বিশেষ সংবাদ

ঘুষ-দুর্নীতির টাকায় বেগমপাড়ায় বিলাসী জীবন

1725738590 75d5a13ca2f7f026f5485e7821c936da
print news

ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্কঘুষ, দুর্নীতিসহ নানা অবৈধ উপায়ে দেশের সাধারণ মানুষের টাকা লুটে নিয়ে একদল বিলাসী জীবন যাপন করছে কানাডার বেগমপাড়ায়, কেউ বা দুবাই, মালয়েশিয়ায়-সিঙ্গাপুরে। দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদ, সুবিধাবাদী আমলা, ক্ষমতার শীর্ষ মহলের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীরা হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট করে এখন লাপাত্তা।

একসময় ওই সব ‘সাহেব’ দেশে টাকা লুট করতেন, আর তা নিজেদের বউ-বাচ্চাদের ‘বেগমপাড়া’ কিংবা ‘সেকেন্ড হোমে’ বিলাসী জীবনযাপনের জন্য পাঠাতেন। এখন ওই ‘সাহেব’দেরও অনেকে ‘বেগম’দের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন।
অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর রীতিমতো কানাডার ‘বেগমপাড়া’ কিংবা সেকেন্ড হোমে দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়া রাজনীতিবিদ, আমলা আর ব্যবসায়ীর ভিড় বেড়েছে বলে জানা গেছে। বিভিন্ন সূত্র থেকে খোঁজ নিয়ে আরো জানা যায়, মামলা, জেল-জরিমানা আর শাস্তির ভয়ে তাঁরা বিভিন্ন উপায়ে ওই সব উন্নত দেশে পাড়ি জমাচ্ছেন। তবে সরকার এঁদের পাচার করা টাকা ফিরিয়ে আনতে কঠোর অবস্থান নিয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা ও অর্থ উপদেষ্টা এরই মধ্যে অন্তত পাচারের এক লাখ কোটি টাকা ফেরাতে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন।

আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সংসদ সদস্য মাহবুবউল আলম হানিফ। তাঁর দুই ছেলে ফাহিম আফসার আলম ও ফারহান সাদিক আলম এবং মেয়ে তানিশা আলম থাকেন কানাডার টরন্টোতে। হানিফের বড় ভাই রফিকুল আলম চুন্নুও সপরিবারে থাকেন কানাডায়। সাবেক এই সংসদ সদস্যের স্ত্রী-সন্তান ও পরিবারের অন্য সদস্যদের নামে রয়েছে বিলাসবহুল বাড়ি, গাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান।

যদিও উচ্চতর শিক্ষার উদ্দেশ্যে বিদেশে পাড়ি দিয়েছিলেন মাহবুবউল আলম হানিফের সন্তানরা।
এদিকে ছাগলকাণ্ডে অবসরে যাওয়া এনবিআরের সাবেক কর্মকর্তা মতিউর রহমানের মেয়ে ফারজানা রহমান ইপসিতার বাড়ি রয়েছে কানাডার ব্যারি সিটিতে। চলতি বছরের ১২ জানুয়ারি আট লাখ ৮৮ হাজার কানাডিয়ান ডলারে বাড়িটি কেনেন তিনি। এ সময় রেজিস্ট্রেশন ও জমি ট্রান্সফার ফি বাবদ আরো প্রায় সাড়ে ১০ হাজার কানাডিয়ান ডলার খরচ হয়েছে। অর্থাৎ বাড়িটির মালিক হতে ইপসিতাকে খরচ করতে হয়েছে বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৯ কোটি টাকা।

যদিও ৩২ বছর বয়সী ইপসিতা নিজেকে মেকআপ আর্টিস্ট হিসেবে পরিচয় দিতেন।
এ দুটি উদাহরণমাত্র। এ রকম অসংখ্য প্রভাবশালী বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা, দুর্নীতিবাজ আমলা, প্রকৌশলী, পুলিশ, পোশাক কারখানার মালিক, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালকরাও নামে-বেনামে সম্পদ কিনেছেন কানাডার বেগমপাড়ায়। তাঁদের কেউ আবার যুক্তরাষ্ট্র, আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরসহ অনেক দেশে দামি বাড়ি, গাড়ির মালিক হয়ে বিলাসী জীবন যাপন করছেন। বিতর্কিত ব্যবসায়ী এস আলম ছয়-সাতটি ব্যাংক থেকে প্রায় লাখো কোটি টাকা লুটে নিয়েছেন বলে খবর হয়েছে। এ টাকায় তিনি সিঙ্গাপুরে সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন। সামিট গ্রুপের মুহাম্মদ আজিজ খান দেশের টাকা নিয়ে সিঙ্গাপুরের শীর্ষ ১০ ধনীর একজন হয়েছেন। তথ্য-উপাত্ত বলছে, এ রকম উদাহরণ অসংখ্য। তবে ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকায় এত দিন তাঁদের কাউকেই ধরা যায়নি।

জানা যায়, গত প্রায় ১৬ বছরে ওভার ও আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে অবৈধ চ্যানেল ও হুন্ডির মাধ্যমে বিপুল অর্থ পাচার করেছেন তাঁরা। এখন এই পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনার জন্য জোর তৎপরতা শুরু হয়েছে। এরই মধ্যে অনেকের দেশে থাকা ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করা হয়েছে। বিদেশে খোঁজখবর করা হচ্ছে। বাংলাদেশ ফিন্যানশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটসহ (বিএফআইইউ) সরকারের যত সংস্থা রয়েছে, সেগুলো কাজ শুরু করেছে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, এ সরকারের অন্যতম অগ্রাধিকার হচ্ছে শেখ হাসিনার ১৫ বছরের স্বৈরাচারী শাসনামলে পাচার হওয়া বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনা। এদিকে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনতে একটি টাস্কফোর্স গঠনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে সম্প্রতি জানিয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। পাশাপাশি পাচার বন্ধ ও পাচারকৃত অর্থ পুুনরুদ্ধারে নাগরিকের পরামর্শ চেয়েছে অর্থনৈতিক অবস্থার ওপর শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি।

সূত্র বলছে, কানাডার টরন্টো শহরের বিভিন্ন অভিজাত এলাকার পাশাপাশি মিসিসওগা, হ্যামিল্টন, গুয়েল্ফ ও অন্টারিও লেকের পাশের উপশহরগুলোর প্রাসাদোপম অট্টালিকা ক্রয় করেছেন দুর্নীতিবাজ আমলা ও রাজনীতিকরা। সেখানে বসবাস করছেন তাঁদের স্ত্রী-সন্তানরা। অবসরে অবকাশ যাপনে তাঁরাও বিভিন্ন সময় পাড়ি দেন দেশটিতে। এদিকে গত ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ওই সব ‘সাহেব’ ‘বেগম’দের সঙ্গে কানাডায় যোগ দিয়েছেন।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফিন্যানশিয়াল ইনটিগ্রিটির (জিএফআই) তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, আওয়ামী লীগ সরকারের গত দেড় দশকের শাসনামলে দেশ থেকে অন্তত ১৪ হাজার ৯২০ কোটি বা ১৪৯.২০ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে। বাংলাদেশি মুদ্রায় পাচারকৃত অর্থের পরিমাণ দাঁড়ায় অন্তত ১৭ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা (প্রতি ডলারে ১১৮ টাকা ধরে)। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের তীব্র ডলার সংকটের মধ্যেও এ ধারা অব্যাহত ছিল

জিএফআইয়ের প্রতিবেদন বলছে, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের আড়ালে ওভার ও আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে গড়ে ৬৪ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হচ্ছে। ২০১৬ থেকে ২০২০ সালে অর্থাৎ পাঁচ বছরে পাচারকারীরা তিন লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা পাচার করেছে, যার মধ্যে শুধু ২০১৫ সালে এক বছরেই পাচার হয়ে যায় ৯৮ হাজার কোটি টাকা। পাচারকৃত টাকার পরিমাণ বিবেচনায় ২০১৯ সালে দক্ষিণ এশিয়ায় পাচারকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়।

বাংলাদেশ ফিন্যানশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের তথ্য বলছে, মূলত আমদানি-রপ্তানির সময় পণ্যের প্রকৃত মূল্য গোপন, বিল কারচুপি, ঘুষ, দুর্নীতি, আয়কর গোপন ইত্যাদির মাধ্যমে বিদেশে পাচার হয়েছে। অর্থপাচার রোধে সরকারের কিছু নীতিমালা থাকলেও এর সুষ্ঠু ও কার্যকর বাস্তবায়নের অভাবে দেশ থেকে অর্থপাচার রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। ২০১২ সালের মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের সংস্কারের কথা বলা হলেও আজ পর্যন্ত তা করা হয়নি।

সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ডিসেম্বর শেষে সুইস ব্যাংকের কাছে বাংলাদেশিদের আমানত জমা আছে ২৩৪ কোটি টাকা বা এক কোটি ৭৭ লাখ ফ্রাঁ (প্রতি ফ্রাঁ ১৩২ টাকা)। তবে পাচারকারীরা এখন সুইস ব্যাংকের বিকল্প হিসেবে ইউএসএ, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়াসহ অনেক দেশে অর্থ পাচার করছে বলে জানা গেছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আল-আমিন বলেন, ‘গত ১৫ বছরে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রজেক্টের আড়ালে হাজার হাজার কোটি টাকা লুট হয়েছে। লুট করে স্ত্রী-সন্তানদের নামে হুন্ডি এবং ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে এ টাকা পাচার করা হয়েছে। শুধু ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ও বিও হিসাব ফ্রিজ করে দুর্নীতিবাজদের সম্পদ দেশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। তদন্তের মাধ্যমে তাদের চিহ্নিত করে সেই সম্পদও জব্দ করার প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে। ’

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনার বিষয়ে একটি নীতিমালা আছে। এই নীতিমালার আলোকে অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক, বিএফআইইউ, দুদক, এনবিআর, সিআইডিসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে সমন্বয় করে কাজ করতে হবে। যেসব দেশে পাচার হয়েছে সে দেশগুলো চিহ্নিত করে চুক্তি করার মাধ্যমে অর্থ ফেরত আনা সম্ভব। এ প্রক্রিয়ায় অনেক আগে সিঙ্গাপুর থেকে একজনের পাচার করা অর্থ ফেরত আনাও হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার পাচার করা অর্থ ফেরত আনার বিষয়ে যে উদ্যোগ নিয়েছে সেটি প্রশংসনীয়। যদি সেটি করা যায়, তাহলে দেশে দৃষ্টান্ত স্থাপন হবে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক চেয়ারম্যান ও সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনে (এসডিএফ) চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ বলেন, ‘কেউ কারো কষ্টার্জিত অর্থ বিদেশে পাচার করে না। অবশ্যই দুর্নীতি ও অনিয়মের মাধ্যমে অর্জিত অর্থই বিদেশে পাচার করেছে। অনিয়মের মাধ্যমে অর্জিত অর্থকে আয়কর নথিতে প্রদর্শন করার সুযোগ নেই।

পাচার অর্থ উদ্ধার বা ফিরিয়ে আনতে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে পারস্পরিক আইনগত সহায়তা চুক্তির (এমএলএ) পাশাপাশি ‘জিটুজি’ (সরকারের সঙ্গে সরকারের) চুক্তির উদ্যোগ নিতে বলেছিলেন হাইকোর্ট।

বাংলাদেশ ফিন্যানশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের প্রতিবেদন দেখে ২০২২ সালের ২৬ অক্টোবর এ আদেশ দিয়েছিলেন।

সুইস ব্যাংকে অর্থ জমাকারী বাংলাদেশিদের বিষয়ে সুইস সরকারের কাছে বাংলাদেশ সরকার সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য চায়নি বাংলাদেশ সরকার। ২০২২ সালের ১০ আগস্ট কূটনৈতিক বিটের সাংবাদিকদের সংগঠন ডিক্যাবের অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রশ্নে এ কথা বলেছিলেন সুইজারল্যান্ডের তৎকালীন রাষ্ট্রদূত নাতালি চুয়ার্ড। তার এ বক্তব্য পরে আদালতের নজরে আসে। গত ১১ আগস্ট স্বপ্রণোদিত হয়ে আদালত নাতালি চুয়ার্ডের বক্তব্যের সত্যতা জানতে সরকার ও দুদকের কাছে ব্যাখ্যা চান।

এর পরিপ্রেক্ষিতে দেওয়া প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, পাচার হওয়া অর্থ উদ্ধারে প্রয়োজনীয় তথ্য, সাক্ষ্য-প্রমাণ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সহায়তা পেতে অন্তত ১০টি দেশের সঙ্গে পারস্পরিক আইনগত সহায়তা চুক্তির (এমএলএ) উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। দেশগুলো হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সুইজারল্যান্ড, থাইল্যান্ড, হংকং, চীন। এ চুক্তি সইয়ের যৌক্তিকতা অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগকে জানানো হয়েছে বলে উল্লেখ ছিল বিএফআইইউয়ের প্রতিবেদনে। সূত্র : কালের কণ্ঠ

 

সর্বশেষ  গুরুত্বপূর্ণ  সব  সংবাদ, ছবি ,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও লেখা পেতে আমাদের  ফেসবুক পেইজে  লাইক  দিয়ে  অ্যাকটিভ  থাকুন।  ভিজিট করুন : http://www.etihad.news

* অনলাইন  নিউজ পোর্টাল  ইত্তেহাদ নিউজে  লিখতে  পারেন  আপনিও। লেখার বিষয়  ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন  [email protected] ঠিকানায়

সংবাদটি শেয়ার করুন....
ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক :

ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক :

About Author

etihad news is one of the famous Bangla news portals published from Abudhabi-UAE. It has begun with a commitment to fearless, investigative, informative, and independent journalism. This online portal has started to provide real-time news updates with maximum use of Smart Technology.

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *