বরিশাল নগরিতে শয়তানের নিঃশ্বাস চক্রের ‘অপারেশন কেন্দ্র’ হোটেল মুন


বরিশাল অফিস : বরিশাল নগরিতে ‘শয়তানের নিশ্বাস’ ব্যবহার করে প্রতারনার জন্য চক্রটি প্রধানত হলুদ অটো ব্যবহার করে। এরা হলুদ অটোতে শিকার ধরে। এর পর হোটেলে নিয়ে বাকি ‘অপারেশন’ করা হয়। হোটেলের মালিক ও ম্যানেজারও প্রতারক চক্রের সদস্য। এদের গ্রুপে সাংবাদিক পরিচয়েও কয়েকজনকে রাখা হয়। মক্কেল ধরার জন্য ব্যবহৃত অটোতে চালকসহ এ চক্রের মোট সদস্য থাকে চার জন। এক জন বসে সামনে চালকের পাশে। বাকি দুইজন চালকের পিছনে থাকা চারজনের বসার জন্য দুই সিটে অলাদাভাবে বসে। এ অটোতে একজনের বেশী যাত্রী নেয়া হয় না। ফলে যাত্রী উঠলে তাকে কোন না কোন প্রতারকের পাশেই বসতে হবে।
যাত্রী উঠার পর পাশের প্রতারকটি উল্টোদিকে মুখ করে যাত্রীর শরীরে হেলান দিয়ে রুমাল দিয়ে নিজের ঘার মুছার ভান করে। এতে যাত্রীর মধ্যে দ্রুত শয়তানের নিঃশ্বাস প্রভাব ফেলতে শুরু করে। এর পর অটোর গতিপথ পরিবর্তন করে নির্ধারিত হোটেলে নিয়ে যাওয়া হয়। হোটেলের ছদ্মারবণে নারী ব্যবসা ও প্রতারণা কেন্দ্রে নিয়ে ভিকটিমের সঙ্গে থাকা সবকিছু কেড়ে নেয়া হয়। আরো টাকার আদায়ের কৌশল হিসেবে কোন মেয়েকে পাশে বসিয়ে ছবি তোলা হয়। এরপর বিকাশের মাধ্যমে টাকা আনার জন্য চাপ দেয়া হয়। এ সময় পুলিশ ও সাংবাদিক ডাকার ভয়ও দেখানো হয়। এক পর্যায়ে সাংবাদিক পরিচয়ে লোকজনকে ডাকাও হয়। কয়েক দিনের অনুসন্ধানে জানাগেছে বরিশার নগরীতে ‘শয়তানের নিশ্বাস’ স্কোপোলামিন ব্যবহার করে প্রতারক চক্রের খপ্পরে পড়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন অসংখ্য মানুষ। বিষয়টি অধিক প্রচারিত হওয়ায় মানুষ কিছুটা সচেতন হয়েছে। এ অবস্থায় নতুন কৌশল অবলম্বন করেছে প্রতারক চক্র। এরা অটোতে ‘মক্কেল’ ধরে হোটেলে নিয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে ব্যবহার করাহয় দেহ ব্যবসার জন্য ব্যবহৃত হোটেলগুলো। প্রসঙ্গত, শয়তানের নিঃশ্বাসের উপাদান হচ্ছে স্কোপোলামিন নামে একটি ড্রাগ। এটি মূলত পাউডার হিসেবে প্রতারণার কাজে ব্যবহার হচ্ছে। এই ড্রাগ কাগজ, কাপড়, হাত এমনকি মোবাইলের স্ক্রিনে লাগিয়েও এর ঘ্রাণ দিয়ে কিছু সময়ের জন্য যে কারো মানসিক নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়া সম্ভব।
একটি ঘটনার বিস্তারিত
বরিশাল নগরিতে শয়তানের নিঃশ্বাসের মাধ্যমে প্রতারণার একটি ঘটনার বিস্তারিত জানাগেছে। এক ব্যক্তির কাছথেকে গত ২৫ এপ্রিল শয়তানের নিঃশ্বাস প্রয়োগে অপরাধী চক্র ২ লাখ টাকার বেশি নিয়েগেছে। এক ব্যক্তি ২৫ এপ্রিল সন্ধ্যার কিছু আগে বরিশাল নগরির ১নং সিএন্ডবি পোলের ঢালে তার বড় বোনের কাছ থেকে দুই লাখ টাকা নিয়ে সিএন্ডবি চৌমাথায় যাবার উদ্দেশ্যে হলুদ অটোতে ওঠেন। উল্লেখ্য, তার দুই সহোদর ভাই পবিত্র হজ্জ্ব পালনের জন্য প্রস্তুতি পর্বে বোনের কাছ থেকে দুই লাখ টাকা আনার দায়িত্ব দেন প্রতারনার শিকার ছোট ভাইকে।
সিএন্ডবি রোডের বড় বোনের বাসা থেকে টাকা নিয়ে উল্লেখিত ব্যক্তি যখন অটোতে ওঠেন তখন ড্রাইভারের পাশে একজন এবং পিছনে চার জনের বসার সিটে আলাদাভাবে দুই জন বসা ছিলো। বাধ্য হয়ে ভিকটিম এক জনের পাশে বসার সঙ্গে সঙ্গে আগে থেকে থাকা লোকটি উল্টো দিকে ফিরে রুমাল দিয়ে নিজের ঘার মুছতে থাকে। এতে উল্লেখিত যাত্রীটি বিরক্ত হন।
