দেশে মব ভায়োলেন্স চলছে : থামানোর কোনো উদ্যোগ নেই


ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক : দেশে ছিনতাই, খুন, ডাকাতি ও রাহাজানি বেড়েই চলেছে। মব ভায়োলেন্স (সংঘবদ্ধ অপরাধ) চলছে। সরকারের দিক থেকে এসব কর্মকাণ্ড থামানোর কোনো উদ্যোগ নেই।
বৃহস্পতিবার (৬ মার্চ) বাম গণতান্ত্রিক জোটের কেন্দ্রীয় পরিচালনা পরিষদের সভায় উপস্থিত নেতারা এ কথা বলেন। রাজধানীর তোপখানা রোডের মুক্তি ভবনে বাম জোটের অস্থায়ী কার্যালয়ে এ সভা অনুষ্ঠিত হয়। গণমাধ্যমে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, দ্রব্যমূল্যের ক্রমবর্ধমান ঊর্ধ্বগতির কারণে জনজীবনের দুর্ভোগ চরমে পৌঁছেছে। সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য বন্ধ করা যায়নি। বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে সরকার ব্যর্থ। এসব বিষয়ে সরকার তার দায় অস্বীকার করতে পারে না। কিন্তু প্রধান উপদেষ্টা ও স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার মুখে আমরা শুনছি যে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নাকি স্বাভাবিক আছে।
বাম জোটের নেতারা আরও বলেন, আমরা মনে করি, সরকারের এসব বিষয়ে স্পষ্ট দায় স্বীকার ও কার্যকর ভূমিকা রাখা উচিত। একই সঙ্গে সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার করে দ্রুত নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট তারিখ ঘোষণা করা উচিত।
সভা থেকে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি ও প্রয়োজনীয় সংস্কার করে দ্রুত নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার দাবিতে আগামী বুধবার সারা দেশে সমাবেশ ও বিক্ষোভ মিছিলের ঘোষণা দেওয়া হয়।
বাম জোটের সমন্বয়ক ও বাংলাদেশের বিপ্লবী কমিউনিস্ট লীগের সাধারণ সম্পাদক ইকবাল কবিরের সভাপতিত্বে সভায় অন্যদের মধ্যে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন (প্রিন্স), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশিদ, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (মার্ক্সবাদী) সমন্বয়ক মাসুদ রানা, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টির সাধারণ সম্পাদক মোশরেফা মিশু, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক পার্টির নির্বাহী সভাপতি আবদুল আলী প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
গত ২৮ ফেব্রুয়ারি রাতে চট্টগ্রামের পতেঙ্গা থানা এলাকার আউটার রিং রোডে এ হামলার ঘটনা ঘটে। এ ঘটনার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। সেখানে দেখা যায়, হামলা করে এসআই ইউসুফ আলীর পোশাক ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে। অসহায় অবস্থায় অঝোরে কাঁদছেন তিনি। গত সোমবার তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘যখন পুলিশের পোশাক ছিঁড়ে ফেলে, তখন আর আবেগ ধরে রাখতে পারিনি, কেঁদে ফেলেছি।’
শুধু পতেঙ্গার ঘটনাই নয়, গত ছয় মাসে পুলিশের ওপর এ ধরনের ২২৫টি হামলার ঘটনা ঘটেছে। কোথাও কোথাও হামলা করে আসামি ছিনতাইয়ের ঘটনাও ঘটেছে। বেশির ভাগ ঘটনা ঘটানো হয়েছে উচ্ছৃঙ্খল জনতার সংঘবদ্ধ আক্রমণে বা ‘মব’ তৈরি করে।
পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত ছয় মাসে দায়িত্ব পালনকালে পুলিশ সদস্যের ওপর হামলার ২২৫টি ঘটনার মধ্যে ৭০টি বড় ধরনের আলোচনা তৈরি করে। গত বছরের সেপ্টেম্বরে ২৪টি, অক্টোবরে ৩৪, নভেম্বরে ৪৯, ডিসেম্বরে ৪৩, জানুয়ারিতে ৩৮ এবং ফেব্রুয়ারিতে ৩৭টি হামলার ঘটনা ঘটে। পুলিশের এই পরিসংখ্যানের বাইরেও সড়কে পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে বিরূপ আচরণের বিভিন্ন ঘটনা ঘটেছে।
ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মব তৈরি করে হামলাগুলো করছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পেশাদার অপরাধী ও রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরাও মব তৈরিতে ভূমিকা রাখছেন। এই মব তৈরি করে শুধু পুলিশের ওপরেই হামলা হচ্ছে তা নয়, বরং কোথাও কোথাও সাধারণ মানুষের ওপরও হামলা বা গণপিটুনির ঘটনা ঘটছে। অন্তর্বর্তী সরকারের সাত মাসে দেশে গণপিটুনির অন্তত ১১৪টি ঘটনায় ১১৯ জন নিহত ও ৭৪ জন আহত হয়েছেন। এ তথ্য মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির।
সর্বশেষ ৩ মার্চ চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার ছনখোলা এলাকায় মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে ডাকাত সন্দেহে গণপিটুনিতে দুজনকে হত্যা করা হয়। পরদিন ৪ মার্চ মধ্যরাতে মব তৈরি করে রাজধানীর গুলশানে একটি বাসায় তল্লাশির নামে মালামাল তছনছ, ভাঙচুর ও লুটপাট করে একদল লোক।
বিভিন্ন স্থানে এ ধরনের মব তৈরি এবং হামলার ঘটনায় পুলিশের সদস্যদের মধ্যেও বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। সরকারের বিভিন্ন পর্যায়েও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সর্বশেষ গত সোমবার পুলিশের ক্যাডার কর্মকর্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকেও এসব ঘটনায় নিন্দা ও প্রতিবাদ জানানো হয়েছে।
পুলিশ সদস্যরা বলছেন, ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পুলিশে ভঙ্গুর অবস্থা তৈরি হয়। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে একশ্রেণির পুলিশ কর্মকর্তার রাজনৈতিক নেতাদের মতো ভূমিকা এবং গুলি ও অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের কারণে বিক্ষুব্ধ মানুষের হামলার লক্ষ্যবস্তু হয় পুলিশ। এরপর যখন নতুন কর্মকর্তাদের নেতৃত্বে পুলিশ ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে, তখন এ ধরনের হামলার ঘটনাকে বাহিনীর মনোবলের ওপর বড় ধরনের আঘাত হিসেবে দেখছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
গতকাল বৃহস্পতিবার রংপুরে এক অনুষ্ঠানে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম বলেন, ‘ক্ষমতাচ্যুত স্বৈরাচারী ফ্যাসিস্ট সরকারের কারণে পুলিশ আইন প্রয়োগ করতে গিয়ে মানুষের আক্রমণের শিকার হচ্ছে। নাগরিক সমাজের প্রতি আমার অনুরোধ, পুলিশকে আপনারা আবার কাছে টেনে নিন। পুলিশকে কাজ করতে সহায়তা করেন।
হামলা-হুমকি কেন, কারা করছে
বিভিন্ন এলাকায় পুলিশের ওপর হামলা ও আসামি ছিনতাইয়ের ২০টি ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এসব ঘটনার পাঁচটিতে বিএনপির নেতা-কর্মী, দুটিতে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী, দুটিতে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারী পরিচয় দেওয়া ব্যক্তি, ছয়টিতে মাদক কারবারি, দুটিতে চাঁদাবাজিতে জড়িত ব্যক্তি, একটিতে শীর্ষ সন্ত্রাসীর অনুসারীরা, একটিতে অটোরিকশাচালক এবং একটিতে সিএনজিচালিত অটোরিকশার চালকেরা জড়িত ছিলেন। বিএনপি নেতা পরিচয়ে এক আসামিকে (ছাত্রলীগ নেতা) ছিনতাইয়ের ঘটনাও ঘটেছে।
পুলিশের মাঠপর্যায়ের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আগামী জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে বিএনপি ক্ষমতায় আসছে, এমন ধারণা তৈরি হয়েছে। এ কারণে মাঠপর্যায়ের পুলিশ সদস্যরাও বিএনপি নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলেছেন। এই সুযোগে একশ্রেণির বিএনপির নেতা-কর্মী মামলা ও গ্রেপ্তারসহ থানার কার্যক্রমে হস্তক্ষেপ করছেন। আসামি ছিনিয়ে নেওয়ার অধিকাংশ ঘটনায় পুলিশ নীরব থাকছে। এ ক্ষেত্রে পুলিশ সদস্যদের আশঙ্কা, তাঁরা সক্রিয় হলে নতুন করে হয়রানির মুখোমুখি হতে পারেন।
এ বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, কেন্দ্রীয় নির্দেশনা বাস্তবায়নের সবচেয়ে বড় অন্তরায় হলো মাঠপর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তাদের রাজনৈতিক সখ্য। যার প্রভাব পড়ছে সামগ্রিক আইনশৃঙ্খলায়। রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে এই সখ্যের কারণে অনেক সময় প্রকৃত অপরাধীরাও পার পেয়ে যায়।
অপরাধবিশেষজ্ঞরা বলছেন, অপরাধীরা পুলিশকে ভয় না পেলে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ অসম্ভব হয়ে উঠবে। রাজনৈতিক নেতা-কর্মী থেকে শুরু করে ছিনতাইকারী, মাদক কারবারিরাও যখন মব তৈরি করে পুলিশের ওপর হামলা করে, তখন এটি উদ্বেগের বিষয়। রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ থেকে শুরু করে সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে আইন প্রয়োগে পুলিশকে সহযোগিতা করতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক তৌহিদুল হক বলেন, পুলিশ যখন ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে, তখন তাঁদের ওপর হামলা, হুমকি ও আসামি ছিনতাই বাহিনীটিকে নতুন সংকটে ফেলছে। অনেক ঘটনার নেপথ্যে রাজনৈতিক আশীর্বাদ রয়েছে। রাজনৈতিক নেতারা অপরাধীদের রক্ষা করতে পারেন এমন ধারণা কোনোভাবেই গড়ে উঠতে দেওয়া যাবে না। তিনি মনে করেন, এ ধরনের ঘটনায় নতি স্বীকার না করে জড়িতদের আইনের আওতায় আনতে পুলিশকে আরও কঠোর হতে হবে ।
সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ সব সংবাদ, ছবি ,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন। ভিজিট করুন : http://www.etihad.news
* অনলাইন নিউজ পোর্টাল ইত্তেহাদ নিউজে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায় ।