বাংলাদেশ ঢাকা

প্রতিরোধ-প্রতিবাদের ভাষায় শিক্ষার্থীদের গ্রাফিতি

9afe32cae7d537faaa77f2083c106518 66baee5546dad
print news

ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্কসামাজিক অবিচার, সমসাময়িক রাজনৈতিক পরিস্থিতি বা যুদ্ধের বিরুদ্ধে শিল্পীরা তাদের বার্তা সমাজে পৌঁছে দিয়ে থাকেন গ্রাফিতির মাধ্যমে। গ্রাফিতির অস্তিত্ব পাওয়া যায় প্রায় চার হাজার বছর আগে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় নির্মমতার প্রতিবাদের ভাষায় যুক্ত হয়েছিল গ্রাফিতি। ২০২৪ সালের আগস্ট মাসে স্বৈরাচার সরকারের পতন ঘটলে শুরু হয় গ্রাফিতি আঁকা। অংশ নেয় বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তুলে ধরেছেন গ্রাফিতির চিত্রকর্ম ।

ইয়াকুব ইবাদ, কুমিল্লা জিলা স্কুলের ২০১৭ সালের এসএসসি ব্যাচ। তার সঙ্গে ছিলেন ২০১৯ ব্যাচের মেহেদী হাসান রবিন এবং ব্যাচের নোয়েল কবির। বৈষম্যের বিরুদ্ধে কোনো আপস নয়, জুলাই মাসের রক্তক্ষরণ বৃথা যাবার নয়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে ঘিরে গত জুলাই মাস থেকে শুরু হওয়া নির্মম ব্যভিচার, হত্যাযজ্ঞ এবং ছাত্র আন্দোলনে শহীদদের প্রতি স্মৃতিচারণের উদ্দেশ্যকে ধারণ করেই মূলত তাদের গ্রাফিতির উদ্যোগ নেওয়া। কুমিল্লা জিলা স্কুল, নবাব ফয়জুন্নেসা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়সহ শহরের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বর্তমান ও সাবেক শিক্ষার্থীদের স্বতঃস্ফূর্ত ও সম্মিলিত অংশগ্রহণে গ্রাফিতিগুলো কুমিল্লা জিলা স্কুলের বাইরে ৪২টি দেয়ালে কারুকার্যমণ্ডিতভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। শিক্ষার্থীদের একাংশই তাদের কৈশোর থেকে ছবি আঁকার প্রতি ভালোবাসা এবং ছবির মাধ্যমে কিছু শক্তিশালী বার্তা বর্তমান প্রজন্মকে পৌঁছে দিতে নিরলস পরিশ্রম করে গিয়েছেন। দেয়ালে গ্রাফিতিগুলো করতে শিক্ষার্থীদের বিশেষভাবে কুমিল্লা জিলা স্কুলের প্রশাসন এবং প্রাক্তন কিছু বয়োজ্যেষ্ঠ যথেষ্ট সহযোগিতা করেছেন। সেই সঙ্গে স্কুলের বিভিন্ন ব্যাচের শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি সাবেকদেরও সম্মিলিত অংশগ্রহণ থাকায় সবাই বেশ নির্বিঘ্নে এবং আনন্দচিত্তে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ছাড়াই তারা তাদের কর্মকাণ্ডগুলো সম্পন্ন করতে সক্ষম হয়েছে।

3e3c1eb90af883440ea58d9596c58071 66baee14b5096

সমতলের মানুষ ততটুকুই জানে, দূর থেকে পাহাড় যতটুকু দেখতে সুন্দর

কল্পনা চাকমা বাংলাদেশের একজন মানবাধিকার কর্মী ও নারীবাদী ছিলেন। তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর আঞ্চলিক সংগঠন হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। ১৯৯৬ সালের ১১ জুন দিবাগত রাতে, অর্থাৎ ১২ জুন রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার লাইল্যাঘোনা গ্রামের নিজ বাড়ি থেকে অপহৃত হন তিনি। এই ঘটনাটি বাংলাদেশ এবং বহির্বিশ্বে তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি করে। এতদিন কেউ না চিনলেও সংগীতশিল্পী সায়ানের গানের পর কল্পনা চাকমাকে এখন সবাই চিনেছে। তাই খাগড়াছড়ি সদরে কল্পনা চাকমার ছবি আঁকা হলে তা এক মহলের লোক মোছার চেষ্টা করে। প্রতিবাদস্বরূপ খাগড়াছড়িতে অবস্থানরত বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে কলেজের সাধারণ শিক্ষার্থীরাও গ্রাফিতি অঙ্কনে নিরপেক্ষভাবে অংশগ্রহণ করে। উক্ত কর্মসূচিতে কল্পনা চাকমার কনসেপ্টচুয়াল একটা ছবি আঁকা হয় যেখানে চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা জাতিগোষ্ঠীর বর্ণমালায় লেখা হয় কল্পনা চাকমা কোথায়। ছবিটি একদিকে যেমন কল্পনা চাকমার বার্তা দেয় তেমনি তাদের নিজস্ব মাতৃভাষারও বার্তা প্রচার করে। কল্পনা চাকমার পাশাপাশি তাদের পার্বত্য চট্টগ্রামের এক সংগ্রামী নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার ছবি আঁকা হয়। তার ছবির সঙ্গে তাদের মাতৃভাষার বর্ণমালা। মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা লড়াই করেছিলেন সব আদিবাসীর নিজস্ব জাতিগত পরিচয় রক্ষার্থে। সেই সঙ্গে সাম্যবাদী ধারার কিছু চিত্রও দেয়ালে ফুটিয়ে তোলা হয়। দেশের মানুষ স্বপ্ন দেখছে স্বৈরাচারমুক্ত, সাম্প্রদায়িক দেশ, সেই দেশে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীরা সমতলের মানুষদের মতো কেন নিজেদের দাবি-দাওয়া বলতে পারছেন না। কেন তাদের মুখ বন্ধ করে রাখা হচ্ছে! তাহলে বাকস্বাধীনতা কোথায়? পার্বত্য চট্টগ্রাম কি বাংলাদেশ থেকে আলাদা? তারা আদিবাসীরা স্বাধীন দেশে পরাধীন জীবন-যাপন করছেন এবং নানাভাবে স্বীকৃতি পাচ্ছেন না বলে জানান।

জুলফিকারের গ্রাফিতি ভালোবেসেছেন সবাই

শৈশব থেকেই আর্টের প্রতি জুলফিকারের ঝোঁক ছিল। পড়াশোনার ফাঁকে প্রায়ই আর্ট করতেন। সরকার পদত্যাগের পর স্বাধীনতার আমেজে তিনি ও তার টিম গ্রাফিতি করেছেন। জুলফিকার হাটহাজারী মাদ্রাসার ছাত্র। টিমের সদস্যরা হলেন- তোফায়েল আহমাদ, সামিউল্লাহ রিয়াদ, রাকিব হাসনাত, ইউনুস আদনান, রাকিবুল মান্নান, সরওয়ারুল কারিম, সাইফুদ্দিন মাসউদ, আলি হাসান। সর্বপ্রথম চট্টগ্রাম জি.ই.সি মোড়ে বড় জায়গাজুড়ে দুটি আরবি গ্রাফিতি করেন তারা পাশাপাশি বাংলা এবং ইংরেজিতেও লিখেছেন। যেগুলো দেশব্যাপী বেশ সাড়া পেয়েছে। কাজগুলোর মাধ্যমে মানুষ তাদেরকে প্রচুর ভালোবাসা উপহার দিয়েছে বলে জানিয়েছেন। ৬ আগস্ট মধ্যরাতে জুলফিকার তার টিম নিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হন এবং ঢাবির এলাকায় ঢাকার শিল্পীরাসহ সবাই কাজ শুরু করতেই বাধাপ্রাপ্ত হন অপরিচিত লোকদের দ্বারা। অতঃপর তারা সময় অপচয় না করে চট্টগ্রাম ফিরে গিয়ে নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করেন।

08b99d8eb9ffcdc5655ac987783608d0 66baeac025ec5

নানামুখী পদক্ষেপ ছিল মার্কস মেডিক্যাল কলেজের

মার্কস মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষার্থীদের নানামুখী উদ্যোগ ছিল অন্যদের পাশাপাশি। তারা গ্রাফিতি করেছেন, গাছের চারা লাগিয়েছেন, ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে কাজ করেছেন, ছিলেন পরিচ্ছন্নতার সঙ্গেও। অনেকেই বলেছে ডাক্তাররা আঁকছেন, ট্রাফিক পুলিশের দায়িত্ব নিয়েছেন। বিষয়গুলো তারাও উপভোগ করেছেন। এমবিবিএস পঞ্চম বর্ষের শিক্ষার্থী ফিরদাউস শিমুল বলেন, আমাদের লক্ষ্য বৃক্ষরোপণের মাধ্যমে শক্তিশালী ও টেকসই বাংলাদেশের বীজ বপন করা, যেখানে সবাই প্রাণভরে শ্বাস নেবে। একই বর্ষের তাজাম্মেল আহমেদ রাজ বলেন, আন্দোলনে সবার একত্র হওয়া দেখে তার মনে হয়েছে একজন বাংলাদেশি হিসেবে দেশ ত্যাগ করে নয় বরং দেশে থেকেই দেশকে সংস্কার করতে চাই। তাদের বন্ধু শাফিন আহমেদ অরণ্যর স্বপ্ন পরিচ্ছন্নতার মাধ্যমে স্বাস্থ্যকর ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করা। উম্মে সুরাইয়া শশীর চিন্তাটা প্রখর। তিনি বলেন, বৃক্ষ রোপণের মাধ্যমে মানব জীবন ও প্রকৃতির মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা সম্ভব। রঙের মেলায় শহর সাজাতে পেরে বেশ খুশি ছিলেন বলে জানালেন আয়শা সিদ্দিকা হাসান। একই সুর আবু ইউসুফ মো. শিহাবের। তিনিও মৃতপ্রায় দেয়ালকে রঙের আচরে সঞ্জীবনী শক্তি দিতে পেরে খুশি। তাদের টিমের তানজিম রহমান বলেছেন, প্রশিক্ষণ না থাকার পরও ট্রাফিকের দায়িত্ব পালন করতে তার কোনো অসুবিধাই হয়নি বরং দেশের প্রয়োজনে আরও কিছু সময় তিনি উৎসর্গ করতে পারতেন।

এঁকেছেন পাবনা জেলার শিক্ষার্থীরা

ঊর্মিলা চৌধুরী পড়েন ঈশ্বরদী সরকারি কলেজের অনার্স চতুর্থ বর্ষে। তার নেতৃত্বে একটি টিম গ্রাফিতি করেছে দেয়ালে দেয়ালে। টিমে ছিলেন লিজা ইসলাম (রাজশাহী সরকারি মহিলা কলেজ), দিলারা আক্তার নিঝুম (ঈশ্বরদী সরকারি কলেজ) রকি রেইন্স, তিন্নি, ফাতেমা জান্নাত রোথি, সাদিবা আক্তার, মুমতারিন নিধি, নুরজাহান, মিথিলা, মারিয়া, আসিব আলী, অনিক আলী, রুপ্ত, সাব্বির, আলিফ, গালিব, মেরাজ, শান্ত, নয়ন। তুলির মাধ্যমে নিজের কল্পনা অনুযায়ী দেশটার সৌন্দর্য তুলে ধরার একটা ছোট্ট প্রচেষ্টা তাদের। তাদের মধ্যে কয়েকজন আঁকাআঁকির সঙ্গে ছোট থেকে যুক্ত বাকিরা সবাই সবার ভালো লাগা থেকেই সেখানে অংশ নিয়েছিলেন, সবাই স্থানীয়, তাই কোনো বাধা ছিল না বরং সবাই অনেক পছন্দ করেছে ও উৎসাহ দিয়েছে। রাজনীতির বিষয়ে সেখানে কারও কোনো চিন্তা-ভাবনা ছিল না কারণ সবাই প্রায় ছোট, সবাই আঁকতে ভালোবাসে তাই নিজেদের উদ্যোগে সব করা, তাদের একটাই ইচ্ছে দুর্নীতিমুক্ত এবং সুন্দর একটা দেশ হোক যেখানে সাধারণ জনগণ ন্যায়-অন্যায়ের সুষ্ঠু বিচার পাক। তারা পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার, বাঘল দোতলা সাঁকো এলাকায় গ্রাফিতি করেছেন।

 

 

সর্বশেষ  গুরুত্বপূর্ণ  সব  সংবাদ, ছবি ,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও লেখা পেতে আমাদের  ফেসবুক পেইজে  লাইক  দিয়ে  অ্যাকটিভ  থাকুন।  ভিজিট করুন : http://www.etihad.news

* অনলাইন  নিউজ পোর্টাল  ইত্তেহাদ নিউজে  লিখতে  পারেন  আপনিও। লেখার বিষয়  ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন  [email protected] ঠিকানায়

সংবাদটি শেয়ার করুন....
ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক :

ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক :

About Author

etihad news is one of the famous Bangla news portals published from Abudhabi-UAE. It has begun with a commitment to fearless, investigative, informative, and independent journalism. This online portal has started to provide real-time news updates with maximum use of Smart Technology.

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *