মতামত

সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে পড়েছে শ্রমজীবী মানুষ

মানুষ
print news

ইত্তেহাদ নিউজ আজ মহান মে দিবস। ১৮৮৬ সালের মে মাসের প্রথম সপ্তাহে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের হে মার্কেটে শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি-দাওয়া নিয়ে আন্দোলনকারীদের উপর পুলিশের গুলিবর্ষণ ও রক্তাক্ত ঘটনার স্মৃতিবিজড়িত মে দিবসের ডাক এখনো সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। প্রায় দেড়শ’ বছর ধরে বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষ তাদের ন্যায্য অধিকার ও জীবনমানের উন্নয়ন ও নিরাপত্তার দাবিতে আন্দোলন করে এলেও তাদের অবস্থার তেমন পরিবর্তন ঘটেনি। প্রতিবছর বিশ্বে ঘটা করে মে দিবস পালিত হলেও করোনা পরবর্তী ইউক্রেন যুদ্ধ ও বৈশ্বিক মন্দার কারণে একটা নতুন প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে। বিশ্বের সব মানুষ নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক ঝুঁকিতে থাকলেও সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে পড়েছে শ্রমজীবী মানুষ। আমাদের দেশে একদিকে নানা কারণে বহু মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছে, অন্যদিকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধিতে তারা দিশেহারা। দু’বেলা দু’মুঠো খাওয়াই এখন তাদের জন্য মুশকিল হয়ে পড়েছে। বেকারত্ব ও দারিদ্র্যের কষাঘাতে তাদের এখন ত্রাহি অবস্থা। হু হু করে বাড়ছে দারিদ্র্যের হার। বিভিন্ন পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ইতোমধ্যে নতুনভাবে দুই কোটিরও বেশি মানুষ দরিদ্র হয়ে গেছে। হতদরিদ্রের সংখ্যাও সমানুপাতে বাড়ছে। সানেম এক জরিপ রিপোর্টে জানিয়েছে, মূল্যস্ফীতির চাপে দেশের ৭৪ শতাংশ নি¤œ আয়ের পরিবার ধার করে চলছে, যাদের অধিকাংশই শ্রমিক। অর্ধাহারে-অনাহারে তাদের দিন কাটছে।গতকাল দৈনিক ইনকিলাবে সিলেটের পাথর কোয়ারিতে বল্গাহীন অনিয়ম, লুটপাটে বারকি শ্রমিকদের কৃতদাসের মত ব্যবহারের চিত্র বেরিয়ে এসেছে। শিপইয়ার্ড ও সমুদ্রগামী মাছধরা ট্রলাগুলোতেও জেলেদের ক্রীতদাসের মত ব্যবহার করা হচ্ছে। সব পাথর কোয়ারিসহ সব সেক্টরে লুটপাট ও চোরাচালানের মূল হোতারা ধরা ছোঁয়ার বাইরে থাকলেও চোরাই মালামাল বহনকারী শ্রমিকরা ন্যুনতম আর্থিক সুবিধা ও নিরাপত্তা ছাড়াই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে। কৃষক-শ্রমিকের ন্যুনতম আর্থিক নিরাপত্তা ও মানবাধিকারের গ্যারান্টি ছাড়া দেশের সামাজিক-অর্থনৈতিক অগ্রগতির লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব নয়।

বাংলাদেশের কর্মসংস্থান খাতে দেশের মোট শ্রমিকের ৮৫ শতাংশই অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের। তাদের কর্ম অস্থায়ী, বেতন অল্প। তারা অসংগঠিতও। তাদের অবস্থা দুর্বিষহ বললেও কম বলা হয়। প্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের অবস্থা তাদের তুলনায় কিছুটা ভালো। তবে প্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকরা যে বেতন পায় তা তাদের প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট নয়। সরকারি চাকরি, গার্মেন্ট শিল্প, চা বাগান ও কারখানা প্রভৃতি খাতের বেতন-মজুরি ভিন্ন ভিন্ন। জাতীয় নি¤œতম মজুরি না থাকায় ব্যাপক বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে। বিশ্ব ব্যাংকের মতে, বিশ্বে অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রম বাজরে শীর্ষে আছে বাংলাদেশ। এ ছাড়া স্বাস্থ্যকর জীবন যাপনের ক্ষেত্রে তার অবস্থান চতুর্থ, পেনশনে ষষ্ঠ এবং বেতন কাঠামোতে নবম। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মের অভাব, বেতন-মজুরির অনিশ্চয়তা স্বাভাবিক। তাদের অধিকার ও সুবিধা দেখার কেউ নেই। প্রাতিষ্ঠানিক খাতেও অনেক দিন হলো নতুন বেতনকাঠামো হয়নি। দাবি উঠেছে, কিন্তু সরকার ও মালিকদের দিক থেকে তেমন সাড়া নেই। গার্মেন্ট শ্রমিকরা সংখ্যায় বেশি এবং কিছুটা সংগঠিত হওয়ায় তাদের জন্য অবশ্য নতুন মজুরি বোর্ড হয়েছে। কবে নাগাদ এ বোর্ড নতুন বেতন কাঠামো দিতে পারবে, তা বলা মুশকিল। দেশের অর্থনীতি ও রেমিটেন্স প্রবাহের অন্যতম বুনিয়াদ বৈদেশিক কর্মসংস্থানেও আমাদের প্রবাসি শ্রমিকদের একটা বড় অংশ শুধু ন্যায্য অধিকার থেকেই নয়, ন্যুনতম নিরাপত্তা ও মানবাধিকার থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্য ও মালয়েশিয়ার মত বড় শ্রমবাজারে প্রবাসি শ্রমিকরা অবৈধ শ্রমিক হিসেবে এবং জেলখানায় মানবেতর জীবনে বাধ্য হচ্ছে। প্রতিবেশি দেশগুলোর চেয়েও আমাদের কর্মীরা অনেক কম মজুরিতে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে। এসব নিয়ে সংশ্লিষ্ট দেশের মিশন এবং পররাষ্ট্রও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উল্লেখযোগ্য কোনো ভ’মিকা দেখা যায়নি।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে স্বৈরাচারি হাসিনা সরকারের পতনের পর অর্ন্তবর্তী সরকারের কাছে মানুষের প্রত্যাশা অনেক। বিশেষত অর্থনীতি ও আর্থিক খাতের পুনর্গঠনসহ নতুন বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে নতুন গতি সঞ্চার করা এই সরকারের অন্যতম প্রতিশ্রুতি বলে বিবেচিত হয়েছিল। বিগত ৯ মাসে দেশ থেকে অর্থপাচার ও লুটপাট বন্ধ হলেও বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে তেমন কোনো সুফল দেখা যায়নি। প্রাতিষ্ঠানিক ও নীতিগত সংস্কার চলছে। গ্রামীন ব্যাংক, গ্রামীন টেলিকম কোম্পানিসহ প্রধান উপদেষ্টার সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিদ্যমান আইনগত জটিলতা প্রতিবন্ধকতা দূর করে কর রেয়াতের বাড়তি সুবিধা পেলেও সাবেক অলিগার্কদের মালিকানাধীন বেশকিছু কর্পোরেট কোম্পানির উৎপাদন, বিনিয়োগ ঝুঁািকর মুখে ঠেলে দিয়ে হাজার শ্রমিকের কর্মসংস্থানের পথ সঙ্কুচিত করে ফেলা হচ্ছে। কলকারখানা বন্ধ হয়ে মানুষ চাকরি হারাচ্ছে। বেক্সিমকো ও এস আলমের মত বড় কর্পোরেট কোম্পানির উৎপাদন ও কর্মসংস্থান বাঁচিয়ে রাখতে কার্যকর উদ্যোগ সরকারকেই নিতে হবে। বৈদেশিক কর্মসংস্থান হারিয়ে শ্রমিকরা শুন্য হাতে দেশে ফিরছে। আমাদের শ্রমিকদের যা আয়-রোজগার, তার বেশির ভাগই ব্যয় হয় খাদ্য কেনা ও বাসা ভাড়ায়। কৃষি খাতে বাম্পার ফলনের মধ্য দিয়ে খাদ্যশস্যের উৎপাদন যদি বেশি হয়, দাম যদি কমে তবে শ্রমিকসহ সকলের জন্য সেটা স্বস্তির। দেশ খাদ্য সয়ম্ভরতা অর্জন করেছে। এটা একটা বড় অর্জন। কিন্তু খাদ্য থাকলেই হবে না, মানুষের ক্রয়ক্ষমতাও থাকতে হবে। আমাদের শ্রমজীবীদের বড় সমস্যা, তাদের ক্রয়ক্ষমতার অভাব। তাদের ক্রয়ক্ষমতার বাড়াতে হলে বেতন-ভাতা বা মজুরি বাড়ানোর বিকল্প নেই। আবার বেতন-মজুরিও এমনভাবে বাড়ানো সম্ভব নয়, যাতে শ্রমক্ষেত্রের অস্তিত্ব সংকটে পতিত হয়। এমতাবস্থায়, এমন একটা পন্থা অবলম্বন করতে হবে, যাতে শ্রমিকদের জীবন-যাপন যতটা সম্ভব সহজ হয় এবং শ্রমক্ষেত্রও অচল হয়ে না পড়ে। শ্রমিক ও শ্রমক্ষেত্র দুই-ই যাতে চলতে পারে তার ব্যবস্থা করতে হবে। শ্রমিক, মালিক ও সরকার এক সঙ্গে বসে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। গার্মেন্টের বেতন-ভাতা বাড়ানো দরকার বটে, অন্যান্য খাতেও তো দরকার; সেটাও দেখতে হবে। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের বেঁচেবর্তে থাকার জন্য সরকারের সহযোগিতা আবশ্যক। তাদের বিনামূল্যে বা স্বল্পমূল্যে খাদ্য ও নিত্য প্রয়োজনীয় কিছু পণ্য দেয়া যেতে পারে। তার চেয়েও বড় বিষয় হচ্ছে মানুষ হিসেবে শ্রমিকদের ন্যুনতম নিরাপত্তা ও অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। কোনো ক্ষেত্রে আমাদের শ্রমিকদের অবস্থা সেই ঊনবিংশ শতকের শ্রমদাসদের মত। বিশ্বজুড়েই অটোমেশন ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি মানুষের স্থান দখল করে নিচ্ছে। প্রযুক্তি যেভাবে এগুচ্ছে তাতে আগামীতে বিশ্বে কোটি কোটি শ্রমিক কর্ম হারাবে। বাংলাদেশেও তার ব্যতিক্রম হবে না। সে কথা মাথায় রেখে মানুষের বিকল্প কর্মসংস্থান ও উপযুক্ত পারিশ্রমিক দেয়ার কথা ভাবতে হবে। এই মে দিবসে দেশের সব শ্রমজীবী মানুষের প্রতি শুভ কামনা রইল।

 

সর্বশেষ  গুরুত্বপূর্ণ  সব  সংবাদ, ছবি ,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও লেখা পেতে আমাদের  ফেসবুক পেইজে  লাইক  দিয়ে  অ্যাকটিভ  থাকুন।  ভিজিট করুন : http://www.etihad.news

* অনলাইন  নিউজ পোর্টাল  ইত্তেহাদ নিউজে  লিখতে  পারেন  আপনিও। লেখার বিষয়  ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন  [email protected] ঠিকানায় ।

সংবাদটি শেয়ার করুন....
ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক :

ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক :

About Author

etihad news is one of the famous Bangla news portals published from Abudhabi-UAE. It has begun with a commitment to fearless, investigative, informative, and independent journalism. This online portal has started to provide real-time news updates with maximum use of Smart Technology.