাব, বিজিবি ও সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। অনেক বেশি মৃত্যুর এই সংখ্যা বিক্ষোভ ও ভিন্নমতের প্রতি বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষের চরম অসহিষ্ণুতার দুঃখজনক অধ্যায় হয়ে উঠেছে। বিক্ষোভকারীদের ওপর প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহারসহ আইনবহির্ভূত শক্তিপ্রয়োগ মানুষের বেঁচে থাকার অধিকারের প্রতি কর্তৃপক্ষের নিষ্ঠুর অবহেলা এবং আইন প্রয়োগকারী কর্মকর্তারা দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের বাধ্যবাধকতা মেনে চলার ক্ষেত্রে শোচনীয় ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন।

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল গত ১০ দিনে বিক্ষোভ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা পর্যবেক্ষণ ও তথ্য–উপাত্ত সংরক্ষণ করেছে। পৃথক দুটি ঘটনায় অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল তথ্য–উপাত্ত যাচাই করেছে যাতে ছয় দিন যোগাযোগে বিধিনিষেধ (ইন্টারনেট বন্ধ) চলাকালে বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীদের ওপর আইন–বহির্ভূতভাবে বলপ্রয়োগ, আইন–বহির্ভূতভাবে প্রাণঘাতী ও কম প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহারের বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছে।

ক্যালামার্ড লিখেছেন, আমরা দেখতে পেয়েছি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীদের ওপর ওপর থেকে গুলির বেআইনি ব্যবহার, শিক্ষার্থীরা আবদ্ধ স্থানে থাকা অবস্থায় সেখানে কাঁদানে গ্যাসের বিপজ্জনক ব্যবহার এবং এ কে ঘরানার অ্যাসল্ট রাইফেলের মতো প্রাণঘাতী আগ্নেয়াস্ত্রের নির্বিঘ্ন ব্যবহার হয়েছে। অ্যামনেস্টি আরও দেখতে পেয়েছে যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিরস্ত্র ও শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারীদের ওপর ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ (বিসিএল) সহিংসতা চালিয়েছে। পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন এমন শিক্ষার্থীদেরও ওপর তারা হামলা করেছে।

এই বিক্ষোভের মধ্যে গত ১৮ জুলাই সন্ধ্যা থেকে বাংলাদেশের মানুষ দেশজুড়ে ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়ার বিষয়টির মুখোমুখি হয়েছে। ইন্টারনেট পুরোপুরি বন্ধ করার আগে দেশজুড়ে মোবাইল ইন্টারনেট সাময়িক বাধাগ্রস্ত করা হয়। এরপর কিছু এলাকায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার বন্ধ করে দেওয়া হয়। গত ১৯ জুলাই ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) ১৪৪ ধারা জারি করে রাজধানীতে সব ধরনের মিছিল–সমাবেশ নিষিদ্ধ করে।

গত ১৯ জুলাই শুক্রবার মধ্যরাতে পুলিশকে দেখামাত্রই গুলি করার নির্দেশ দেওয়া হয় এবং কারফিউ জারি করা হয়। দেশজুড়ে ইন্টারনেট বন্ধ, দেশজুড়ে কারফিউ জারি করে দেখামাত্র গুলি করার নির্দেশ এবং ঢাকায় সব ধরনের বিক্ষোভের ওপর নিষেধাজ্ঞা মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও শান্তিপূর্ণ সমাবেশের ওপর নজিরবিহীন দমন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। এ ধরনের বিধিনিষেধ নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক সনদ অনুসমর্থনকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশের যে বাধ্যবাধকতা রয়েছে তার লঙ্ঘন। আমরা জানতে পেরেছি, গত ২৩ জুলাই দেশে ছয় দিন পর ইন্টারনেট ফিরে আসে এবং ২৪ জুলাই কারফিউ শিথিল হয়। আর ২৮ জুলাই মোবাইল ইন্টারনেট ফিরে আসে। তবে এখনো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধ রয়েছে।

ক্যালামার্ড তার চিঠিতে লিখেছেন, গণমাধ্যমের প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ১০ হাজারের বেশি ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, যাদের বেশির ভাগ বিরোধী দলের নেতা–কর্মী, আন্দোলনকারী, শিক্ষার্থী ও বিক্ষোভে অংশগ্রহণকারী। এ ছাড়া শুধু রাজধানীতেই থানায় ২০০টির মতো মামলা করে ২ লাখ ১৩ হাজারের বেশি ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে। এসব আসামির বেশির ভাগই অজ্ঞাত। এফআইআরে কারও নাম না দেওয়ার কৌশলটি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জন্য যে কাউকে চাইলেই গ্রেপ্তার করার সুযোগ এনে দেয়। গণগ্রেপ্তার ও ছাত্র বিক্ষোভকারীদের নির্বিচার আটকে রাখা ভয়ের পরিবেশকে আরও স্থায়ী করেছে।

এটা লক্ষণীয় যে বাংলাদেশে অসহিষ্ণুতা ও ভিন্নমত দমন বেড়ে যাওয়ার বিস্তৃত পটভূমিতেই ছাত্র বিক্ষোভের ওপর এমন প্রাণঘাতী দমনাভিযান চালানো হয়েছে। দমনমূলক আইন যেমন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮, যা পরবর্তী সময়ে প্রায় সাইবার নিরাপত্তা আইন ২০২৩ হয়েছে। এই আইনের মাধ্যমে সরকারের সঙ্গে ভিন্নমত বা সমালোচনার জন্য সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মী ও অ্যাকটিভিস্টদের লক্ষ্যবস্তু বানানো হয়। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার পক্ষ থেকে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আন্তর্জাতিক আইনের আওতাধীন বাধ্যবাধকতাগুলোর প্রতি সম্মান দেখানো, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও শান্তিপূর্ণ সমাবেশের অধিকার রক্ষা এবং বিক্ষোভ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে মানবাধিকার সমুন্নত রাখার পদ্ধতি অবলম্বনের আহ্বান জানানো হয়। তা সত্ত্বেও বাংলাদেশ সরকার বারবার আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের বাধ্যবাধকতা সমুন্নত রাখতে অনাগ্রহ দেখিয়েছে এবং সহিংসতা বন্ধে কোনো অর্থবহ পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছে।

এরই পরিপ্রেক্ষিতে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মহাসচিব অ্যাগনেস ক্যালামার্ড চিঠিতে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তার মধ্যে রয়েছে, অবিলম্বে সম্পূর্ণরূপে কারফিউ প্রত্যাহার, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া, ভবিষ্যতে বিক্ষোভ দমনে কারফিউতে দেখা মাত্রই গুলি করার নির্দেশ ও ইন্টারনেট বন্ধ করা হবে না বা অন্যান্য মৌলিক অধিকারগুলো লঙ্ঘন করা হবে না— এমন নিশ্চয়তা প্রদান।

শান্তিপূর্ণভাবে বিক্ষোভ করতে গিয়ে যারা গ্রেপ্তার হয়েছেন তাদের অবিলম্বে নিঃশর্ত প্রদান, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাগুলোকে সংযম দেখানোর নির্দেশ, বিক্ষোভকারীদের ওপর অপ্রয়োজনীয় বা অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ না করা এবং এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে পদক্ষেপ গ্রহণ।

বিক্ষোভ দমনের সময় হতাহতের ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ, কার্যকর, স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্ত করতে জাতিসংঘের সঙ্গে সহযোগিতার ভিত্তিতে কাজ করা। এ ঘটনায় আইনবহির্ভূতভাবে শক্তিপ্রয়োগের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের জবাবদিহি নিশ্চিত করা। এ ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত এবং বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিদের পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ প্রদান।

এ ছাড়া বাংলাদেশের সংবিধান এবং মানবাধিকারবিষয়ক আন্তর্জাতিক মানদণ্ড মেনে শান্তিপূর্ণ সমাবেশের অধিকার ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার সুরক্ষার নিশ্চয়তা প্রদান এবং এ ক্ষেত্রে যেসব আইনি বাধা রয়েছে, যেমন সাইবার নিরাপত্তা আইন ও ফৌজদারি কার্যবিধির ১৪৪ ধারা বিলুপ্ত করুন।

ক্যালামার্ড তার চিঠির শেষে লেখেন, ওপরের বাধ্যবাধকতাগুলো মেনে চললে আইনের শাসনের প্রতি জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনতে সহায়ক হতে পারে এবং আন্তর্জাতিক মঞ্চে মানবাধিকারের প্রতি বাংলাদেশের অঙ্গীকার প্রদর্শিত হবে। তিনি লিখেছেন, বিশ্ব তাকিয়ে আছে এবং এটা অপরিহার্য যে বাংলাদেশের মানুষের মানবাধিকার রক্ষা হচ্ছে।

সংবাদটি শেয়ার করুন....
ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক :

ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক :

About Author

etihad news is one of the famous Bangla news portals published from Abudhabi-UAE. It has begun with a commitment to fearless, investigative, informative, and independent journalism. This online portal has started to provide real-time news updates with maximum use of Smart Technology.

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *