চাঁদাবাজির টাকায় রিয়াদ অল্প সময়ে বদলে ফেলেছেন নিজের জীবনযাপনের ধরন


অনলাইন ডেস্ক : বছরখানেক আগেও যার গ্রামে পরিবার নিয়ে থাকার মতো একটি ভালো ঘর ছিল না, সেই আবদুর রাজ্জাক বিন সোলাইমান রিয়াদ চাঁদাবাজি করে হাতিয়ে নেওয়া টাকায় খুবই অল্প সময়ে বদলে ফেলেছেন নিজের জীবনযাপনের ধরন। রাজধানী ঢাকায় তার রয়েছে ভাড়া করা একাধিক বাসা। আওয়ামী লীগের সাবেক এক নারী সংসদ সদস্যের বাসায় চাঁদাবাজির অভিযোগে গ্রেপ্তার হওয়ার পরে সাত দিনের রিমান্ডে রিয়াদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে তার এমনই একটি ভাড়া করা বাসা থেকে গতকাল ভোরে অভিযান চালিয়ে প্রায় ৩ লাখ টাকা উদ্ধার করেছে পুলিশ।
রিয়াদ ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে হওয়া চাঁদাবাজির মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও গুলশান থানা-পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, রিমান্ডে নিজের চাঁদাবাজি ও তদবির বাণিজ্য নিয়ে মুখ খুলছেন এই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের বহিষ্কৃত নেতা রিয়াদ। তিনি বলছেন, চাঁদাবাজির জন্য আওয়ামী লীগের সাবেক প্রভাবশালী নেতা ও সংসদ সদস্যরাই ছিলেন তার ও তার সহযোগীদের মূল লক্ষ্য। এসব ব্যক্তির কাছ থেকে চাঁদা আদায়ের জন্য তার নিজস্ব সোর্স বাহিনীও রয়েছে। এই সোর্সদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে টার্গেট করা ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে চাঁদা চাইতেন তিনি। চাহিদা অনুযায়ী চাঁদা না পেলে ‘মব’ সৃষ্টি করে তাদের হেনস্তার হুমকি দিতেন।
সূত্র আরও জানায়, রিমান্ডে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে রাজধানীতে রিয়াদের দুটি ভাড়া বাসায় অভিযান চালিয়েছে পুলিশ। সর্বশেষ গতকাল ভোরে বাড্ডার একটি ভাড়া মেস বাসায় গুলশান থানা-পুলিশ অভিযান চালিয়ে রিয়াদের থাকার ঘরের একটি ছোট ওয়ার্ডরোব থেকে ২ লাখ ৯৮ হাজার টাকা উদ্ধার করে পুলিশ।
আরও পড়ুন:
সমন্বয়ক পরিচয়ে চাঁদাবাজিতে নামে রিয়াদ,গড়ে তোলে একটি চাঁদাবাজি চক্র
বিষয়টি নিশ্চিত করে গুলশান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হাফিজুর রহমান বলেন, ‘রিয়াদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী তাকে সঙ্গে নিয়ে ওই বাসায় আজ (গতকাল) ভোরে আমাদের থানা-পুলিশ অভিযান চালায়। ওই বাসার একটি রুমে একাই থাকতেন রিয়াদ। তার থাকার রুমের একটি ছোট ওয়ার্ডরোবে রাখা ছিল টাকাগুলো।
ওসি বলেন, ‘এখন পর্যন্ত ঢাকায় রাজ্জাকের দুটি বাসার সন্ধান পাওয়া গেছে। এর মধ্যে একটি পশ্চিম রাজাবাজার এলাকায়, আরেকটি বাড্ডার বৈখাল এলাকায়। বাড্ডার বাসায় তিনি নিয়মিত থাকতেন। আর রাজাবাজারের বাসায় মাঝে মধ্যে যেতেন।’
ওসির দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বাড্ডায় যে বাসায় অভিযান চালানো হয় সেটি চার রুমের একটি সাধারণ ফ্ল্যাট। বাকি তিন রুমে চার-পাঁচজন করে ছাত্র একসঙ্গে থাকেন। আর একটি রুমে রিয়াদ একাই থাকতেন।
গত ২৬ জুলাই সাবেক সংসদ সদস্য শাম্মী আহমেদের বাসায় চাঁদাবাজির অভিযোগে গ্রেপ্তার হন রিয়াদসহ পাঁচ জন। এই ঘটনায় রিয়াদসহ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের ছয়জন সক্রিয় নেতার নাম উল্লেখসহ আরও ১০ থেকে ১২ জনকে অজ্ঞাতপরিচয় আসামি করে গুলশান থানায় চাঁদাবাজির মামলা করেন শাম্মী আহমেদের স্বামী সিদ্দিক আবু জাফর। অন্য আসামিরা হলেন—গৌরব জামান ওরফে অপু, ইব্রাহিম হোসেন ওরফে মুন্না, সাকাদাউন সিয়াম, সাদমান সাদাব ও একজন কিশোর বয়সী ছেলে। পুলিশ বলছে, রাজধানীতে একটি চক্র নানা দল, উপদলে ভাগ হয়ে চাঁদাবাজি ও তদবির বাণিজ্য করে, যাদের নিয়ন্ত্রণ করে রিয়াদ ও অপু। রিমান্ডে তাদের জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের বরাত দিয়ে পুলিশ বলছে, রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান টার্গেট করে চাঁদাবাজি করত রিয়াদ, অপুরা। থানাগুলোতে সাংগঠনিক পরিচয় ব্যবহার করে তদবির করা, আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য, মন্ত্রী ও প্রভাবশালী নেতাসহ তাদের পরিচালিত প্রতিষ্ঠান টার্গেট করে চাঁদা আদায় ছিল তাদের নৈমিত্তিক কার্যক্রম। যার প্রমাণ মেলে রাজধানীর কলাবাগান থানার গ্রিন রোডে মব সৃষ্টি করার ভয় দেখিয়ে রংপুরের সাবেক সংসদ সদস্য আবুল কালাম আজাদের কাছ থেকে ৫ কোটি টাকার চেক লিখিয়ে নেওয়ার ঘটনা। পুরো ঘটনায় আমিন মোহাম্মদ গ্রুপের জমির দালাল মুক্তার নামে এক ব্যক্তি রিয়াদ ও অপুর তথ্য দাতার (সোর্স) কাজ করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ওই ঘটনায় লিখিয়ে নেওয়া ১১টি চেকের মধ্যে চারটি চেক গত বুধবার পশ্চিম রাজাবাজারের তার আরেক ভাড়া বাসা থেকে উদ্ধার করে পুলিশ। এই চার চেকে মোট ২ কোটি ২৫ লাখ টাকার জন্য স্বাক্ষর নেওয়া হয়েছিল।
চাঁদা দাবির সময় ‘মব’ দিয়ে ভীতি তৈরি করা হতো: সাবেক সংসদ সদস্য আবুল কালাম আজাদ পরিচালিত প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার ও তার শ্যালক সাইফুল ইসলাম বলেন, সেদিন অফিসে ছয়জন রিয়াদের নেতৃত্বে প্রবেশ করে। ঢুকেই তারা সবার মোবাইল ফোন নিয়ে নেয় এবং টাকা দাবি করে; কিন্তু স্যার (আজাদ) টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানান। অফিসে প্রবেশ করার সময় তাদের হাতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবি ছিল। সেগুলো তারা স্যারের পাশে রেখে ভিডিও করে। এরপর আওয়ামী লীগের দোসর আখ্যা দিয়ে টাকা দাবি করে। সে সময় তারা বলেন, আমরা আপনার অফিসে ছয়জন এসেছি; কিন্তু নিচে দুইশত জন আছে। আপনি কি চান আপনার গালে কেউ থাপ্পড় মারুক কিংবা জুতা দিয়ে বাড়ি মারুক। এটা না চাইলে টাকা দেন। এভাবে নানা ধরনের হুমকি-ধমকি দিয়ে তারা টাকা দাবি করতে থাকে; কিন্তু আমার স্যার (আজাদ) টাকা নেই বলে জানালে তারা টেবিলের ড্রয়ার সার্চ করে। সেখানে ব্যাংকের চেক বই পায়। এরপর সেই চেকে জোর করে পাঁচ কোটি টাকা লিখিয়ে নিয়ে চলে যায়।’
তথ্যদাতা মুক্তারের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমিন মোহাম্মদ গ্রুপের জমির দালাল মুক্তার। স্যারের (আজাদ) সাভারে একটি জমি আছে। সেটি বিক্রি করার চেষ্টা করছিলেন। এ জন্য মুক্তার প্রায়ই অফিসে আসত। ঘটনার দিনও সে আগে অফিসে আসে, এরপর সমন্বয়করা ঢুকে মব তৈরি করে।’ অভিযোগের ব্যাপারে মুক্তার হোসেন বলেন, ‘আমি জমি কেনাবেচার সঙ্গে যুক্ত; কিন্তু তাদের (রিয়াদ ও তার সহযোগীদের) আমি ডেকে আনব কেন? তারা কী জমি কেনে?’
এই ঘটনায় ভুক্তভোগী সংসদ সদস্যের পক্ষে কোনো মামলা হয়নি। এই বিষয়ে সাইফুল বলেন, ‘এখনই মামলা হচ্ছে না। কারণ মূল আসামিসহ চারজন গুলশান থানার মামলায় সাত দিনের রিমান্ডে আছে। এটি শেষ হলেই মামলা করব, প্রস্তুতি চলছে। যেহেতু দ্রুত বিচার আইনে মামলাটি হবে, সেহেতু আইনি ঝামেলা হচ্ছে।’
গুলশানের চাঁদাবাজির ঘটনায় রিয়াদ, অপুসহ ছয়জনের নাম এসেছে। তাদের মধ্যে অপু বাদে বাকিরা পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে। এ চক্রের বড় কোনো নিয়ন্ত্রক আছে কি-না, জানতে চাইলে গুলশান থানার ওসি বলেন, ‘রিমান্ডে আমরা নানা তথ্য পাচ্ছি। এমন কেউ (রিয়াদ-অপুকে নিয়ন্ত্রণ করা ব্যক্তি, গোষ্ঠী) থাকলে তাদের ব্যাপারেও জানানো হবে। আর যেহেতু রাজ্জাক মাঠ পর্যায়ে এসব নিয়ন্ত্রণ করে, তাই তার নাম আসছে। পলাতক অপুকেও খোঁজা হচ্ছে।
সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ সব সংবাদ, ছবি ,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন। ভিজিট করুন : http://www.etihad.news
* অনলাইন নিউজ পোর্টাল ইত্তেহাদ নিউজে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায় ।