ইত্তেহাদ স্পেশাল

জুলাই অভ্যুত্থানের অন্যতম নায়ক আবু সাঈদ

image 205213 1752633363
print news

অনলাইন ডেস্ক : যে ছাত্র দুই হাত প্রসারিত করে বুক পেতে গুলি নিয়েছিলেন, যিনি বৈষম্যের বিরুদ্ধে ছিলেন নির্ভীক কণ্ঠস্বর—তাকে স্মরণে প্রস্তুত হচ্ছে এক গৌরবময় আয়োজন। শহীদ আবু সাঈদের শাহাদাতবার্ষিকী এবং ‘জুলাই শহীদ দিবস’ উপলক্ষে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে গড়ে উঠছে শ্রদ্ধা, প্রতিবাদ আর প্রতিজ্ঞার এক অনন্য মঞ্চ। এ দিনটিকে ঘিরে আবু সাঈদের স্মৃতিকে শুধু ‘স্মরণ’ নয়; বরং এক আদর্শ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার উদ্যোগ নিয়েছে প্রশাসন।

এক বছর পর জুলাই অভ্যুত্থানের অন্যতম নায়ক আবু সাঈদসহ জুলাই অভ্যুত্থানে শহীদদের স্মরণে প্রস্তুত পুরো জাতি। তবে এবার বেদনার শোকরং নয়; বরং শ্রদ্ধার আলোয় উদ্ভাসিত এক স্মরণ-দিবসের জন্য।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের আয়োজনে দিনব্যাপী কর্মসূচিতে প্রধান অতিথি থাকবেন শহীদ আবু সাঈদের বাবা মকবুল হোসেন এবং বিশেষ অতিথি থাকবেন রংপুরের ২১ জন শহীদ পরিবারের সদস্যরা। আয়োজনে অতিথি হিসেবে থাকছেন অন্তর্বর্তী সরকারের চার উপদেষ্টা। তারা হলেন আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল, শিক্ষা উপদেষ্টা ড. চৌধুরী রফিকুল আবরার, বন ও পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, মুক্তিযুদ্ধ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম (বীরপ্রতীক)। এ ছাড়া থাকবেন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক এস এম এ ফায়েজ, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব সিদ্দিক জোবায়ের, ইউজিসির সদস্য ড. তানজীমউদ্দীন খানসহ রাষ্ট্রের উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিরা।

আবু সাঈদ শহীদ হলেন যেভাবে: আগের দিন বেরোবি ক্যাম্পাস গেটে ছাত্রলীগ-যুবলীগের আগ্রাসী আচরণ, শেখ হাসিনার বক্তব্যের প্রতিবাদ ও কোটা সংস্কার আন্দোলনের সমর্থনে ১৬ জুলাই সকালে জিলা স্কুলের সামনে বিক্ষোভ সমাবেশের ডাক দেন রংপুরের ছাত্ররা। জিলা স্কুলের সামনে জড়ো হন কয়েকশ শিক্ষার্থী। একটি মিছিল নিয়ে টাউন হল প্রদক্ষিণ করার কথা ছিল তাদের। দুপুরের দিকে সেখান থেকে তারা একটি বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে টাউন হলের দিকে অগ্রসর হলে পুলিশ লাইন্স মোড়ে এসে বাধার মুখে পড়েন। পুলিশ মিছিলটি ছত্রভঙ্গ করতে লাঠিচার্জ শুরু করে। এ সময় কোতোয়ালি জোনের তৎকালীন সহকারী কমিশনার আরিফুজ্জামান ও কোতোয়ালি থানার তৎকালীন ওসি (তদন্ত) শাহ আলম সরদারের নির্দেশেই ওই লাঠিচার্জ চালানো হয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, আন্দোলনকারীদের ওপর হামলায় নিজেও অংশ নেন ওসি শাহ আলম।

শিক্ষার্থীরা পুলিশি বাধা উপেক্ষা করে সামনের দিকে অগ্রসর হন। তারা প্রেস ক্লাবের সামনে গিয়ে মিছিল শেষ করবেন বলে জানান। কিন্তু প্রেস ক্লাব চত্বরে পৌঁছানোর আগেই জাহাজ কোম্পানি মোড়ে আরেকবার পুলিশের বাধায় পড়ে মিছিলটি। এরপর তারা মডার্ন মোড়ে গিয়ে অবরোধ করার সিদ্ধান্ত নেন। তাদের মিছিলটি বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন মডার্ন মোড়ের দিকে এগোতে থাকলে পথে পথে যোগ দেন শত শত শিক্ষার্থী। তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটের সামনে দিয়ে এগিয়ে যাওয়ার সময় সেখানে গেট ব্লক করে পুলিশের অবস্থান দেখে দাঁড়িয়ে যান এবং স্লোগান দিতে থাকেন। একপর্যায়ে আন্দোলনকারীরা ক্যাম্পাসে ঢোকার চেষ্টা করলে পুলিশ তাদের ওপর লাঠিচার্জ ও টিয়ার গ্যাসের শেল নিক্ষেপ শুরু করে। কয়েকজন শিক্ষার্থীকে ধাওয়া দিয়ে বেধড়ক পেটায় পুলিশ। এ সময় আবু সাঈদকেও পেটানো হয়।

পরে পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। তাদের দমাতে পুলিশ টিয়ার গ্যাসের শেল, রাবার বুলেট, ছররা গুলি ও সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়ে। একপর্যায়ে বন্দুক তাক করা পুলিশের খুব কাছে এসে দুই হাত প্রসারিত করে দেন আবু সাঈদ। এ সময় পুলিশ খুব কাছ থেকে তাকে লক্ষ্য করে গুলি করলে তিনি রোড ডিভাইডার পার হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। এ সময় তাকে রিকশায় হাসপাতালে নিয়ে যান আন্দোলনকারীরা। হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসক আবু সাঈদকে মৃত ঘোষণা করেন। এ খবর ছড়িয়ে পড়ার পর আন্দোলনের অগ্নিগর্ভে পরিণত হয় রংপুর।

জুলাইয়ে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে রংপুর ছিল স্লোগান আর মিছিলের নগরী। বৈষম্যের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো আবু সাঈদের বুকে বিদ্ধ হলো পুলিশের গুলি—রক্তে রাঙা হলো রাজপথ। হত্যাকাণ্ডের ভিডিও ছড়িয়ে পড়ল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। তারপর শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার কেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় আচমকাই হয়ে উঠল প্রতিবাদের আগ্নেয়গিরি। ক্লাসরুম থেকে রাজপথ, রাজপথ থেকে জনপদ—সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ল ‘বিদ্রোহের ভাষা’। সেই ভাষায় যোগ দিল এ দেশের ছাত্র-জনতা। অবশেষে গণআন্দোলনের ঢেউয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেল দীর্ঘস্থায়ী এক স্বৈরাচার। আবু সাঈদ তার প্রাণ দিয়ে বাংলাদেশের মানুষকে দিয়ে গেলেন অনেক কিছু। দীর্ঘ সাড়ে ১৬ বছরের শৃঙ্খল ভেঙে বাংলাদেশ আজ বাকস্বাধীনতা, গণতন্ত্র, টেকসই রাষ্ট্র গঠনের পথে।

আবু সাঈদের পরিবার কী বলছে: আবু সাঈদ হত্যা মামলার বিচার প্রক্রিয়ায় সন্তোষ জানিয়েছেন তার বাবা মকবুল হোসেন। তিনি বলেন, ‘আমি চাই সরকার কঠিনভাবে বিচার করুক। অপরাধী কেউ যেন ছাড়া না পায়। আমার ছেলের সঙ্গে আরও হাজার হাজার মানুষ শহীদ হইছে, অনেক বাপ-মার বুক খালি হইছে। আমি চাই, এমনটা যেন আর কোনো মায়ের সঙ্গে না হয়। যা হইছে আমার, তা যেন আর কারও না হয়।’

শহীদ আবু সাঈদের মা মনোয়ারা বেগম বলেন, ‘অভাবের সংসার। ছোট ছেলে আবু সাঈদ পড়ালেখায় ভালো আছিল। ও নিজের লেখাপড়ার খরচ নিজে জোগাড় করছে। কিন্তু আমার ছেলের কী দোষ আছিল, সে তো কোনো দোষ করে নাই। গুলি করি হামার ব্যাটাক মারি ফেলাইছে। হামার কোনো চাওয়া নাই, যারা খুন করছে তাদের যেন শাস্তি হয়।’

নির্মিত হবে আবু সাঈদ স্মৃতিস্তম্ভ: বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা পার্কের মোড় নামে পরিচিত হলেও সেটিকে শহীদ আবু চত্বর হিসেবে নামকরণ করা হয়েছে। আজ ১৬ জুলাই আনুষ্ঠানিকভাবে এই এলাকার নাম শহীদ আবু চত্বর হিসেবে ঘোষণা করা হবে। একই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটকের উল্টো দিকে আবু সাঈদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের উদ্বোধন করা হবে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন জানিয়েছে, শিক্ষার্থীদের দাবি বিশ্ববিদ্যালয়ের আবু সাঈদ গেট নির্মাণের প্রস্তাব ইউজিসি গ্রহণ করেছে। তারা গেটের নকশা ও বাজেট চেয়ে চিঠি পাঠিয়েছে।

শহীদদের মর্যাদা, জুলাই সনদ ও দ্রুত বিচারের দাবি শিক্ষার্থীদের: জুলাই শহীদ দিবস ঘিরে বেরোবি শিক্ষার্থীরা শহীদ আবু সাঈদসহ আন্দোলনে প্রাণ হারানো সবার জন্য রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও মর্যাদা দাবি করেছেন। একই সঙ্গে তারা হত্যাকাণ্ডের দ্রুত বিচার ও দায়ীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছেন।

আবু সাঈদ হত্যা মামলার অন্যতম সাক্ষী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শাহরিয়ার সোহাগ বলেন, বিশেষ দিবসে শহীদদের ফুল দিয়ে স্মরণ অবশ্যই গুরুত্ব বহন করে। তবে তাদের প্রকৃত অর্থে সম্মানিত তখনই করা হবে, যখন তারা ন্যায়বিচারের আলোকে সাংবিধানিক স্বীকৃতি পাবে।

তিনি বলেন, জুলাই অভ্যুত্থানে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের বিচার দ্রুত সময়ের মধ্যে বাস্তবায়ন করতে হবে এবং জুলাই ঘোষণাপত্র ও জুলাই সনদের মধ্য দিয়ে দিতে হবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি। বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা শহীদের আত্মত্যাগকে অসম্মানিত করে।

আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক শামসুর রহমান সুমন বলেন, শুধু স্মরণ নয়, আমরা চাই শহীদদের আত্মত্যাগের যথাযথ মূল্য দেওয়া এবং তাদের স্বীকৃতিস্বরূপ জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করা। আন্দোলনে যারা গুলি চালিয়েছে, যারা আদেশ দিয়েছে—তাদের যথাযথ বিচারের আওতায় আনতে হবে।

দিবস ঘিরে ক্যাম্পাসে কী আয়োজন: আজ সূর্য ওঠার আগেই স্মরণযাত্রা শুরু করবেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। সকাল সাড়ে ৬টায় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে আবু সাঈদের কবর জিয়ারতের উদ্দেশ্যে রওনা দেবেন পীরগঞ্জ উপজেলার বাবনপুর গ্রামে। সেখানে শ্রদ্ধা জানিয়ে ফিরে এসে সকাল পৌনে ৯টায় শহীদ আবু সাঈদ গেট থেকে শুরু হবে কালো ব্যাজ ধারণ ও শোক র‌্যালি। এরপর একে একে উদ্বোধন করা হবে স্মৃতির নানা চিহ্ন—শহীদ আবু সাঈদ তোরণ, মিউজিয়াম এবং স্মৃতিস্তম্ভের ভিত্তিপ্রস্তর। সকাল সাড়ে ১০টায় শুরু হবে আলোচনা সভা, যেখানে অংশ নেবেন শহীদ পরিবারের সদস্য, শিক্ষক, প্রশাসন ও রাষ্ট্রীয় অতিথিরা। এই সভা চলবে দুপুর পর্যন্ত। বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হবে চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা, যেখানে ছাত্রছাত্রীরা তুলির রেখায় তুলে ধরবেন সাহস, প্রতিবাদ আর আত্মত্যাগের ছবি। বাদ আসর কেন্দ্রীয় মসজিদে অনুষ্ঠিত হবে মিলাদ ও দোয়া মাহফিল।

জুলাই শহীদ দিবস উপলক্ষে গঠন করা হয়েছে ১১টি উপকমিটি। গৌরবোজ্জ্বল এ দিনটিকে যথাযথ মর্যাদায় পালন এবং শহীদদের স্মৃতিকে সম্মানের সঙ্গে ধারণ করার লক্ষ্যে প্রতিটি উপকমিটি নিরলসভাবে কাজ করে চলেছে। এ কমিটিগুলোর দায়িত্বে রয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা ও শিক্ষার্থীরা। কেউ দেখভাল করছেন কর্মসূচির সার্বিক সমন্বয়, কেউ তোরণ ও স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ, কেউ বা অনুষ্ঠানের আলোকসজ্জা, প্রচার, নিরাপত্তা কিংবা মিলাদ মাহফিলের আয়োজন।

বেরোবি উপাচার্য ড. শওকত আলী  বলেন, শহীদ আবু সাঈদের আত্মত্যাগকে শ্রদ্ধা জানাতে আমরা দিনটি শুধু আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখছি না। আমরা চাই—এই দিনটি হোক ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ানোর সাহসের প্রতীক। শহীদের বাবাকে আমরা প্রধান অতিথি করেছি, অন্য শহীদ পরিবারের সদস্যরা বিশেষ অতিথি থাকবেন।

তিনি বলেন, এই বিশ্ববিদ্যালয় একদিন শহীদের রক্তে ভিজেছিল, আজ তা গৌরবের অক্ষরে ইতিহাস লিখছে। আমরা তার স্মৃতিকে সংরক্ষণ করছি তোরণ, মিউজিয়াম ও স্মৃতিস্তম্ভের মাধ্যমে। পাশাপাশি চেতনাকে ছড়িয়ে দিচ্ছি শিক্ষার্থী থেকে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম পর্যন্ত। আগামীর প্রজন্ম জানুক কীভাবে অন্যায় ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে গুলির সামনে দাঁড়িয়েছিল শহীদ আবু সাঈদ। আর যেন ফ্যাসিবাদ ফিরে না আসে, এই প্রজন্ম আবু সাঈদের চেতনা ও আদর্শ ধারণ করে অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারে—এটাই আমার চাওয়া।

 

সর্বশেষ  গুরুত্বপূর্ণ  সব  সংবাদ, ছবি ,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও লেখা পেতে আমাদের  ফেসবুক পেইজে  লাইক  দিয়ে  অ্যাকটিভ  থাকুন।  ভিজিট করুন : http://www.etihad.news

অনলাইন  নিউজ পোর্টাল  ইত্তেহাদ নিউজে  লিখতে  পারেন  আপনিও। লেখার বিষয়  ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন  [email protected] ঠিকানায় ।

সংবাদটি শেয়ার করুন....
ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক :

ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক :

About Author

etihad news is one of the famous Bangla news portals published from Abudhabi-UAE. It has begun with a commitment to fearless, investigative, informative, and independent journalism. This online portal has started to provide real-time news updates with maximum use of Smart Technology.