বাংলাদেশ ঢাকা

বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়: নিয়োগে অনিয়মের অভিযোগ

sw 60.1751473754
print news

অনলাইন ডেস্ক : উচ্চতর চিকিৎসাশিক্ষা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএমইউ) বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (সাবেক বিএসএমএমইউ) বায়োকেমিস্ট্রি ও মলিকুলার বায়োলজি বিভাগে শিক্ষক নিয়োগে অনিয়মের গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক মোজাম্মেল হক ব্যক্তিগত ‘গভীর’ সম্পর্ক ও রাজনৈতিক প্রভাব ব্যবহার করে অযোগ্য প্রার্থীকে সহযোগী অধ্যাপক পদে নিয়োগ দিতে প্রশাসনের ওপর চাপ প্রয়োগ করছেন। নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে সহযোগী অধ্যাপক পদে এক প্রার্থীকে নিয়োগের জোর চেষ্টা চলছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সহযোগী অধ্যাপক পদে আবেদনকারীর বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্তত তিন বছর অথবা অন্যান্য স্বীকৃত প্রতিষ্ঠানে ন্যূনতম চার বছর সহকারী অধ্যাপক হিসেবে অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। বিষয়টি ২০২৫ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছিল। অথচ ওই পদে আবেদনকারী ডা. মিলিভা মোজাফফর এই শর্ত পূরণ না করেও আবেদনপত্রে নিজেকে ২০১৭ সাল থেকেই সহকারী অধ্যাপক হিসেবে উল্লেখ করেন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ডা. মিলিভা মোজাফফর ২০১৭ সালের ১লা জুন উত্তরার ১ নম্বর সেক্টরের ৮-৯ রোডের ৪ নম্বর বাড়িতে অবস্থিত মেডিকেল কলেজ ফর উইমেন এন্ড হসপিটাল-এ প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। পরে ২০২২ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি সহকারী অধ্যাপক পদে নিয়োগের আনুষ্ঠানিক অনুমোদন পান।

ভুল তথ্য দিয়ে আবেদন করার পরও ডা. মিলিভা মোজাফফরকে ২০২৫ সালের ২৭ মে নিয়োগ বোর্ডের সাক্ষাৎকারে ডাকা হয়। অথচ একই পদের জন্য অনেক যোগ্য প্রার্থীকে সাক্ষাৎকারেই ডাকা হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, অধ্যাপক মোজাম্মেল হক নিজের প্রভাব খাটিয়ে ডা. মিলিভাকে নির্বাচিত করেন এবং পরে দ্রুত নিয়োগপত্র প্রদানের জন্য প্রশাসনের ওপর চাপ সৃষ্টি করেন। পরিস্থিতি জানাজানি হলে বিষয়টি ঘোলাটে হয়ে যায়। এরপর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নিয়োগপত্র স্থগিত রাখে এবং তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে।

অভিযোগ আরো গুরুতর হলো- গঠিত তদন্ত কমিটিতে অভিযুক্ত শিক্ষক অধ্যাপক মোজাম্মেল হককে রাখা হয়েছে। ফলে এই কমিটির প্রতিবেদন কতটা স্বচ্ছ হবে তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়টির একাধিক শিক্ষক।

এছাড়াও অভিযোগ রয়েছে, ডা. মিলিভার স্বামী বগুড়া মেডিকেল কলেজের ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএনপি-সমর্থিত চিকিৎসক নেতারা তদন্ত প্রক্রিয়ায় প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছেন। বিভাগে রাজনৈতিক মহড়ার কারণে শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও কর্মচারীদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে।

ডা. মিলিভার বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ রয়েছে—ভুয়া গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ, তথ্য জালিয়াতি এবং অন্যদের গবেষণা থিসিস ব্যবহার করে নিজের নামে প্রকাশনার। পাশাপাশি অধ্যাপক মোজাম্মেল হক এই অনিয়মকে আড়াল করতে তাকে ২০২০ সাল থেকে ‘চলতি দায়িত্বে’ থাকা অবস্থাকে ‘নিয়মিত পদে চাকরি’ বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন। অথচ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নীতিমালা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব নিয়োগবিধি অনুযায়ী, চলতি দায়িত্ব কখনোই নিয়মিত পদ হিসেবে গণ্য হয় না।

ডা. মিলিভা মোজাফফরের হাতে লেখা আবেদনপত্রটি যাচাই করে দেখা গেছে, আবেদনপত্রের ১৭ নম্বর পয়েন্টে সহকারী অধ্যাপক পদের যে বেতনস্কেল উল্লেখ করেছেন, সেটি তিনি পেয়েছেন ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে। কিন্তু তিনি মিথ্যা তথ্য দিয়ে লিখেছেন, তিনি ২০২০ সাল থেকেই এটি পাচ্ছেন—এবং ইচ্ছাকৃতভাবে তাঁর চলতি দায়িত্বের পদের তথ্য গোপন করেছেন।

এছাড়া ১৬ নম্বর পয়েন্টে তিনি দাবি করেছেন যে তিনি ২০১৭ সাল থেকেই সহকারী অধ্যাপক, যা সম্পূর্ণ মিথ্যা। ১৩ নম্বর পয়েন্টে তিনি নিজেকে একজন পিএইচডি ছাত্রী হিসেবে উল্লেখ করেছেন, অথচ তিনি সেই কোর্স ছেড়ে দিয়েছেন প্রায় দুই বছর আগে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে তিনি পিএইচডি ছাত্রী হিসেবে কোনো প্রমাণপত্রও জমা দেননি।

প্রচলিত নিয়মে দেশের সকল সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজে বহু শিক্ষক বর্তমানে চলতি দায়িত্বে সহকারী অধ্যাপক পদে কর্মরত থাকলেও, তারা নিয়মিত পদে চাকরির শর্ত পূরণ না করায় উচ্চ পদে পদোন্নতির জন্য যোগ্য বিবেচিত হন না।

বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ নীতিমালা অনুযায়ী, আবেদনে মিথ্যা তথ্য প্রদান শাস্তিযোগ্য অপরাধ এবং আবেদনপত্র বাতিলযোগ্য। এ অবস্থায় অধ্যাপক মোজাম্মেল হকের ভূমিকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের জন্য বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি করেছে বলে শিক্ষকমহলে সমালোচনা চলছে।

আরও জানা গেছে, ২০২৪ সালের নভেম্বরে অবসর-উত্তর ছুটিতে গেলেও অধ্যাপক মোজাম্মেল হক এখনও নিয়মিত অফিস করছেন, কক্ষ দখলে রেখেছেন এবং বিভাগের কার্যক্রমে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেছেন। বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগের ল্যাব ও যন্ত্রপাতি কেনাকাটায় তার প্রভাব রয়েছে।

এ ঘটনায় পুরো বিশ্ববিদ্যালয়জুড়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও কর্মচারীরা দ্রুত তদন্ত শেষ করে দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন।

এদিকে অনুসন্ধানে জানা গেছে, নিয়োগ বোর্ডের সাক্ষাৎকারে তৃতীয় স্থানে ছিলেন ডা. মিলিভা। অথচ প্রথম স্থানে থাকা ডা. মোহাম্মদ আলীর অভিজ্ঞতা ও যোগ্যতা ছিল তার থেকেও বেশি। প্রথমকে বাদ দিয়ে তৃতীয় স্থানে থাকা মিলিভাকে কেন নিয়োগ দেওয়ার চেষ্টা করা হলো তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে নিয়োগ কমিটির বিরুদ্ধেও।

এ বিষয়ে আরো জানতে যোগাযোগ করা হয় প্রথম স্থান অধিকার করা প্রার্থী ডা. মোহাম্মদ আলীর সাথে। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে স্বদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমি ২০২৩ সালে তৎকালীন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ পাই, তখন উপাচার্য ছিলেন অধ্যাপক শরফুদ্দিন আহমেদ। পিএইচডি সম্পন্ন করে আমি ২০২৪ সালের মে মাসে আনুষ্ঠানিকভাবে যোগদানের জন্য দেশে ফিরি। তখন উপাচার্য ছিলেন অধ্যাপক দ্বীন মোহাম্মদ। কিন্তু তখন রাজনৈতিক মহলের চাপে আমার যোগদান বাধাগ্রস্ত হয়। তারা অভিযোগ তোলে যে অধ্যাপক শরফুদ্দিন আমার পারিবারিক পরিচয় জেনেও তাদের বিরুদ্ধে গিয়ে নিয়োগ দিয়েছেন। আমি পদত‍্যাগ করতে বাধ‍্য হই।

ডা. মোহাম্মদ আলী বলেন, এরপর ২০২৫ সালের ২৭ মে আমি পুনরায় নিয়োগ বোর্ডের সাক্ষাৎকারে অংশগ্রহণ করি। উপাচার্য অধ্যাপক শাহিনুল আলম আমার শিক্ষাগত ও গবেষণাগত যোগ্যতা দেখে অত্যন্ত সন্তুষ্ট হন এবং বোর্ড আমাকে নির্বাচিত করে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, আবারও ছাত্রদলের এক সাবেক সভাপতি ও ড‍্যাব নেতার অপসন্তুষ্টি দেখা যায়, কারণ তিনি চান তার স্ত্রী ডা. মিলিভা নিয়োগ পাক। বিড়ম্বনার বিষয় হচ্ছে, এবার তারা আমাকে ‘আওয়ামী লীগপন্থী’ বলে অপপ্রচার করছে—শুধু এই কারণে যে আমার প্রথম নিয়োগ হয়েছিল অধ্যাপক শরফুদ্দিনের সময়ে।

তিনি বলেন, আমি একমাত্র পিএইচডি ডিগ্রিধারী প্রার্থী ছিলাম যাকে সাক্ষাৎকারের জন্য ডাকা হয়েছিল। আমি যুক্তরাজ‍্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি সম্পন্ন করেছি এবং বর্তমানে সেখানেই একজন পোস্টডক্টোরাল বিজ্ঞানী হিসেবে কাজ করছি। আমার গবেষণা বিশ্বের খ্যাতনামা জার্নাল যেমন Nature, Science, Cell এবং Lancet গ্রুপে প্রকাশিত হয়েছে। আমার গুগল স্কলার সাইটেশন ৩০০০-এর বেশি, h-index ১৭, রিসার্চগেট সাইটেশন ১১০০+, এবং আমি এখন পর্যন্ত Scopus ইনডেক্সকৃত ২৪টি গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ করেছি, এবং আরো প্রক্রিয়াধীন আছে।

একজন নিরপেক্ষ পেশাদার চিকিৎসাবিজ্ঞানী হিসেবে দেশের সেবায় নিয়োজিত রাখার প্রত্যাশা রেখে তিনি বলেন, কোনো রাজনৈতিক পরিচয়ে নয়, আমার শিক্ষা, অভিজ্ঞতা ও মেধা দিয়েই আমি দেশের উচ্চশিক্ষা ও গবেষণায় অবদান রাখতে আগ্রহী।

অভিযোগের বিষয়ে বায়োকেমিস্ট্রি ও মলিকুলার বায়োলজি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক মোজাম্মেল হক  বলেন, শর্তের চেয়েও ওই প্রার্থী ডা. মিলিভা মোজাফফরের অভিজ্ঞতা বেশি রয়েছে। তার ৫ বছরের অভিজ্ঞতা রয়েছে।

তিনিতো (ডা. মিলিভা মোজাফফর) সহকারী অধ্যাপক হিসেবে ৩ বছর চাকরি করেছেন, আমাদের কাছে ডকুমেন্ট রয়েছে। তাহলে ৫ বছর কিভাবে হলো- এ প্রশ্ন করা হলে তিনি এ বিষয়ে টপ অথরিটির সাথে কথা বলার পরামর্শ দেন। এরপর ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেন। পরে বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করনেনি।

এসব বিষয়ে জানতে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে ডা. মিলিভা মোজাফফর  বলেন, আপনারা যেখান থেকে এসব অভিযোগ পেয়েছেন সেখানেই যাচাই করুন। আমি কিছু বলতে পারছি না।

শর্ত পূরণ না করেও আবেদনপত্রে নিজেকে ২০১৭ সাল থেকেই সহকারী অধ্যাপক হিসেবে উল্লেখ করার বিষয়টি জানতে চাইলে তিনি বিষয়টি এড়িয়ে যান। এসময় আরো অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে নামাজের কথা বলে ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, আমরা এ বিষয়ে তদন্ত করছি। আমরা বিষয়টি নিয়ে খোঁজ নিচ্ছি। তার ব্যাপারে এমন অভিযোগ থাকায় আমরা এখনো নিয়োগপত্র দেইনি।

সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক মোজাম্মেল হকের বক্তব্যের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, উনি (মোজাম্মেল হক) এটা কেন বলেছেন সেটা বলতে পারছি না। তবে বিষয়টি নিয়ে আমরা তদন্ত করছি। তাকে এখনো নিয়োগ দেওয়া হয়নি।

 

সর্বশেষ  গুরুত্বপূর্ণ  সব  সংবাদ, ছবি ,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও লেখা পেতে আমাদের  ফেসবুক পেইজে  লাইক  দিয়ে  অ্যাকটিভ  থাকুন।  ভিজিট করুন : http://www.etihad.news

অনলাইন  নিউজ পোর্টাল  ইত্তেহাদ নিউজে  লিখতে  পারেন  আপনিও। লেখার বিষয়  ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন  [email protected] ঠিকানায় ।

সংবাদটি শেয়ার করুন....
ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক :

ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক :

About Author

etihad news is one of the famous Bangla news portals published from Abudhabi-UAE. It has begun with a commitment to fearless, investigative, informative, and independent journalism. This online portal has started to provide real-time news updates with maximum use of Smart Technology.