বরিশাল সমবায় ব্যাংক সরকারের, ভারত বসে আয় করে টুটুল


মামুনুর রশীদ নোমানী,বরিশাল :
বরিশাল সমবায় ব্যাংকের জমি সমবায়ের জেলা ও বিভাগীয় কর্মকর্তাদের সহায়তায় ভারতীয় নাগরিক নিরব হোসেন টুটুল দখলে নিয়ে ভবন নির্মান করে ভাড়া দিয়েছেন নাজেমস বিরিয়ানী নামক একটি প্রতিষ্ঠানের কাছে। জমি সমবায় অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রনাধীন বরিশাল সমবায় ব্যাংকের হলেও ভবনের ভাড়া থেকে বঞ্চিত সরকার। ৩২ শতাংশ জমির আংশিক দখল করে তিন তলা ভবন নির্মান করে নাজেমস বিরিয়ানী নামক রেস্তোঁরার মালিকের কাছে প্রায় অর্ধকোটি টাকা জামানতে মাসিক ৪০ হাজার টাকায় ভাড়া দেয়া হয়েছে। ব্যাংকের পুরাতন ভবনকে নাজেমস প্রতিষ্ঠান রান্নাঘর হিসেবে ব্যবহার করছে।
আরও পড়ুন: সমবায় অধিদপ্তরে অনিয়ম-দুর্নীতি, লুটপাট : ১২ জনে জিম্মি
সমবায় অধিদপ্তরের জেলা ও বিভাগের শীর্ষ কর্তাদের যোগসাজসে দখল হওয়ায় চিঠি আর তদন্তের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে বেদখল হওয়া সমবায় ব্যাংকের জমি ও ভবন উদ্ধারের কাজ। সমবায়ী হোসেন জমাদ্দার নামে এক সমবায়ী লিখিত অভিযোগে জানা গেছে, বরিশাল সমবায়ের বিভাগীয় কর্মকর্তা যুগ্ন নিবন্ধক মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ আল মামুন, উপ-নিবন্ধক মোহাম্মদ মোস্তফা, উপ-নিবন্ধক প্রশাসন মোঃ রবিউল ইসলাম ও জেলা সমবায় কর্মকর্তা, খোর্শেদ আলম, প্রশান্ত কুমার ব্যানার্জী, জেলা অডিটর এস এম মাহফুজ ও উপ-সহকারী নিবন্ধক মোঃ আমিনুল ইসলামের প্রত্যক্ষ সহযোগীতায় বরিশাল সমবায় ব্যাংকের ৩২ কোটি টাকার সম্পত্তি বেদখল হয়েছে।
সমবায় ব্যাংকের একটি মেয়াদ উত্তীর্ন অবৈধ কমিটির সদস্য ভারতীয় নাগরিক নিরব হোসেন টুটুল সমবায় ব্যাংকের পক্ষে সম্পুর্ন অবৈধ ভাবে ফরিদুর রহমান নামের একজনকে অস্থায়ী ভবন ভাড়া চুক্তিপত্রের নামে ৬৮ লাখ ৩০ হাজার ৭১৪ টাকা অগ্রীম নিয়ে মাসিক ৪০ হাজার টাকার বিনিময়ে ভাড়া প্রদান করেন। অবৈধভাবে সৃজিত চুক্তিপত্রে প্রথম পক্ষ হলেন নিরব হোসেন টুটুল ও ২য় পক্ষের হলেন ফরিদুর রহমান। সমবায় বাংকের জমিতে ভবন নির্মান হলেও সমবায় বিনিয়োগ প্রস্তাব ও বাজেট অনুমোদন দেয়নি। ব্যাংকের জমিতে ভবন নির্মানের নেই কোন অনুমতি।
অভিযোগে জানা গেছে, ৯০ লাখ টাকা ঘুষ নিয়ে সমবায় কর্তারা জমিটি বেদখল হওয়াতে সাহায্য করেছেন। ব্যবস্থাপনা কমিটির মেয়াদ ২২ সালের ১৯ মার্চ শেষ হলেও কমিটি গঠনে নির্বাচনের কোন ব্যবস্থা গ্রহন করেনি এবং ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নিয়োগ প্রদান করেনি সমবায় বিভাগ।কারন হিসেবে জানা গেছে সমবায়ের শীর্ষ কর্তারা জড়িত থাকা ও ঘুষ নেয়ার কারনে নিরব থেকেছেন।বরিশাল নগরীর প্রান কেন্দ্রে সমবায় ব্যাংকের জমিতে অবৈধ ভাবে ভবন নির্মান হলেও সমবায়ের শীর্ষ কর্তারা দেখেও না দেখার ভান করেছেন। সুত্র জানায় নাজেম বিরিয়ানীর মালিক ফরিদুর রহমানকে অবৈধ ভাবে নির্মিত ভবনের নির্মান কাজে বাধাঁ না দিয়ে সহযোগীতা করেছেন।
