বাংলাদেশ ঢাকা

ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ড থেকে রাজনৈতিক অঙ্গন ‘ক্যাসিনো সাঈদ’

1676647826
print news

ইত্তেহাদ নিউজ,ঢাকা : ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ড থেকে রাজনৈতিক অঙ্গন- সব জায়গায় এখন আলোচিত নাম মমিনুল হক সাঈদ ওরফে ‘ক্যাসিনো সাঈদ’। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ‘পলাতক’ সাঈদের বিরুদ্ধে দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। অর্থাৎ পাসপোর্ট ব্যবহার করে বৈধ পথে দেশে ঢুকতে বা বের হতে গেলেই তার গ্রেফতার হওয়ার কথা। তাহলে কীভাবে নির্বিঘ্নে দেশে ফিরে সব মামলায় জামিন নিয়ে প্রকাশ্যে এলেন তিনি? এই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গিয়ে বেরিয়ে এসেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য।

জানুয়ারির শেষদিকে ওমান থেকে কলকাতা আসেন সাঈদ। এরপর ৩০ জানুয়ারি বেনাপোল সীমান্ত এলাকা দিয়ে অবৈধভাবে দেশে ঢুকে অতিগোপনে পরপর তিনটি মামলায় জামিন নেন। জামিন পেয়েই মতিঝিল ও আরামবাগ এলাকার হারানো আধিপত্য কবজা করার সব বন্দোবস্ত করেই মঙ্গলবার হকি ফেডারেশনের সভায় যোগ দেন তিনি। এরপরই সব মহলে হইচই পড়ে যায়। ঘনিষ্ঠজনরাও ক্যাসিনো সাঈদের এই ক্যারিশমা দেখে বিস্ময়ে হতবাক। এদিকে সাঈদ প্রকাশ্যে ফিরতেই এলাকায় তা-ব শুরু করেছে তার ক্যাডার বাহিনী। চাঁদাবাজি ও অবৈধ অর্থের উৎসের দখল ফিরে পেতে মরিয়া হয়ে উঠেছে তারা।

মঙ্গলবার জামাল ওরফে ক্যাসিনো জামালের সশস্ত্র ক্যাডার বাহিনী স্থানীয় মৎস্যজীবী লীগের সভাপতি আহমদ ইসলাম পুতুলের ওপর হামলা চালিয়েছে। তাকে নির্মমভাবে পিটিয়ে আহত করা হয়েছে। মুগদা জেনারেল হাসপাতালের সিসিইউতে গুরুতর অবস্থায় চিকিৎসাধীন তিনি। মারধর করা হয়েছে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী রহমত আলী ও তার স্ত্রী মর্জিনাকে। স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোজাম্মেল হককেও লাঞ্ছিত করেছে তারা। সাঈদের সেকেন্ড ইন কমান্ড যুবলীগের বহিষ্কৃত স্থানীয় নেতা জামালের নেতৃত্বে চাঁদাবাজ বাহিনী ফের গা-ঝাড়া দিয়ে ওঠায় এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।

অনুসন্ধানে জানা যায় উল্লিখিত সব তথ্য। সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০১৯ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরুর এক সপ্তাহ আগে সিঙ্গাপুর যান মমিনুল হক সাঈদ। এর পাঁচ মাস আগে ২০১৯ সালের ২৯ এপ্রিল হকি ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের পর তার বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের মামলা করে দুদক। আর সিআইডি করেছে অর্থ পাচারের পৃথক দুটি মামলা। এসব মামলায় গ্রেফতার এড়াতে তখন আর দেশে ফেরেননি তিনি। তবে সিঙ্গাপুর থেকে পাড়ি জমান ওমানে। দেশ থেকে বিপুল অর্থ পাচার করে সেখানে তিনি বিত্তবৈভব গড়ে তুলেছেন বলে জানতে পেরেছে সিআইডি।

তিন বছর পর সেখান থেকে দেশে ঢুকে গ্রেফতার এড়িয়ে প্রকাশ্যে আসতে সক্ষম হওয়ায় তার ঘনিষ্ঠজনরাও মনে করছেন সবকিছু ‘ম্যানেজ’ করে ফেলেছেন সাঈদ। তাই তাকে আর জেলে যেতে হবে না। মমিনুল হক সাঈদ বলেন, ‘কবে, কীভাবে, কোন প্রক্রিয়ায় দেশে ফিরেছি, কীভাবে জামিন পেয়েছি, তা একান্তই আমার বিষয়। এ সংক্রান্ত কোনো প্রশ্নের জবাব আমি দেব না। তবে আমি সব মামলায় স্থায়ী জামিনে আছি। আর আমি এই প্রথম হকি ফেডারেশনের সভায় যোগ দিইনি। বিদেশে থাকা অবস্থায় করোনাকালীন অনলাইনে ফেডারেশনের অনেক সভায় অংশ নিয়েছি।’

মতিঝিল ও আরামবাগ এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, তার বাহিনীর টেন্ডার ও চাঁদাবাজি সম্পর্কে জানতে চাইলে বলেন, ‘আমি মতিঝিল-আরামবাগ এলাকায় থাকি না। আমার কোনো বাহিনী নেই। তিন বছর বাইরে থাকলে আমার বাহিনী থাকে কীভাবে।’ যুবলীগের বহিষ্কৃত নেতা জামাল আপনার সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসাবে চাঁদাবাজ ও দখলদার বাহিনীর নেতৃত্ব দিচ্ছেন কি না-জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘জামাল নামে কাউকে আমি চিনি না।’ মতিঝিল ও আরামবাগে সরেজমিনে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, সাঈদের চাঁদাবাজ বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ করেন যুবলীগের বহিষ্কৃত নেতা হাসান উদ্দিন জামাল ওরফে ক্যাসিনো জামাল। মতিঝিল ও আরামবাগের সব ফুটপাতের দোকান থেকে চাঁদা তোলে জামাল গ্রুপ। তার ক্যাডার বাহিনী মঙ্গলবার মতিঝিল এলাকায় মৎস্যজীবী লীগ নেতা আহমদ ইসলাম পুতুলের ওপর হামলা চালায়।

এ ঘটনায় মামলা হলেও পুলিশ কাউকে গ্রেফতার করেনি। উল্টো যাকে পিটিয়ে আহত করা হয়েছে, সেই পুতুলকে প্রধান আসামি করে পালটা একটি মামলা করেছে হামলাকারীরা। আহত পুতুলের বড় ভাই স্থানীয় যুবলীগ নেতা নূরুল ইসলাম চৌধুরী নুরু বলেন, সাঈদ প্রকাশ্যে আসার পর তার ক্যাডার বাহিনী বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। আমার ভাই মতিঝিল ও দিলকুশায় হোটেল ও ক্ষুদ্র দোকানগুলোয় দুধ ও চা-পাতা সরবরাহের ব্যবসা করেন। মঙ্গলবার বিল তুলতে গেলে তার ওপর হামলা চালানো হয়।’ স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সাঈদের ক্যাডার বাহিনীর সদস্যরা মোহামেডান ক্লাব থেকে সেনাকল্যাণ ভবন পর্যন্ত ফুটপাতে চাঁদাবাজি, ফুটপাতের দোকানগুলোয় দুধ-চা পাতা সরবরাহ, মাদক বাণিজ্যসহ অবৈধ আয়ের সব উৎস নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে।

এ এলাকায় ইয়াবার ডিলার হিসাবে সক্রিয় জামালের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হত্যা, অস্ত্রসহ অন্তত ৬টি মামলার আসামি শফিকুল ইসলাম ইকবাল ওরফে নাইন ইকবাল (নাইন এমএম পিস্তলসহ গ্রেফতার হওয়ায় তিনি নাইন ইকবাল হিসাবে পরিচিতি পান)। এছাড়া এই এলাকা থেকে চাঁদা তোলার কাজ করে জয়, মোস্তফা ও বসির। সেনাকল্যাণ ভবনের পাশের একটি মার্কেটের চারটি দোকানও দখল করেছে জামাল ও তার সহযোগীরা।