এর কিছুক্ষণ পর ভিকটিমের মনে হয়, তিনি একটি অচেনা কক্ষে আছেন। এ সময় হোটেল ম্যানেজার পরিচয় দানকারী এক ব্যক্তিসহ কয়েকজন যুবক এসে ভিকটিমের পকেটে থাকা দুই লাখ টাকা এবং মানিব্যাগে থাকা ৮/৯ শ’ টাকা নিয়ে যায়। তারা বিকাশের মাধ্যমে আরো টাকার জন্য চাপ দিতে থাকে। তারা ভিকটিমের স্ত্রীর সঙ্গেও কথা বলে টাকা চায়। এর আগে বোরকা পরা এক মহিলাকে এনে পাশে বসিয়ে ছবি তোলা হয়। এর পর তারা বলতে থাকে, বিকাশে আরো টাকা না আনলে পুলিশ ও সাংবাদিক ডাকা হবে। এর উত্তরে ভিকটিম বলে, তারও পুলিশ ও সাংবাদিক আত্মীয় আছে। ভিকটিমের কথার সত্যতা পরীক্ষা করে প্রতারকরা তাকে ভবন থেকে বের হয়ে সিএন্ডবি এক নং পুলের ঢালে ছেড়ে দেয়।
সচেতন ভিকটিম
হোটেল ভবন থেকে নামার সময় ভিকটিম চারদিকে খেয়াল করার চেষ্টা করেন। রাস্তায় নেমে রূপাতলীর দিকে যাবার সাগরদী পোল দেখতে পান। পরদিন মানে ২৬ এপ্রিল দুপুরে তার বড় ভাইকে নিয়ে সাগরদী পুল নিশানা করে প্রতারণার কেন্দ্র ভবনটি চিহ্নিত করতে সক্ষম হন ভিকটিম। এ ভবনে হোটেল মুন-এর সাইন বোর্ড রয়েছে। যদিও এটি হোটেল নামের পতিতালয় হিসেবে এলাকায় পরিচিত।
পুলিশের তৎপরতা এবং কেঁচো খুড়তে সাপ
শয়তানের নিঃশ্বাসের মাধ্যমে প্রতারণার শিকার হবার বিষয়টি ভিকটিমের ভাই বিএমপি’র এক উর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে জানান। এই পুলিশ কর্মকর্তা তাৎক্ষনিকভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ করেন এবং রূপাতলী এলাকায় কর্মরত এসআই মোস্তাফিজকে বিষয়টি দেখার নির্দেশ দেন। পুলিশ কিছু ক্ষণের মধ্যে হোটেল মুন নামের দেহ ব্যবসা ও প্রতারণা কেন্দ্রে যান। তখন কথিত হোটেলে কোন বোর্ডার ছিলো না। ছিলেন মালিক ফোরকান খান ও ম্যানেজার আবদুল রাজ্জাক রাজু। তারা নিজেদের মতো করে সাজানো বক্তব্য দেন।
পুলিশের পরামর্শ অনুসারে উল্লেখিত ভিকটিম ৩ মে সংশ্লিষ্ট কোতয়ালী থানা লিখিত অভিযোগ নিয়ে ওসির সঙ্গে দেখা করেন। ওসি কাগজটি দেখে ডিউটি অফিসারের কাছে দিতে বলেন। ডিউটি অফিসার জানান, এটি অভিযোগ আকারে থাকলো। রিসিভ কপি চাইলে তিনি বলেন, অভিযোগের রিসিভ কপি হয় না। এ সময় তিনি সিসি ক্যামেরা দেখিয়ে বলেন, এটি রিভিস-এর প্রমান রাখে। কিন্তু দুই দিন পর এই অভিযোগের আর কোন হদিস পাওয়া যায়নি। কয়েকদির ঘুড়াঘুরির পর অভিযোগ নিয়ে ১৬ মে পুনরায় ওসি’র সঙ্গে দেখা করলে তিনি এটি এসআই মোস্তাফিজকে মার্ক করেন।
এসআই মোস্তাফিজ ২৪ মে দ্বিতীয় বারের মতো দেহ ব্যবসা এবং ‘শয়তানের নিশ্বাস’ চক্রের প্রতারণা কেন্দ্র হোটেল মুনে যান। এ সময় পুলিশ হোটেল মুনের মালিক ফোরকান খান ও ম্যানেজার আবদুল রাজ্জাক রাজুকে ব্যাপকভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। কিন্তু তারা আগের মতোই সাজানো বয়ান দিতে থাকেন। এ সময় অনেকটা কেঁচো খুড়তে সাপ বেরিয়ে আসার মতো ঘটনা ঘটে। উল্লেখিত হোটেলে অনৈতিক উদ্দেশে আসা এক যুবক ও যুবতী পুলিশের হাতে ধরাপড়ে। পুলিশী জেরায় অসংলগ্ন কথাবার্তা এবং সন্দেহজনক আচরণ করায় যুগলকে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। পরে মুচলেকা রেখে অভিভাবকের জিম্মায় তাদের ছেড়ে দেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।
সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ সব সংবাদ, ছবি ,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন। ভিজিট করুন : http://www.etihad.news
* অনলাইন নিউজ পোর্টাল ইত্তেহাদ নিউজে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায় ।