সিলেট বাংলাদেশ

সিলেটের কানাইঘাটে পাথর নিলামে সাগরচুরি,শতকোটি টাকার পাথর ১৭ কোটি

1 684896052189e
print news

ইত্তেহাদ নিউজ,সিলেট :  সিলেটের কানাইঘাটের সীমান্তবর্তী ‘লোভা নদী’র জব্দকৃত এক কোটি ৫ হাজার ঘনফুট পাথর নিলামে সাগরচুরির ঘটনা ঘটেছে। প্রায় ৫৬ লাখ ঘনফুট পাথর গোপন করে একটি সিন্ডিকেটের কাছে নিলাম সম্পন্ন করে খনিজসম্পদ উন্নয়ন ব্যুরো (বিএমডি)। গোপন করা এই পাথরের দাম স্থানীয় পর্যায়ে প্রায় শতকোটি টাকা। বিএমডির একাধিক কর্মকর্তার যোগসাজশে ৪৪ লাখ ঘনফুট পাথর ২১ কোটি টাকায় নিলাম কার্যকর করা হয়েছে। পাথর জব্দ করার ৫ বছর পর আওয়ামী লীগ নেতা পলাশ সিন্ডিকেটের কাছে পানির দরেই নিলাম করা হলো। উচ্চ আদালত রহস্যজনক এই নিলাম কার্যকারিতায় স্থগিতের আদেশ দিয়েছিলেন। তাও মানা হয়নি।

বিএমডির একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে  বলেন, ‘৫ বছর আগে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা মোস্তাক আহমদ পলাশ অবৈধভাবে এই পাথর মজুত করেছিলেন। সামী এন্টারপ্রাইজ নামের একটি প্রতিষ্ঠান হাইকোর্টে ‘প্রকৃত তথ্য গোপন’ করার অভিযোগ এনে নিলাম কার্যক্রম বন্ধের আবেদন করে। পরে আদালত এই নিলাম স্থগিত করে আদেশ দেন। কিন্তু বিএমডির কয়েকজন কর্মকর্তা নিলাম কার্যকর করতে কাগজে-কলমে কিছু কৌশল নেন। তারা উচ্চ আদালতের চোখ ফাঁকি দিতে নথিপত্রে ‘রিট বহির্ভূত ৪৪ লাখ ঘনফুট পাথর’ নিলাম করার কথা জানায়। নিলামকারীকে বিশেষ সুবিধা দিতে খুব বেশি সক্রিয় ছিলেন বিএমডির পরিচালক (যুগ্ম সচিব) ছরোয়ার হোসেন। তিনি কার্যাদেশ বাস্তবায়ন করতে কানাইঘাটের সীমান্ত এলাকায় নিলাম জয়ী প্রতিষ্ঠানের দেওয়া গরু ভোজেও অংশ নেন।

তিনি বলেন, বিএমডির কর্মকর্তারা ‘মামলার আওতাবহির্ভূত’ শব্দ সংযোজন করে নিলাম কার্যকর করার কৌশল নেন। বাস্তবে মামলাবহির্ভূত স্থান বলতে যেসব গ্রামের নাম উল্লেখ করা হয়েছে সেখানে গোপনকৃত ৫৬ লাখ ঘনফুট পাথরের মজুত নেই। আছে খুবই সামান্য।

 ২০১৯ সালেই জব্দ করা লোভাছড়া পাথরের দাম ছিল প্রতি ঘনফুট ৯০ টাকা। রহস্যজনক কারণে ৫ বছর আগের দরেই নিলাম করেন বিএমডির কর্মকর্তারা। বর্তমানে পাথরের প্রতি ঘনফুটের বাজারমূল্য ১২৫ টাকা। এ হিসাবে এক কোটি ঘনফুটের প্রকৃত দর আসে ১২৫ কোটি টাকা। সর্বশেষ নিলামের তথ্যমতে, ৪৪ লাখের মূল্য দাঁড়ায় ৫৫ কোটি টাকার উপরে। অথচ ৩৬ কোটি টাকা হিসাব করে এই নিলাম ডেকে ১৭ কোটি টাকায় নিলাম কার্যকর করে কর্মকর্তারা নিলাম জয়ী প্রতিষ্ঠানকে বিপুল অঙ্কের টাকার বিশেষ সুবিধা দিয়েছেন।

 সর্বশেষ সারা দেশের গেজেটভুক্ত পাথর কোয়ারিগুলোর ব্যবস্থাপনা কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয় ৪ মে। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান ওই সভায় সভাপতিত্ব করেন। সভায় বিএমডির প্রতিনিধি অবহিত করেন, ‘সিলেট জেলার লোভাছড়া পাথর কোয়ারিতে জব্দকৃত এক কোটি ঘনফুট পাথর থেকে মামলাবহির্ভূত ৪৪ লাখ ২৩ হাজার ১১৩ ঘনফুট পাথর উন্মুক্ত নিলামে বিক্রি করা হয়। এখান থেকে আনুমানিক ২১ কোটি টাকা সরকারি কোষাগারে জমা করা হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, এ সংক্রান্ত নথিপত্রে প্রকৃত তথ্য গোপন করে সরকারের অন্তত শতকোটি টাকা লোকসান করে কর্মকর্তাদের কয়েকজন লাভবান হয়েছেন। এই নিলামকে কেন্দ্র করে বিপুল অঙ্কের টাকা ভাগবাঁটোয়ারা হয়েছে।’

নথিপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, মামলাবহির্ভূত ৪৪ লাখ ২৩ হাজার ১১৩ বর্গফুট পাথরের মজুত উল্লেখ করে নিলাম তোলা হয়। দাম ধরা হয় প্রতি বর্গফুট ৭৫ টাকা। এই দর হিসাব করে ৩৩ কোটি ১৭ লাখ ৩৩ হাজার ৪৭৫ টাকায় নিলাম বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। নিলাম জয়ী এই প্রতিষ্ঠানের নেপথ্যে আছেন আওয়ামী লীগ নেতা ও কানাইঘাট উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান মোস্তাক আহমদ পলাশ। তিনি ‘পাথরখেকো’ হিসাবে স্থানীয়ভাবে পরিচিত। তিনিই ২০১৯ সালে বিএমডির দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের সহায়তায় অবৈধভাবে এই পাথর মজুত করেছিলেন। ৫ বছর পর নেপথ্যে থেকে এই পলাশকে বিপুল অঙ্কের টাকার এই পাথর নিলামের মাধ্যমে তুলে দেয় বিএমডি। নিলাম অনুষ্ঠিত হয় সিন্ডিকেট করে। যাতে আওয়ামী লীগ নেতা পলাশের বাইরে এই পাথর অন্য কোথাও না যায়। পানির দরে নিলাম পেয়ে দ্রুতগতিতে পাথর অপসারণ শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি।

জানা যায়, এ সংক্রান্ত নথিপত্রে ‘হাইকোর্টের রিটবহির্ভূত’ ৪৪ লাখ বর্গফুট পাথরের কথা উল্লেখ করে নিলাম বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে মূলত আদালতের চোখ ফাঁকি দেওয়া হয়েছে। সরেজমিন সাউথগ্রাম, বড়গ্রাম, পশ্চিমপাড়া, লোভাছড়া চা বাগিচা, নেহালপুর কান্দলা, ভাল্লুকমারা ও মুলাগুল বাজারের পূর্বাংশে সামান্য কিছু পাথরের মজুত দেখা যায়। যা খুবই সামান্য।

 সিলেটের কানাইঘাট সীমান্ত এলাকার গ্রামগুলোর মানুষের বাড়িতে ফসল নেই। প্রত্যেক বাড়িতে আছে পাথরের স্তূপ। নদীতে বাঁধা আছে বারকি নৌকা (পাথর তুলতে ব্যবহৃত এক ধরনের ছোট নৌকা)। অন্তত ২৫টি গ্রামের মানুষের আয়ের উৎস এই পাথর আহরণ। বর্ষা মৌসুমে পাহাড়ি ঢলে ভেসে আসা পাথর সংগ্রহ করে ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করেন শ্রমজীবী মানুষরা। নদী তীরবর্তী প্রতিটি গ্রামেই আছে এই পাথরের মজুত। ৫ বছরের মাথায় সেই পাথর নিলামে তুলে বিক্রি করা হয়েছে মাত্র ১৭ কোটি টাকা। ২০১৯ সাল থেকে মেঘালয় পাহাড়ের কোল ঘেঁষে আসা লোভা নদীর পাথর কোয়ারি ইজারা বন্ধ। ‘লোভাছড়া পাথর কোয়ারি’ ইজারাবিহীন থাকা অবস্থায় পাথর উত্তোলন করে নদী তীরে মজুত করে আসছিলেন ব্যবসায়ীরা। ওই সময় জেলা আওয়ামী লীগ নেতা ও কানাইঘাট উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান মোস্তাক আহমদ পলাশ ও পূর্ব লক্ষিপ্রশাদ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি, ইউপি চেয়ারম্যান তমিজ উদ্দিনসহ একাধিক ব্যবসায়ী কোয়ারি নিয়ন্ত্রণ ও পাথর উত্তোলন করতেন। করোনাকালে লোভাছড়া নদীর জিরো পয়েন্ট থেকে কানাইঘাট সেতু এলাকা পর্যন্ত বিভিন্ন স্থানে পাথর মজুত করেন তারা। অবৈধভাবে পাথর উত্তোলনের অভিযোগে ২০২০ সালের ১৭ জুন জেলা প্রশাসনের সহায়তায় অভিযান করে পরিবেশ অধিদপ্তর। এতে জব্দ করা হয় এক কোটি ৫ লাখ ঘনফুট পাথর।

 এর আগে নিলামে অংশগ্রহণকারী সামী এন্টারপ্রাইজ নামে একটি প্রতিষ্ঠান হাইকোর্টে রিট করে। ওই রিটের পরিপ্রেক্ষিতে গত ১৫ জুন বিএমডির কার্যাদেশ স্থগিত করেন উচ্চ আদালত। কিন্তু আদালতের এ নির্দেশনা উপেক্ষা করে বিএমডির কার্যাদেশপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান প্রিয়াস এন্টারপ্রাইজ পাথর সরিয়ে নিতে শুরু করেছে।

খনিজসম্পদ উন্নয়ন ব্যুরোর (বিএমডি) মহাপরিচালক মো. আনোয়ার হাবীব  বলেন, ‘লোভাছড়ার পাথর নিলাম করা হয়েছে সেটা জানি। কিন্তু পরিমাণ বা কী দরে কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে নথি না দেখে বলা যাবে না।

 

সর্বশেষ  গুরুত্বপূর্ণ  সব  সংবাদ, ছবি ,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও লেখা পেতে আমাদের  ফেসবুক পেইজে  লাইক  দিয়ে  অ্যাকটিভ  থাকুন।  ভিজিট করুন : http://www.etihad.news

* অনলাইন  নিউজ পোর্টাল  ইত্তেহাদ নিউজে  লিখতে  পারেন  আপনিও। লেখার বিষয়  ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন  [email protected] ঠিকানায় ।

সংবাদটি শেয়ার করুন....
ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক :

ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক :

About Author

etihad news is one of the famous Bangla news portals published from Abudhabi-UAE. It has begun with a commitment to fearless, investigative, informative, and independent journalism. This online portal has started to provide real-time news updates with maximum use of Smart Technology.