অর্ধকোটি মানুষ বানভাসি,মানবেতর জীবনযাপন


ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক : প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকে আসা পাহাড়ি ঢল ও অতিবৃষ্টিতে সৃষ্ট আকস্মিক বন্যায় দেশের ১১টি জেলার অর্ধকোটি মানুষ এখন বানভাসি অবস্থায় মানবেতর জীবনযাপন করছেন। এর মধ্যে বন্যার চতুর্থ দিন গতকাল শনিবার শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ১৮ জনের মৃত্যুর সংবাদ পাওয়া গেছে সরকারের তরফে। যদিও যোগাযোগ বিঘ্নের কারণে প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বন্যাদুর্গত এলাকায় সরকারি-বেসরকারিভাবে চলছে ত্রাণতৎপরতা। পরিস্থিতি মোকাবিলায় নৌবাহিনী, সেনাবাহিনী, কোস্টগার্ড, ফায়ার সার্ভিস, বিজিবি, ছাত্র প্রতিনিধিসহ সবাই জেলা প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বিতভাবে কাজ করছেন।
এদিকে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র থেকে গতকাল বলা হয়েছে, বন্যাকবলিত এলাকায় বৃষ্টিপাত কমে এসেছে। আগের তুলনায় বৃষ্টিপাত কমে আসায় বন্যার পানি কোথাও স্থিতিশীল, আবার কোথাও কোথাও কমতে শুরু করেছে।
গত চারদিন ধরে ভাসছে ফেনী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, নোয়াখালী, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেট, লক্ষ্মীপুর ও কক্সবাজার। গতকাল শনিবার দুপুরে সচিবালয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব কেএম আলী রেজা বলেন, এখন পর্যন্ত বন্যা আক্রান্ত জেলার সংখ্যা ১১টিতেই সীমাবদ্ধ আছে। মোট ক্ষতিগ্রস্ত লোকসংখ্যা ৪৯ লাখ ৩৮ হাজার ১৫৯ জন। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার ৯ লাখ ৪৪ হাজার ৫৪৮টি। তিনি বলেন, আগামী ২৪ ঘণ্টায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হবে, আমরা এমন পূর্বাভাস পেয়েছি। আগামী ২৪ ঘণ্টা দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল এবং তৎসংলগ্ন উজানে ভারী বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা নেই। এ সময়ে হবিগঞ্জ মৌলভীবাজারের মনু, খোয়াই, ধলাই নদীর বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের পূর্বাভাসের বরাতে আলী রেজা বলেন, আগামী ২৪ ঘণ্টায় দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল এবং তৎসংলগ্ন উজানে ভারী বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা নেই। এই সময়ে এই অঞ্চলের ফেনী, কুমিল্লা এবং চট্টগ্রাম অঞ্চলের ফেনী, গোমতী, হালদা- এই নদীগুলোর বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হবে বলে আশা করা যায়।
অতিরিক্ত সচিব জানান, বন্যায় চট্টগ্রামে ৫ জন, কুমিল্লায় ৪ জন, নোয়াখালীতে ৩ জন, কক্সবাজারে ৩ জন এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া, লক্ষ্মীপুর ও ফেনীতে একজন করে মারা গেছেন। বন্যার্তদের জন্য ফেনীতে ফিল্ড হাসপাতাল তৈরি করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, এটি সেনাবাহিনী ও সিভিল সার্জন কার্যালয় সমন্বিতভাবে পরিচালনা করছে। বন্যাপীড়িতদের চিকিৎসা প্রদান করা হচ্ছে। মোট ৩৫২৭টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে, আশ্রিতের সংখ্যা ২ লাখ ৮৪ হাজার ৮৮৮ জন। আশ্রয়কেন্দ্রে ২১ হাজার ৬৯৫টি গবাদি পশু নিয়ে আসা হয়েছে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের এ কর্মকর্তা জানান- চট্টগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, হবিগঞ্জ, ফেনী, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী জেলায় চলমান বন্যা কার্যক্রমে নৌবাহিনী, সেনাবাহিনী, ফায়ার সার্ভিস, কোস্টগার্ড, ছাত্র প্রতিনিধিরা, বিজিবিসহ সবাই জেলা প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বিতভাবে কাজ করছেন। তিনি আরও জানান, বন্যাদুর্গত ১১ জেলায় মোট ৩ কোটি ৫২ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ত্রাণের চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ২০ হাজার ১৫০ টন। এ ছাড়া ১৫ হাজার প্যাকেট শুকনা খাবার দেওয়া হয়েছে। শিশুদের খাবারের জন্য ৩৫ লাখ টাকা এবং গোখাদ্য কেনার জন্য ৩৫ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
কুমিল্লা, লক্ষ্মীপুর ও নোয়াখালীতে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি
কুমিল্লা জেলায় বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। গোমতী নদীর বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয়েছে নতুন নতুন এলাকা। জেলার দুর্গত উপজেলাগুলোয় সাত লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি। উদ্ধারকর্মীরা শুকনা খাবারসহ অন্যান্য সামগ্রী নিয়ে দুর্যোগস্থলে পৌঁছার চেষ্টা করছেন। কিন্তু ডুবে যাওয়া সড়কের কারণে এবং নৌকা না থাকায় ত্রাণ কার্যক্রম বিঘ্নিত হচ্ছে। গতকাল দুপুরে গোমতীর পানি বিপদসীমার ৯৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। গতকাল বিকাল পর্যন্ত কুমিল্লার বুড়িচং, ব্রাহ্মণপাড়া, চৌদ্দগ্রাম, লাকসাম, নাঙ্গলকোট, মনোহরগঞ্জসহ ৬টি উপজেলা প্লাবিত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। আদর্শ সদর ও সদর দক্ষিণ উপজেলার একাংশ এবং দেবিদ্বার উপজেলার কিছু এলাকা গতকাল নতুন করে বন্যাকবলিত হয়েছে।
লক্ষ্মীপুরেও বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। হু হু করে বাড়ছে পানি, আশ্রয়কেন্দ্রে ছুটছে মানুষ। শুক্রবার থেকে বৃষ্টি না হলেও বাড়ছে পানি। পার্শ্ববর্তী নোয়াখালী জেলার বন্যার পানি রহমতখালী খাল হয়ে লক্ষ্মীপুরের লোকালয়ে ঢুকে পড়ছে। এতে পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে ভয়াবহ বন্যার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। জেলার সদর উপজেলায় ১৫ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। জেলার সদর উপজেলার পৌর এলাকা, মান্দারী, চন্দ্রগঞ্জ, উত্তর জয়পুর, দত্তপাড়া, চরশাহী, কুশাখালী, তেওয়ারীগঞ্জ, ভবানীগঞ্জ, বাঙ্গাখা, পার্বতীনগর, টুমচর ইউনিয়ন এবং কমলনগরের চরকাদিরা, রামগতি চর বাদাম, চর পোড়াগাছা ইউনিয়ন, রায়পুর ও রামগঞ্জের পরিস্থিতি ভয়াবহ।
টানা ভারী বর্ষণ ও ফেনীর মুহুরী নদী থেকে আসা বানের পানিতে নোয়াখালীতে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। তলিয়ে গেছে ফেনী-নোয়াখালী প্রধান সড়কের চৌমুহনী-মাইজদী অংশের একাধিক জনপদ। জেলায় পানিবন্দি ২০ লাখ মানুষ বিশুদ্ধ পানি ও খাবার সংকটে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। এর মধ্যে কবিরহাট উপজেলাতেই পানিবন্দি তিন লক্ষাধিক মানুষ। এদিকে মুছাপুর রেগুলেটরের ২৩টি গেট খুলে দেওয়ায় পানি কমতে শুরু করেছে উপজেলায়। এ ছাড়া জেলায় সাড়ে ৪ লাখ গ্রাহক বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন। অন্যদিকে বন্যায় বেগমগঞ্জে ডায়রিয়া ও পানিবাহিত কয়েকটি রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। এরই মধ্যে হাসপাতালে ২৫ জন ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছেন।
নোয়াখালীর ডিসি দেওয়ান মাহবুবুর রহমান বলেন, জেলার ৯টি উপজেলার মধ্যে ৮টিতেই বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। জেলায় প্রায় ২০ লাখ মানুষ পানিবন্দি রয়েছেন। আমরা শুকনা খাবার দেওয়ার চেষ্টা করছি। স্বেচ্ছাসেবকরাও তৎপর রয়েছেন।
হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় কিছুটা উন্নতি
হবিগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। খোয়াই নদীর পানি বাল্লা পয়েন্টে বিপদসীমার ৪৪ সেমি ওপর দিয়ে প্রবাহিত হলেও শায়েস্তাগঞ্জ ও মাছুলিয়া পয়েন্টে নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে গত ২৪ ঘণ্টায় অন্যান্য নদীর পানি কয়েক সেন্টিমিটার কমেছে। এদিকে সিলেটের সঙ্গে সারা দেশের রেল যোগাযোগ এখনো বন্ধ রয়েছে। জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ অফিস সূত্র জানায়, জেলার একটি উপজেলা নতুন করে প্লাবিত হয়েছে। এ নিয়ে জেলার ৯টি উপজেলার মধ্যে ৬টি উপজেলাই বন্যাকবলিত। পানিবন্দি রয়েছে ১৬ হাজার ৪৪০টি পরিবার। ৬৫ হাজার পাঁচশ ৬০ জন ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
নতুন করে বৃষ্টিপাত না হওয়ায় মৌলভীবাজারে কমতে শুরু করেছে নদ-নদীর পানি। তবে বন্যাদুর্গত এলাকায় খাবার ও পানি সংকট দেখা দেওয়ায় দুর্ভোগ আরও বাড়ছে। সড়কে ভাঙন ও পানি প্রবাহিত হওয়ায় জেলা সদরের সঙ্গে কুলাউড়া, রাজনগর ও কমলগঞ্জ উপজেলার অনেক স্থানে যোগাযোগ এখনো বিচ্ছিন্ন রয়েছে। জেলার রাজনগর, কমলগঞ্জসহ পাঁচটি উপজেলার ১৩টি স্থানে বাঁধ ভেঙে বন্যার পানি প্রবেশ করছে। এতে দুই শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে, পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন লক্ষাধিক মানুষ।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবায় বন্যার পানি কমতে শুরু করেছে। তবে এখনো উপজেলার ৪০টি গ্রামের ২০ হাজার মানুষ পানিবন্দি রয়েছেন। উপজেলার বিজনা, সালদা, সিনাই, বুড়ি নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হলেও গতকাল ১০ সেন্টিমিটার কমেছে। আখাউড়ায় বন্যার পানি কমতে থাকায় পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। গতকাল হাওড়া নদীর পানি বিপদসীমার ৫৩ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়। তবে বিভিন্ন স্থানে সড়ক ও বাঁধ ভেঙে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় বন্ধ রয়েছে আখাউড়া স্থলবন্দরের বাণিজ্যিক কার্যক্রম। বন্ধ রয়েছে আখাউড়া ইমিগ্রেশন চেকপয়েন্ট হয়ে আসা-যাওয়া। এ ছাড়া নিরাপত্তার স্বার্থে এখনো বেশ কয়েকটি গ্রামে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে।
ফটিকছড়িতে নিহত ২
চট্টগ্রামের ফকিটছড়িতে বন্যায় দুজনের মৃত্যুর সংবাদ পাওয়া গেছে। উদ্ধারকাজে সহযোগিতা করতে গিয়ে নিখোঁজ যুবক ইমরান হোসেনের লাশ দুদিন পর গতকাল সন্দ্বীপ নগর কৈয়া রোডসংলগ্ন জমি থেকে এবং বন্যার পানিতে নিখোঁজের একদিন পর বৃদ্ধ রজি আহমদের লাশ গত শুক্রবার রাতে উদ্ধার করা হয় বলে উপজেলা পরিষদের বন্যা নিয়ন্ত্রণ কক্ষের একটি সূত্র জানিয়েছে। ইমরান নারায়ণহাট ইউপির তাজুল ইসলামের ছেলে এবং রজি আহমদ উপজেলার ভূজপুর ইউপির পূর্ব ভূজপুর গ্রামের সুলতান আহমেদের ছেলে। এদিকে পশ্চিম সুন্দরপুর গ্রামে ঘরে বিদ্যুতের কাজ করতে গিয়ে বিদ্যুৎস্পর্শে গতকাল বিকালে বিদ্যুৎমিস্ত্রি রমজান আলী মারা যান। তিনি উপজেলার পশ্চিম সুন্দরপুর গ্রামের কান্দির পাড়ার মোহরম আলীর ছেলে।
সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ সব সংবাদ, ছবি ,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন। ভিজিট করুন : http://www.etihad.news
* অনলাইন নিউজ পোর্টাল ইত্তেহাদ নিউজে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়