এছাড়াও অবজারভার ভবনের পাশে জায়গা দখল করে ১৫-১৬টি দোকান বানিয়ে ভাড়া দিয়েছে জামাল। এখান থেকে মাসে অন্তত ৪ লাখ টাকা ভাড়া আসে। আর আরামবাগ প্রেস এলাকায় চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করে আকাশ। প্রেসে যারা কালি, কাগজসহ বিভিন্ন ধরনের মালামাল সরবরাহ করেন, তাদের কাছ থেকে চাঁদা তোলা হয়। এছাড়া মতিঝিলের হোটেল পূর্বাণীতে রাতের আসরে মাদক সরবরাহ করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন আকাশ। এই আকাশই স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোজাম্মেল হককে লাঞ্ছিত করেন।

মোজাম্মেল হক বলেন, ‘সাঈদ প্রকাশ্যে আসার পর মতিঝিল-আরামবাগ এলাকায় ক্যাসিনো গ্রুপ ফের পুরোমাত্রায় সক্রিয়। তারা এরই মধ্যে আরামবাগে রাজাকার ভবন হিসাবে পরিচিত হাজীর বিল্ডিংয়ের পেছনের অংশে চারটি কক্ষ ফের দখলে নিয়েছে।’ মতিঝিল এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে ময়লা তোলার ব্যবসা করেন মর্জিনা আক্তার। তিনি জানান, জামাল গ্রুপের ক্যাডার মহসীন তার অফিস কক্ষ দখল করে ভাড়া দিয়েছে। মারধর করেছে তাকে ও তার স্বামীকে।

স্থানীয়রা জানান, সাঈদের টেন্ডার, চাঁদাবাজি, দখল বাণিজ্যে সক্রিয় সদস্যদের মধ্যে আরও আছেন জসিম, সোলেমান, মহসীন, মঞ্জু, ভাগনে হাসান, জাকির, হেমায়েত, সেন্টু ও জাকির। জামাল উদ্দিন ওরফে ক্যাসিনো জামাল বলেন, ‘ক্যাসিনোকা-ের সময় আমাকে বহিষ্কার করা হলেও মহানগরের নির্দেশে ৯ নম্বর ওয়ার্ডের দলের কার্যক্রম আমিই চালাই। তবে আমি চাঁদাবাজি ও দখলবাজির কোনো ঘটনার সঙ্গে জড়িত নই।’

জানা যায়, ২০১৫ সালে ঢাকা সিটি করপোরেশনের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও যুবলীগ নেতা ছিলেন মমিনুল হক সাঈদ। সেই প্রভাবে প্রথমে তিনি ওয়ান্ডারার্স ক্লাবে জুয়ার বোর্ড বসিয়ে ক্যাসিনো কারবার চালু করেন। এরপর মোহামেডান, আরামবাগসহ চারটি ক্লাবে বিস্তৃত করেন অবৈধ এই বাণিজ্য। ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরু হওয়ার পর তিনি পরিচিতি পান ‘ক্যাসিনো সাঈদ’ হিসাবে। অভিযানের পর সাঈদের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের মামলা করে দুদক।

মামলাটি এখন আদালতে বিচারাধীন। আর ক্যাসিনো কারবার থেকে উপার্জিত বিপুল অর্থ পাচারের অভিযোগে মানিলন্ডারিং আইনে তার বিরুদ্ধে দুটি মামলা করে সিআইডি। এর মধ্যে একটি মামলা এখনো তদন্তাধীন থাকলেও অন্য মামলাটি আদালতে বিচারাধীন। এ অবস্থায় তিনি সরাসরি কীভাবে মামলা তিনটিতে জামিন পেলেন, তা নিয়ে বিভিন্ন মহলে নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে।

 

সর্বশেষ  গুরুত্বপূর্ণ  সব  সংবাদ, ছবি ,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও লেখা পেতে আমাদের  ফেসবুক পেইজে  লাইক  দিয়ে  অ্যাকটিভ  থাকুন।  ভিজিট করুন : http://www.etihad.news

* অনলাইন  নিউজ পোর্টাল  ইত্তেহাদ নিউজে  লিখতে  পারেন  আপনিও। লেখার বিষয়  ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন  [email protected] ঠিকানায়

 

সংবাদটি শেয়ার করুন....
ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক :

ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক :

About Author

etihad news is one of the famous Bangla news portals published from Abudhabi-UAE. It has begun with a commitment to fearless, investigative, informative, and independent journalism. This online portal has started to provide real-time news updates with maximum use of Smart Technology.

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *