বাংলাদেশ ঢাকা

গুলি করে পাখির মতো মানুষ খুন মানতে পারেননি শহিদ নাসির

image 190289 1744342959
print news

অনলাইন ডেস্ক : বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন যখন সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে রূপ নেয়, তখন রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর রায়েরবাগ এলাকায় আন্দোলনে যোগ দেন মো. নাসির হোসেন (৩৯)। ২০ জুলাই ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হওয়ার পর ২৩ জুলাই তিনি শাহাদত বরণ করেন।

নাসিরের ছোট ভাই পিকআপ ভ্যানচালক মো. জিলানী ইসলাম  বলেন, ‘আমার ভাই একজন সাধারণ মানুষ ছিল। দর্জি কাজ করত। রাজনীতিতে তার কোনো আগ্রহী ছিল না। কিন্তু মানুষকে পাখির মতো গুলি করে মারা সে মানতে পারেনি। এমনকি আমিও অল্পের জন্য গুলির হাত থেকে বেঁচে গেছি।’

তিনি আরও বলেন, ‘পরিহাসের বিষয় হচ্ছে, গুলিবিদ্ধ হওয়ার পরদিনই পুলিশ আমার ভাইয়ের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা করে। পুলিশের কাছে আমার ভাই সন্ত্রাসী!’

জিলানী জানান, তবে ৫ আগস্ট আওয়ামী সরকারের পতনের পর মামলাটি প্রত্যাহার করা হয়। তিনি বলেন, ২০ জুলাই সকাল ১১টা ৪৫ মিনিটে নাসির বাসা থেকে বের হয়ে রায়েরবাগ মূল রাস্তায় আন্দোলনে যোগ দেন। দুপুর ১২টা ১৫ মিনিটে মাথায় তিনটি গুলিবিদ্ধ অবস্থায় নাসির নিজেই হেঁটে বাসায় ফিরে আসেন।

জিলানী বলেন, ‘নিচতলায় চিৎকার শুনে দৌড়ে গিয়ে দেখি ভাই একটি পিলারের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, মাথায় নিজের জামা প্যাঁচানো। আমি জিজ্ঞেস করতেই বলল, গুলি খেয়েছে।’

এক মুহূর্ত দেরি না করে জিলানী ভাইকে কাঁধে তুলে আবাসিক এলাকার গলিপথ ধরে মাতুয়াইল মেডিকেলের দিকে দৌড়াতে থাকেন। কারণ রাস্তায় কোনো যান চলাচল ছিল না। মাঝপথে একটি রিকশা পেয়ে তারা মাতুয়াইল মেডিকেলের বিপরীত পাশে একটি বেসরকারি হাসপাতালে যান।সেখান থেকে তাকে মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়।

চোখের সামনে ঘটে যাওয়া ঘটনার কথা উল্লেখ করে জিলানী বলেন, ১৬ জুলাইয়ের পর থেকে যাাত্রাবাড়ী ও আশেপাশের এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। ১৯ জুলাই রাতে রায়েরবাগে দুই পুলিশ সদস্য নিহত হওয়ার পর পুলিশ বেপরোয়া হয়ে ওঠে। ২০ জুলাই নির্বিচারে গুলি চালানো হয়, এমনকি গলিতেও ঢুকে পড়ে তারা।

হাসপাতালে হয়রানির বর্ণনা দিয়ে জিলানী বলেন, ‘মুগদা মেডিকেলে আমার ভাই ছিলেন প্রথম গুলিবিদ্ধ রোগী। কিন্তু স্থানীয় এক আওয়ামী লীগ কর্মী রেজা কিবরিয়া তার ভর্তি হওয়ায় বাধা দেয়।’

অবশেষে ৪,০০০ টাকা দিয়ে হাসপাতালের পেছনের গেট দিয়ে তাকে ভর্তি করানো হয় এবং সঙ্গে সঙ্গে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়। তিনি অভিযোগ করেন, হাসপাতালে ঠিকভাবে চিকিৎসা দেওয়া হয়নি। সেদিন রাত ৯টার দিকে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের দুটি দল ও মুগদা থানার ওসি হাসপাতালে এসে ঘিরে ফেলে।

‘ওদের দেখে আমরা ভয় পেয়ে যাই। তারা আহতদের খোঁজ নিয়ে হাসপাতালের রেজিস্ট্রেশন বই নিয়ে যায়। এরপর থেকেই ডাক্তাররা আর চিকিৎসা দেয়নি।’ জিলানী বলেন, ‘আমরা প্রতিদিন ১২ থেকে ১৪ হাজার টাকার ওষুধ কিনেছি, অথচ রোগীর অবস্থার কিছুই জানানো হয়নি।’ প্রতিদিন ১০টি ডায়াপার ও এক বোতল এয়ার ফ্রেশনার কিনতে বাধ্য করা হয়, যদিও নাসির কিছুই খাচ্ছিল না, শুধু স্যালাইন চলছিল।

২৩ জুলাই সকাল ৭টা ৩০ মিনিটে ডাক্তাররা নাসিরকে মৃত ঘোষণা করেন। তারপর শুরু হয় নতুন ভোগান্তি। লাশ নিতে গেলে হাসপাতাল হয়রানি করে, পুলিশ সহায়তা করে না। একপর্যায়ে মুগদা মেডিকেল থেকে সকাল ১০টায় লাশ পাঠানো হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজে (ঢামেক)।

ঢামেকে গিয়ে দেখা যায় লাশ লুকিয়ে ফেলার চেষ্টা চলছে। অবশেষে বিকালে ময়নাতদন্তের পর ৮,০০০ টাকার বিনিময়ে তারা লাশ বুঝে পান। জিলানী বলেন, তাদের গ্রামে, লক্ষ্মীপুরের রায়পুরে লাশ নেওয়ার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু সরকার-সমর্থকদের হয়রানির কারণে সেটা সম্ভব হয়নি। তিনি বলেন, স্থানীয় আওয়ামী কর্মীরা তাদের ওপর নজরদারি ও নানা হয়রানি করতে থাকে।

আসর নামাজের পর প্রথম জানাজা শেষে তারা মাতুয়াইল কবরস্থানে লাশ দাফন করতে গেলে কবরস্থান কর্তৃপক্ষ জানায়, যত্রিাবাড়ী থানা ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা শান্তনু খান শান্তর অনুমতি লাগবে।

শান্ত তখন ফোন ধরছিলেন না। ঈশার সময় ফোন ধরলেও ৮,০০০ টাকা দিয়ে দাফন করতে হয়। মাগরিবের পর আরেকটি জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। ক্ষোভ প্রকাশ করে জিলানী বলেন, ‘ভাইকে হত্যা করলেন, চিকিৎসা করতে দিলেন না, মরার পরও দাফনে বাধা দিলেন! এটা কেমন অমানবিকতা?’ তিনি জানান, জানাজায় এক সহকর্মী অংশ নেওয়ায় তাকে হুমকি দেওয়া হয়।

চতুর্থ দিনে কোরআনখানির আয়োজন করলে কোনো ইমাম বা হুজুর আসতে দেয়া হয়নি। বাধ্য হয়ে খাবার পাঠিয়ে বিভিন্ন মাদরাসায় দোয়া করানো হয়।

৫ আগস্ট ফ্যাসিবাদী শাসক শেখ হাসিনার প্রায় ১৬ বছরের শাসন পতনের পর মুক্ত বাতাসে নিশ্বাস নেন জিলানী। বলেন, ‘আওয়ামী লীগ না গেলে কি আমরা এখন কথা বলতে পারতাম? হয়তো আমাদের সবাইকেই মেরে ফেলত।’ তিনি বলেন, ‘আমরা ছিলাম গৃহবন্দি। আমি কাজে পর্যন্ত যেতে পারিনি।’

তিনি বলেন, ‘সরকারের দায়িত্ব শহিদ পরিবারের খোঁজ নেওয়া। সরকার যদি শহিদদের সম্মান না দেয়, তাহলে ভবিষ্যতে কেউ দেশের জন্য প্রাণ দেবে না।’

নাসির ছিলেন ৯ ভাইবোনের মধ্যে সবার বড়। তার বাবা রফিকুল ইসলাম (৭১) একজন দিনমজুর। দ্বিতীয় ভাই আল-আমিন প্রাইভেট কার চালক, তৃতীয় ভাই রাব্বী বেকার এবং চতুর্থ ভাই জিলানী পিকআপ ভ্যান চালক। দুই ছোট বোন—রাত্রি আকতার বেগম বদরুন্নেসা কলেজে একাদশ শ্রেণিতে পড়েন এবং রিয়া আকতার মাতুয়াইল হাইস্কুল থেকে এসএসসি পরীক্ষার্থী। নাসিরের মৃত্যুতে পরিবার অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছে। তিনি ছিলেন পরিবারের ভরসা।

জিলানী বলেন, ‘ও ভাই আমার সঙ্গে পিকআপে বাইরে যেত। এখনও মনে হয়, সে পাশে আছে।’রায়েরবাগে তাদের বাসায় গিয়ে দেখা যায়, নাসিরের মা নাজমা বেগম ট্রমায় আচ্ছন্ন। ছেলের রক্তমাখা জামা দেখিয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘ছেলে ১১টা ৩০ মিনিটে ঘুম থেকে উঠে ভাত চাইছিল। কিন্তু সেদিন সকালে ভাত রান্না হয়নি। আমি পরোটা খেতে দিই। খেয়ে ১১টা ৪৫-এ বের হয়ে যায়।’

তিনি বলেন, বাড়ির নিচে দাঁড়িয়ে ছিল নাসির। নাতি ডাকছিল ঘরে আসার জন্য। ‘আমি নিজেও বলেছিলাম, রাস্তায় যাস না, ঝামেলা হচ্ছে। কিন্তু সে আমার কথাশোনেনি।’নাজমা বেগম খুনিদের ফাঁসি দাবি করেন।

 

সর্বশেষ  গুরুত্বপূর্ণ  সব  সংবাদ, ছবি ,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও লেখা পেতে আমাদের  ফেসবুক পেইজে  লাইক  দিয়ে  অ্যাকটিভ  থাকুন।  ভিজিট করুন : http://www.etihad.news

* অনলাইন  নিউজ পোর্টাল  ইত্তেহাদ নিউজে  লিখতে  পারেন  আপনিও। লেখার বিষয়  ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন  [email protected] ঠিকানায় ।

সংবাদটি শেয়ার করুন....
ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক :

ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক :

About Author

etihad news is one of the famous Bangla news portals published from Abudhabi-UAE. It has begun with a commitment to fearless, investigative, informative, and independent journalism. This online portal has started to provide real-time news updates with maximum use of Smart Technology.