সমবায় ব্যাংকের জমিতে নাজেমস বিরিয়ানী অবৈধ ভাবে স্থাপনা নির্মান করেছে। নির্মান বিষয়ে সাধারন সভার অনুমোদন নেই।নেই সমবায় অধিদপ্তরের কোন অনুমোদন। পত্র পত্রিকায় বরিশাল সমবায়ের ত্রিশ কোটি টাকার সম্পদ বেদখল শিরোনামে সংবাদ প্রকাশিত হলে বরিশাল সমবায়ের জেলা ও বিভাগীয় অফিসের কর্তারা নিজেদের বাচাঁনোর জন্য ভুয়া ও অবৈধ কাগজপত্র সৃষ্টি করে। কমিটিবিহীন ও অনুমতি বিহীন সমবায় ব্যাংকের জায়গা হালালের জন্য চলতি বছরের ১৮ মার্চ একটি ভুয়া চুক্তিপত্র সম্পাদন দেখানো হয়।যার কপি এ প্রতিবেদকের হাতে রয়েছে।
সমবায় ব্যাংক লিঃ এর সম্পত্তির মালিক প্রান্তিক সমবায়ীগন।ব্যাংকটি সচল না থাকার সুবাধে সমবায়ের শীর্ষ কর্তাদের ম্যানেজ করে হাতিয়ে সেয়া হয় ৩২ কোটি টাকার এই সম্পত্তি। সমবায় আইন ও বিধি বিধান না মানার ফলে বেহাত হয়ে যায় সমবায় ব্যাংকের সহায় সম্পদ। কথিত চুক্তিপত্রটি পড়লেই দেখা যায় এটা একটি সৃজিত চুক্তিপত্র যা বাস্তবের সাথে কোন মিল নাই। কমিটির মেয়াদ উত্তীর্ন হয় ২২ সালের ১৯ মার্চ আর চুক্তি হয় ২২ সালের ১৮ মার্চ। মাত্র এক দিন আগে। ২২ সালের ১৮ মার্চ কথিত চুক্তিহলেও শর্তের এক নং দফায় মেয়াদ শুরুর সাল ২৪ সালের ১ এপ্রিল।
সরেজমিনে দেখা গেছে, সমবায় ব্যাংক বরিশাল এর ৩২ শতাংশ জমি রয়েছে। রয়েছে একটি দ্বিতল ভবন।বর্তমানে সমবায় ব্যাংকের জমিতে নুতন একটি তিনতলা ভবন নির্মান হয়েছে। নুতন ভবনটি ৪০ হাজার টাকা মাসিক ভাড়া ও অর্ধ কোটি টাকা এ্যাডভ্যান্স দিয়ে নাজেমস নামে একটি রেস্তোঁরা মালিককে ভাড়া দেয়া হয়েছে।ব্যাংকের পুরানো দ্বিতল ভবনকে বানানো হয়েছে নাজেমসের রান্নার ঘর। সমবায় অধিদপ্তর বরিশাল বিভাগীয় ও জেলা কার্যালয় ও উপজেলা সমবায় বরিশাল অফিস অবগত থাকলেও এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান কোন ব্যবস্থা গ্রহন না করায় প্রশ্ন তুলেছেন সমবায়ীরা।
এ ব্যাপারে সমবায়ী মমতাজ বেগম বলেন, বরিশাল সমবায় ব্যাংকের জমিতে গড়ে ওঠা অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে দায়ীদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার দাবী জানান।সরকারি জমি কিভাবে দিনের বেলায় জাল জালিয়াত কাগজ সৃস্টির মাধ্যমে দখল হয় যা খুবই রহস্যজনক।তিনি সমবায় ব্যাংক পুনরুদ্ধার করে সরকারি ভাবে পরিচালনারও দাবী জানান।
এ ব্যাপারে সমবায়ী আবু সুফিয়ান জানান সমবায় ব্যাংকের জমিতে কিভাবে একটি অবৈধ ভবন নির্মান হয়েছে। যারা এসব প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হোক। তিনি দুদক ও সমবায় মন্ত্রনালয় সহ সংশ্লিষ্টদের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
দখলে সমবায় কর্মকর্তারা জড়িত
বরিশাল সমবায় ব্যাংকের কোন বৈধ কমিটি নেই। ব্যাংকটির জমি ও ভবন দখলে সমবায় অধিদপ্তরের বরিশাল সমবায়ের বিভাগীয় কর্মকর্তা যুগ্ন নিবন্ধক মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ আল মামুন,উপ -নিবন্ধক মোহাম্মদ মোস্তফা,উপ-নিবন্ধক প্রশাসন মোঃ রবিউল ইসলাম ও জেলা সমবায় কর্মকর্তা খোর্শেদ আলম, প্রশান্ত কুমার ব্যানার্জী, জেলা অডিটর এস এম মাহফুজ,উপ-সহকারী নিবন্ধক মোঃ আমিনুল ইসলামের যোগসাজসে এ জমিতে ভবন নির্মান করা হয়।
অভিযোগ অস্বিকার করে জেলা সমবায় অফিসার প্রশান্ত কুমার ব্যানার্জী বলেন,ইতিমধ্য সমবায় ব্যাংক বরিশালের অবস্থা সম্পর্কে বরিশাল সদর উপজেলা সমবায় অফিসার লতিফা আকতার একটি প্রতিবেদন দিয়েছে।প্রতিবেদনটি শীর্ষ কর্মকর্তাদের নিকট পাঠানো হবে। সমবায় জেলা কার্যালয় সুত্র জানিয়েছে, বর্তমানে সমবায় ব্যাংক বরিশালের কোন কমিটি নেই।সমবায় ব্যাংকের জমিতে নতুন ভবন নির্মানে সমবায় অধিদপ্তরের কোন অনুমোদন নেই।
বরিশাল সমবায় ব্যাংক নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করেছে যমুনা টেলিভিশন ও এখন টিভি
এ ছাড়া সমবায় ব্যাংকের জমিতে নতুন ভবনে রেস্তোঁরা ভাড়ার বিষয় সমবায় অধিদপ্তর এর কোন অনুমোদন নেই। এ দিকে বেদখল হওয়া সমবায় ব্যাংক বরিশালের বত্রিশ শতাংশ জমি ও ভবন উদ্ধারে কোন দৃশ্যমান ব্যবস্থা নেয়নি বরিশাল বিভাগীয় ,জেলা ও উপজেলা সমবায় অফিস।
এ ব্যাপারে নাজেমস বিরিয়ানীর মালিক রেজা জানান, কমিটি থেকে আমি মাসিক ভাড়ায় নিয়ে রেষ্টুরেন্ট করেছি। এদিকে বরিশাল সমবায় বিভাগীয় অফিসের যুগ্ন নিবন্ধক মুহাম্মদ আবদুল্লা আল মামুন বলেন, জেলা সমবায় অফিসারকে আহবায়ক করে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির প্রতিবেদন হাতে পেলে পরবর্তী ব্যবস্থা নেয়া হবে।
বরিশালে সমবায় ব্যাংক লিমিটেডের জমি ও ভবন অবৈধভাবে দখল করে ইতোমধ্যে জমিতে স্থায়ী ভবন নির্মাণ করে চলছে ব্যবসা-বাণিজ্য। পুরো বিষয়টি অনিয়মের মাধ্যমে হয়েছে বলে দাবি উপজেলা সমবায় কর্মকর্তার। তদন্ত শেষে অনিয়মের প্রমাণ মিলেছে বলে জানান সমবায় কর্মকর্তারা। দেশের মানুষের আর্থিক অবস্থা উন্নতির লক্ষ্যে গড়ে উঠেছিল সমবায় ব্যবস্থা। আর এর কার্যক্রম টেকসই ও মজবুত করতে প্রতিষ্ঠা করা হয় সমবায় ব্যাংক। দারিদ্র বিমোচন, উৎপাদনমুখী ব্যবস্থা গড়ে তোলা এবং উদ্যোক্তা তৈরিতে এই ব্যাংক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতো। এখান থেকেই একসময় ঋণ নিয়ে চালাতো নানা কার্যক্রম।
বরিশালে ১৯১৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় সমবায় ব্যাংক। এই ব্যাংকটির নিজস্ব জমির পরিমাণ প্রায় ৩৬ শতাংশ। প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্যদের কেউ এখন বেঁচে নেই। ২০০১ সাল থেকে সমবায় ব্যাংকের ঋণ দেয়াও বন্ধ। নেই কোনো কার্যক্রম। এতবড় একটি প্রতিষ্ঠানে হিসাবরক্ষক পদে একজন কর্মী ছাড়া আর কেউ নেই। অরক্ষিত এ সম্পদে অনেকেরই লোলুপদৃষ্টি। ব্যাংকের জমি ও ভবন দখলে নেয়ার জন্য নানাভাবে চেষ্টা করা হচ্ছে। সমবায় ব্যাংকের হিসাবরক্ষক দেলোয়ার হোসেন বাবুল বলেন, ‘খুব বিপদের মধ্যে আছি। বিভিন্নভাবে আমাকে হেনস্তা করছে। তারা বলছে এইসব অবৈধ সম্পত্তি।’
নগরীর গুরুত্বপূর্ণ এলাকা বগুড়া রোডে সমবায় ব্যাংকটির অবস্থান। এখানে ১১১ বছরের পুরাতন একটি দ্বিতল ভবন রয়েছে। কিন্তু এই সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণে নেই কোন কমিটি ও যোগ্য কর্মকর্তা। এই সুযোগে ইতোমধ্যে ব্যাংকের জমিতে স্থায়ী ভবন নির্মাণ করে ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনা করছে একটি পক্ষ। সবকিছু অনিয়মে করা হয়েছে বলে দাবি উপজেলা সমবায় কর্মকর্তার।
বরিশাল সদরের উপজেলা সমবায় কর্মকর্তা লতিফা আক্তার বলেন, ‘সমবায় ব্যাংকের জমিতে যে ভবন করা হয়েছে তা সঠিক নিয়মে করা হয়নি। সব কিছুই অত্র কার্যালয়ের অগোচরে করা হয়েছে। একসময়ের কর্মমুখর ব্যাংকটির ভবনের ভেতরে রয়েছে বিভিন্ন আসবাবপত্র। অযত্ন অবহেলা হলেও সমবায়ীদের বিভিন্ন তথ্য এখনো সেখানে সংরক্ষিত। এই ব্যাংকের জমিতে ভবন নির্মাণ হয়নি নিয়ম মেনে। বর্তমানে ভবনটি ভাড়া নিয়ে ব্যবসা করছে নাজেমস বিরিয়ানী নামক একটি রেস্তোঁরা। ২০২৪ সালের এপ্রিল থেকে পরবর্তী ৫ বছর চুক্তির মেয়াদ। ৩ হাজার ৩ বর্গফুটের ভাড়া ধরা হয়েছে মাত্র ৪০ হাজার টাকা। এছাড়া প্রায় সমান আরেকটি একতলা ভবনের ভাড়া ধরা হয়েছে মাত্র ১২ হাজার টাকা। ভাড়া নির্ধারণে বাজার দর না মানার অভিযোগ উঠেছে। এ ব্যাপারে সমবায়ীদের পক্ষ থেকে সমবায় মন্ত্রণালয়ে উপদেষ্টা বরাবরে অভিযোগ করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, ভারতীয় নাগরিক নিরব হোসেন টুুটুল যশোর কারাগার থেকে জামিনে মুক্তি পেয়ে ভারতে পালিয়ে গেছেন। ফলে তার কোন বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।
সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ সব সংবাদ, ছবি ,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন। ভিজিট করুন : http://www.etihad.news
* অনলাইন নিউজ পোর্টাল ইত্তেহাদ নিউজে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায় ।