মতামত

বাংলাদেশ কি শ্রীলঙ্কা থেকে শিক্ষা নেয়নি?

image 361145 1722788781
print news

মঞ্জুরে খোদা: আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘গণঅভ্যুত্থান ঘটিয়ে শ্রীলঙ্কা স্টাইলে প্রধানমন্ত্রীর বাড়ি দখল করার টার্গেটও ওই রাতে (১৯ জুলাই) ছিল। যদি কারফিউ জারি না হতো। শ্রীলঙ্কা স্টাইলে প্রধানমন্ত্রীর বাড়ি আক্রমণ করা এবং অভ্যুত্থানের ওপর ভর করে হাওয়া ভবনের যুবরাজ ক্ষমতা দখল করত।’ (সমকাল, ২৮ জুলাই ২০২৪)।

ওবায়দুল কাদের শ্রীলঙ্কার অভিজ্ঞতার শুরুর কথা বললেন কিন্তু পরের অংশ বললেন না, যার সঙ্গে তাদের বর্তমান চরিত্রের মিল পাওয়া যায়। শ্রীলঙ্কার সেই বিদ্রোহের দুটি দিক ছিল। একটি হচ্ছে শাসকের পরিবর্তন, অন্যটি হচ্ছে সেই আন্দোলনের নেতৃত্বের ওপর নিপীড়ন।

২০২২ সালের জুলাইয়ে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও পণ্য সংকটের কারণে শ্রীলঙ্কায় তরুণ ও ছাত্র-জনতা রাস্তায় নেমে আসে এবং ব্যাপক বিদ্রোহের সৃষ্টি করে।
গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে তারা দেশটির রাজপ্রাসাদ দখল করে নেয়। শুধু তাই নয়, তারা সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ভবন-মন্ত্রণালয়ও নিয়ন্ত্রণে নেয়। সেই ঘটনায় ব্যাপক লুটপাট, জ্বালাও-পোড়াও ও ভাঙচুর হয়। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে আত্মরক্ষার্থে প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসে সিঙ্গাপুরে পালিয়ে যান। এবং তাঁর স্থানে তাদেরই অনুগত ও ঘনিষ্ঠ সহযোগী রনিল বিক্রমাসিংহ শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন।

নতুন শাসক সে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে নানা কর্মসূচি নিলেন এবং জনগণকে প্রতিশ্রুতি দিলেন যে ছয় মাসের মধ্যেই তিনি দেশকে স্থিতিশীল পরিস্থিতিতে নিয়ে আসবেন। পরবর্তী সময়ে কী হয়েছিল তা সবার জানা। পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলে শাসকের চরিত্র ও চেহারা পাল্টে যায়। গোতাবায়ে রাজাপাকসে ক্ষমতাচ্যুতির এক মাস পরে আবার মহাসমারোহে রাজকীয়ভাবে দেশে ফিরে আসেন!

কিন্তু ওই যে যারা সেই আন্দোলন, গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তাদের ভাগ্যে কী জুটেছিল? কী পরিণতি হয়েছিল? তাদের জীবন ও বেঁচে থাকাকে কঠিন ও দুর্বিষহ করে তুলেছিল সেই অকৃতজ্ঞ নবনির্বাচিত সরকার। তিনি ক্ষমতা নিয়েই চড়াও হলেন আন্দোলনকারীদের ওপর। পুলিশ ও সেনাবাহিনীর চিরুনি অভিযানের কারণে সেই আন্দোলনের নেতাদের আত্মগোপনে যেতে হয়েছিল। তাদের যাঁকে যেখানে পাওয়া গিয়েছিল ধরে জেলে পোরা হয়েছিল। অনেকে সেই পরিস্থিতিতে ভারতসহ বিভিন্ন দেশে পালিয়ে গিয়েছিলেন। অনেককে বিমান থেকে ধরে এনে বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছিল।
শ্রীলঙ্কার নতুন সরকার ছিল সেই আন্দোলনের সুবিধাভোগী, অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট রনিল ছিলেন এ গণঅভ্যুত্থানের ফসল। সে সময় সংসদের কয়েকজন বামপন্থি সদস্য অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী ছাত্র-তরুণদের শাস্তি না দিয়ে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার কথা বললেও ক্ষমতাসীনরা তাদের কথায় কর্ণপাত করেননি।

সেই একই জুলাই মাসে বাংলাদেশে কোটা সংস্কার আন্দোলন সংঘটিত হয়। শান্তিপূর্ণ এই আন্দোলন প্রধানমন্ত্রীর একটি মন্তব্যের সূত্র ধরে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। পরবর্তী সময়ে সেতুমন্ত্রীর বক্তব্য, পুলিশ ও ছাত্রলীগের তাণ্ডব এবং অভিযানে সহিংস হয়ে ওঠে। তাৎক্ষণিক দেশব্যাপী ব্যাপক সহিংসতার পর সেনাবাহিনী মোতায়েন ও কারফিউ জারি করা হয়। বিপুল প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতির পর পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসে। কিন্তু মানুষের মধ্যে ক্ষোভ ও প্রতিক্রিয়া বাড়তে থাকে। শাসক মানুষের সেই মনোভাবকে গুরুত্ব না দিয়ে আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে এবং জবরদস্তির মাধ্যমে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমনের চেষ্টা করছেন।

পরিস্থিতির কিছুটা সুবিধা বুঝে বাংলাদেশের শাসকগোষ্ঠীও যেন শ্রীলঙ্কার পদাঙ্কই অনুসরণ করেছিল। সরকার আন্দোলনকারী নেতৃত্বের একটি অংশকে ডিবি হেফাজতে নিয়ে তাদের সব কর্মসূচি প্রত্যাহার করাতে বাধ্য করেছিল। যদিও তারা মুক্তি পাওয়ার পর কর্মসূচি প্রত্যাহারের সেই বিবৃতি প্রত্যাহার করেছেন। কোটা সংস্কার আন্দোলনও ৯ দফা থেকে ১ দফায় রূপান্তরিত হয়েছে।

শোনা যায়, বিরোধীদের দমন-পীড়নের মাধ্যমে দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা রাজাপাকসে সরকার শ্রীলঙ্কার প্রশাসনকে তিন স্তরে সাজিয়েছিল। কোনো বৈরী পরিস্থিতিতে প্রশাসনের কোনো স্তর যদি তাঁকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হয় বা বিশ্বাসঘাতকতা করে, সে ক্ষেত্রে বিকল্প স্তর যেন তাঁকে টিকিয়ে রাখতে বা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখতে পারে সেই সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য নিয়ে সাজানো হয়েছে।
পরপর তিন মেয়াদ ক্ষমতায় থেকে শেখ হাসিনার সরকারও অনুগতদের দিয়ে একই রকমভাবে প্রশাসনকে বিভিন্ন স্তরে বিন্যাস করেছেন কিনা, সেটা এখনই বলা যাচ্ছে না। তবে এখন পর্যন্ত যা দেখা যাচ্ছে, কোটা সংস্কার নিয়ে শেখ হাসিনা যখন সেনাবাহিনী মোতায়েন করেন, কারফিউ জারি করেন, তখন অনেকে আশা বা আশঙ্কা করেছিলেন সেনাবাহিনী তাঁর কথা নাও শুনতে পারে। সামাজিক মাধ্যমে ও অখ্যাত অনলাইন সংবাদমাধ্যমে নানা গুজবও ছড়ানো হয়েছে। বাস্তবে তেমন কিছু ঘটেনি।

অবশ্য শেখ হাসিনা ২০০৯ সালের ভয়াবহ বিডিআর বিদ্রোহ, ২০১৩ সালের শাপলা চত্বরের হেফাজতের তাণ্ডব, ২০১৮ সালের প্রথম দফা কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ন্ত্রণ করেছেন। টানা তিনটি নির্বাচনে যেমন করেই হোক ক্ষমতা ধরে রেখেছেন। এগুলোই তাঁকে অতি আত্মবিশ্বাসী করে তুলতে পারে। কিন্তু কোনো ন্যায্য দাবি নিয়ে জনসম্পৃক্ত আন্দোলন যখন মাঠে নামে, তখন অতি আত্মবিশ্বাসই কাল হয়ে দাঁড়াতে পারে। কোটা সংস্কার আন্দোলনের যদি উপযুক্ত নেতৃত্ব, সংগঠন, কর্মসূচি ও সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা থাকে, তাহলে ২০২২ সালের জুলাইয়ে শ্রীলঙ্কার ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে ২০২৪ সালের বাংলাদেশে। আবার শ্রীলঙ্কায় আন্দোলনকারীরা যেমন আন্দোলনকে নিজেদের হাতে রাখতে পারেনি, সেটার পুনরাবৃত্তিও ঘটতে পারে বৈকি!

ড. মঞ্জুরে খোদা: লেখক-গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

 

সর্বশেষ  গুরুত্বপূর্ণ  সব  সংবাদ, ছবি ,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও লেখা পেতে আমাদের  ফেসবুক পেইজে  লাইক  দিয়ে  অ্যাকটিভ  থাকুন।  ভিজিট করুন : http://www.etihad.news

* অনলাইন  নিউজ পোর্টাল  ইত্তেহাদ নিউজে  লিখতে  পারেন  আপনিও। লেখার বিষয়  ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন  [email protected] ঠিকানায়

সংবাদটি শেয়ার করুন....
ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক :

ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক :

About Author

etihad news is one of the famous Bangla news portals published from Abudhabi-UAE. It has begun with a commitment to fearless, investigative, informative, and independent journalism. This online portal has started to provide real-time news updates with maximum use of Smart Technology.

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *