অনুসন্ধানী সংবাদ

দুর্নীতির বরপুত্র যখন যুবরত্ন সাদিক আব্দুল্লাহ

sadik abdulla news pic 2410191344
print news

বরিশাল অফিসঅনিয়ম ও দুর্নীতির বরপুত্র ছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ফুফাতো ভাইয়ের ছেলে বরিশাল সিটির সাবেক মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ। আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী হিসেবে ২০১৮ সালের সিটি নির্বাচনে একতরফা জয় পান তিনি। ক্ষমতায় থাকাকালে বরিশালে লুটপাট ও দুর্নীতির এক অন্ধকার সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

সাদিক আব্দুল্লাহর বাবা আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগ্নে এবং পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট শহীদ আবদুর রব সেরনিয়াবাতের ছেলে। আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ বরিশাল-১ আসনের সাবেক এমপি এবং জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন।

স্থানীয়রা জানায়, মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর নকশাবহির্ভূত নির্মাণের কারণ দেখিয়ে বাড়ি ভেঙে দেওয়া, জরিমানার নামে টাকা আদায়, ব্যবসায়ীদের কাছে কমিশন দাবি, ভবন নির্মাতাদের কাছে ফ্ল্যাট দাবি, রাজনৈতিক বিরোধীদের মারধর, কথায় কথায় সিটি করপোরেশনের কর্মচারীদের চাকরিচ্যুত করাসহ বহু অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে সাদিকের বিরুদ্ধে। তার নির্দেশে না চললে হয়রানি ও মিথ্যা মামলায় জেল পর্যন্ত খাটাতে হয়েছে অনেককে। পূজা উদযাপন পরিষদের কমিটি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কমিটি, বরিশাল ক্লাবও দখল করেছেন তিনি। কিন্তু এত কিছুর পরেও কেউ টুঁ শব্দ করতে পারেনি তার বিরুদ্ধে। তবে তিনি ক্ষমতা হারানোর পর তার বিরুদ্ধে প্রকাশিত হতে শুরু করেছে বরিশালবাসী দীর্ঘদিন ধরে চাপা ক্ষোভ।

স্থানীয় এক ব্যবসায়ী (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) বলেন, ‘যদি তার নির্দেশ অনুযায়ী না চলা হতো, তাহলে বুলডোজার দিয়ে আমাদের ভবন ভেঙে দেওয়া হতো। বরিশালে তার বিরুদ্ধে কেউ কিছু বলার সাহস পেত না।

সাদিক আব্দুল্লাহ নগর আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক হিসেবে ছয়জন অনুসারী দিয়ে পুরো নগরী পরিচালনা করতেন। নগরের সব হাটবাজার, লঞ্চঘাট, খেয়াঘাট নিয়ন্ত্রণ করতেন তার অন্যতম অনুসারী নগর আওয়ামী লীগের শিল্পবিষয়ক সম্পাদক নীরব হোসেন টুটুল। তিনি সাদিকের চাঁদাবাজির টাকা তুলতেন। বর্তমানে টুটুল ভারতে অবস্থান করছেন। শ্রমিক লীগ নেতা রঈজ আহমেদ মান্না বাস টার্মিনালে চাঁদাবাজি করতেন।
স্থানীয় ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেছেন, চাঁদা না দিলে কাউন্টার বন্ধ করে দেওয়া হতো। এ ছাড়া ছাত্রলীগ নেতা সাজ্জাদ সেরনিয়াবাত সিটি করপোরেশনের প্ল্যান পাস করানোর বিনিময়ে ঘুষ নিতেন।

সাদিকের ক্ষমতা ব্যবহারের একটি উজ্জ্বল উদাহরণ হচ্ছে বরিশাল বিএম কলেজ ছাত্রলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক মঈন তুষার। তিনি অভিযোগ করেন, মহানগর আওয়ামী লীগ একতরফা গঠিত হয়েছে। সাদিক নিজের বলয় দিয়ে একতরফা দল চালাতেন, যেখানে ব্যক্তির স্বার্থের জন্য সংগঠনকে ব্যবহার করা হয়েছে।

বরিশাল নগর আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি রেজাউল হক হারুন বলেছেন, এখানে ব্যক্তি রাজনীতি হয়েছে। হাসানাত পরিবার এই রাজনীতিকে শো করে ব্যবসা করেছে।এদিকে মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আনোয়ার হোসেন সম্প্রতি একটি জাতীয় গণমাধ্যমে বলেন, নেতারা দল করেননি, ক্যাডার দিয়ে লুটপাট করছেন।

সাদিক মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর নকশাবহির্ভূত নির্মাণের কারণ দেখিয়ে বাড়ি ভেঙে দেওয়া, জরিমানার নামে টাকা আদায়, ব্যবসায়ীদের কাছে কমিশন দাবি, ভবন নির্মাতাদের কাছে ফ্ল্যাট দাবি, রাজনৈতিক বিরোধীদের মারধর, কথায় কথায় সিটি করপোরেশনের কর্মচারীদের চাকরিচ্যুত করাসহ বহু অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠে তার বিরুদ্ধে। তার নির্দেশে না চললে হয়রানি ও মিথ্যা মামলায় জেল পর্যন্ত খাটাতে হয়েছে অনেকে। পূজা উদযাপন পরিষদের কমিটি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কমিটি, বরিশাল ক্লাবও দখল করেছেন তিনি। কিন্তু এতো কিছুর পরেও কেউ টুঁ শব্দ করতে পারেননি তার বিরুদ্ধে।

স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, মেয়র এবং সাধারণ সম্পাদকের পদ পেয়ে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন সাদিক আবদুল্লাহ। তার অনুগতরা পান আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের পদপদবি। তার বিরোধিতা করলে শুধু অপমান, হয়রানি, মামলা নয়, নকশাবহির্ভূত নির্মাণের অভিযোগ তুলে বাড়িতে সিটি করপোরেশনের বুলডোজার চালানোর ভয়ে সবাই চুপ থাকতেন।

এমনকি সাদিকবিরোধী হিসেবে পরিচিত আওয়ামী লীগ নেতারাও এলাকায় রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করতে পারেননি। অনেকে ছিলেন এলাকাছাড়া। মন্ত্রী পদমর্যাদা না পেলেও সাদিক মন্ত্রীদের মতো গাড়িবহরে পুলিশের জিপসহ প্রটোকল নিয়ে চলতেন। তাতে জনমানুষের মাঝে ভয় আরও বাড়ে।

গত সিটি নির্বাচনে সাদিককে মনোনয়ন বঞ্চিত করে তার আপন চাচা খোকন সেরনিয়াবাতকে মনোনয়ন দেয় দল। এরপরই বরিশাল-৫ সদর আসনের সাবেক সংসদ সদস্য পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক শামীম এক মতবিনিময় সভায় বলেছেন, বরিশাল মুক্ত হয়েছে। বরিশালে অনেক অন্যায়, অবিচার, শোষণ ও সন্ত্রাস হয়েছিল। বরিশালের মানুষ অনেক কষ্টে এই দিনগুলো অতিবাহিত করেছে। কত লোককে তারা আহত করেছে, বেইজ্জতি করেছে।

এমনকি নিয়মবহির্ভূতভাবে ২০১৯ সালের মার্চে নির্বাচন ছাড়াই বরিশাল ক্লাবের সভাপতির পদ দখল করেন নেন সাদিক। নিয়মানুযায়ী ক্লাবের সভাপতি হতে হলে সদস্য হিসেবে অন্তত ১০ বছর থাকতে হয়। কিন্তু ২০১৬ সালে সদস্য হওয়া সাদিক ভোট ছাড়াই সভাপতি বনে যান। এরপর নিজের ইচ্ছে মত দলের লোকজনকে সদস্য পদ দিয়ে ক্লাব দখল করে নেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সাদিক মেয়র থাকাকালীন বরিশালে যারাই ভবন নির্মাণ করেছে, তাদের কাছে কমিশন হিসেবে ফ্ল্যাট অথবা ফ্লোর চাইতেন। না দিলে সিটি করপোরেশনের লোক পাঠিয়ে কাজ বন্ধ করে দিতেন। এমনকি নিজের মামার নির্মাণাধীন পাঁচতলা পর্যন্ত ভবনেও অংশীদারিত্ব চেয়েছিলেন সাদিক। রাজি না হওয়ায় ভবনটি নকশা মেনে হচ্ছে না অভিযোগ দিয়ে চার পাশ থেকে ১০ ফুট করে ভেঙে দেয় সিটি করপোরেশন।

এছাড়া আদালতের নিষেধাজ্ঞা জারি করা জমি ও ঢাকা-বরিশাল মহাসড়ক দখল করে নিজের মায়ের নামে করেন ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহান আরা বেগম পার্ক’। এ সময় বিভিন্ন অনিয়ম দুর্নীতি নিয়ে গনমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হলেও তার তোয়াক্কা করেননি সাদিক। সাদিকের ভয়ে সড়ক ও জনপথ বিভাগ (সওজ) কর্তৃপক্ষের কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেননি। এ ঘটনায় মহাসড়ক-লাগোয়া জমির মালিক দাবিদার মনোয়ার হোসেন হাওলাদার সিটি করপোরেশনের মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ মো. ফারুকের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার মামলাও করেন।

মামলার আইনজীবী অ্যাডভোকেট আজাদ রহমান বলেন, যেখানে পার্ক নির্মিত করেছে, তার পাশেই দেড় শতক জমির মালিকানা নিয়ে স্থানীয় বাসিন্দা মনোয়ার হোসেনের সঙ্গে বিসিসির আদালতে মামলা চলছে। আদালত ২০১৯ সালের ২৯ আগস্ট বিরোধ চলা জমিতে স্থিতাবস্থা জারি করেছেন। কিন্তু সাদিক আদালতের আদেশ উপেক্ষা করে ওই জমিতে থাকা মনোয়ার হোসেনের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দিয়ে পার্ক নির্মাণ করেছেন।সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর নিজের দলীয় পাঁচ শতাধিক ব্যক্তিকে নিয়োগ ছাড়াই বেতন দিতেন সাদিক আবদুল্লাহ। এছাড়া নিজের পছন্দমতো ১৩৯ জনকে সিটি করপোরেশন থেকে করেছেন বরখাস্ত। চাকরিচ্যুত এসব লোকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, তারা কাজ করেও বরখাস্তের শিকার হয়েছেন। কারণ তার মেয়েরপন্থী ছিলেন না বলে। সিটির সাবেক কাউন্সিলররা বলেন, সাবেক মেয়র সাদিক আব্দুল্লাহ যাদের মৌখিক নিয়োগ দিয়েছিলেন। তাদের কাজই ছিল সারাদিন ঘোরাফেরা করা আর মাস শেষে বেতন নেয়া।বরিশালের সামাজিক সংগঠনগুলোতেও ছিল সাদিকের একচ্ছত্র আধিপত্য। মহানগর পূজা উদযাপন এবং হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের নেতৃত্বে বসান নিজের অনুগতদের। হিন্দু কল্যাণ ট্রাস্টের সদস্য সুরঞ্জিত দত্ত লিটু জানান, ২০২১ সালে পূজা উদযাপন পরিষদের নির্বাচন পরিচালনা কমিটি ভানু লাল দেকে সভাপতি এবং বিশ্বজিৎ ঘোষ বিশুকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করেছিল। কিন্তু সাদিক কেন্দ্রীয় নেতাদের ডেকে নিয়ে নিজের অনুগতদের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক করেন। যা বরিশালের ১০৯টি মন্দির কমিটির প্রতিনিধিরা কেউ মেনে নেননি।

সবশেষ সিটি নির্বাচনে মেয়রের মনোনয়ন বঞ্চিত হওয়ার পরে নামেন বরিশাল সদর আসনের সংসদ সদস্যের দলীয় মনোনয়ন পেতে। সেখান থেকেও তাকে দলীয় মনোনয়ন বঞ্চিত করা হলে নামেন স্বতন্ত্র প্রার্থীর দৌড়ে। এ সময় তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠে দাখিল করা মনোনয়নপত্রের সঙ্গে সংযুক্ত হলফনামায় নিজের এবং তার স্ত্রীর আমেরিকায় দ্বৈত নাগরিকত্ব ও সম্পদের ব্যাপারে তথ্য গোপন করার। সেখান থেকে জানা গেছে তার আমেরিকায় রয়েছে বাড়িঘর। তার যুক্তরাষ্ট্রের ভোটার সিরিয়াল নম্বর হলো ভিএসএন : ৪১০৯০৪০০৭। ঠিকানা ৮৯-৬৮, ২১৬ কুইন্স ভিলেজ, নিউইয়র্ক ১১৪২৭, নিউইয়র্ক সিটি।

সাদিকের বিরুদ্ধে বরিশাল ক্লাব দখলের অভিযোগ রয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী ক্লাবের সভাপতি হতে হলে ১০ বছরের সদস্যপদ প্রয়োজন, অথচ মাত্র তিন বছরের সদস্য থাকাকালীনই তিনি ক্লাবের সভাপতি হন। তিনি নিজের দলীয় লোকজনকে সদস্যপদ দিয়ে পুরো ক্লাবকে নিজের নিয়ন্ত্রণে নেন।

সাদিকের বিরুদ্ধে আরো একটি বড় অভিযোগ হলো, তার দ্বৈত নাগরিকত্ব এবং বিদেশে সম্পত্তি গোপন করা। তার মনোনয়নপত্রে যুক্ত আমেরিকার সম্পত্তির তথ্য গোপন করার অভিযোগ উঠেছে। সাদিক এবং তার স্ত্রী উভয়েই আমেরিকার নাগরিক এবং তাদের সেখানে বাড়ি রয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নিউ ইয়র্কের কুইন্স ভিলেজে তার একটি বাড়ি রয়েছে, যার ঠিকানা ৮৯-৬৮, ২১৬ স্ট্রিট, কুইন্স ভিলেজ, নিউ ইয়র্ক সিটি, ১১৪২৭। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে সাদিক আব্দুল্লাহর খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। স্থানীয় বাসিন্দারা মনে করেন, তিনি বরিশাল ছেড়ে পালিয়ে গেছেন।

 

সর্বশেষ  গুরুত্বপূর্ণ  সব  সংবাদ, ছবি ,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও লেখা পেতে আমাদের  ফেসবুক পেইজে  লাইক  দিয়ে  অ্যাকটিভ  থাকুন।  ভিজিট করুন : http://www.etihad.news

* অনলাইন  নিউজ পোর্টাল  ইত্তেহাদ নিউজে  লিখতে  পারেন  আপনিও। লেখার বিষয়  ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন  [email protected] ঠিকানায় ।

সংবাদটি শেয়ার করুন....
ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক :

ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক :

About Author

etihad news is one of the famous Bangla news portals published from Abudhabi-UAE. It has begun with a commitment to fearless, investigative, informative, and independent journalism. This online portal has started to provide real-time news updates with maximum use of Smart Technology.

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *