ইত্তেহাদ এক্সক্লুসিভ

বাংলাদেশে মানবাধিকার সংকট প্রকট : এইচআরডব্লিউ

hrw
print news

বিবিসি: ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার বাংলাদেশের মানবাধিকার রক্ষার চ্যালেঞ্জে পিছিয়ে পড়েছে বলে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)। বুধবার (৩০ জুলাই) প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে সংস্থাটি বলছে, এক বছর আগে লক্ষাধিক মানুষ রাজপথে নেমে স্বৈরশাসক সরকারকে হটিয়ে সফল হলেও, মোহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বাংলাদেশের মানবাধিকার রক্ষায় পিছিয়ে পড়েছে।

১৫ বছর ধরে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রচলিত ভয়, দমননীতি ও গুমের মতো মানবাধিকার লঙ্ঘনের অনেক কিছুই শেষ হয়েছে বলে মনে হলেও, এ অন্তর্বর্তী সরকার রাজনৈতিক বিরোধীদের লক্ষ্য করে এখনও নির্বিচারে গ্রেফতার করছে। এখনো মানবাধিকার সুরক্ষায় কাঠামোগত সংস্কার আনতে পারেনি তারা।

এইচআরডব্লিউর এশিয়া অঞ্চলের উপপরিচালক মীনাক্ষী গাঙ্গুলী বলেন, ‘এক বছর আগে যারা শেখ হাসিনার দমনমূলক শাসনের বিরুদ্ধে প্রাণ ঝুঁকি নিয়ে প্রতিবাদ করেছিল, তাদের গণতান্ত্রিক ও মানবাধিকারসম্মত বাংলাদেশ গঠনের আশা এখনো অপূর্ণ রয়ে গেছে। অন্তর্বর্তী সরকার যেন এক জায়গায় আটকে আছে। একদিকে সংস্কারবিহীন নিরাপত্তা বাহিনী, অন্যদিকে মাঝেমধ্যে সহিংস ধর্মীয় কট্টরপন্থী এবং এমন কিছু রাজনৈতিক গোষ্ঠীকে সামলাতে হচ্ছে, যারা বাংলাদেশিদের অধিকার রক্ষার চেয়ে শেখ হাসিনার সমর্থকদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে বেশি আগ্রহী।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ২০২৪ সালে ১১টি সংস্কার কমিশন গঠিত হয়। অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয় ও দেশি-বিদেশি মানবাধিকারকর্মীরা যেসব সুপারিশ দিয়েছে, যা এখনো বাস্তবায়নের অপেক্ষায় রয়েছে।

বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মুখে অন্তর্বর্তী সরকার পড়ছে জানিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, মব ভায়োলেন্স, পলিটিক্যাল ভায়োলেন্স এবং রাজনৈতিক পার্টি ও ধর্মীয় গোষ্ঠী দ্বারা সাংবাদিক, সমকামী, উভয়কামী ও তৃতীয় লিঙ্গের উপর নির্যাতন বেড়েছে। গত ২৬ ও ২৭ জুলাই মবের জেরে রংপুরে সংখ্যালঘু হিন্দুদের ১৪টি বাড়ি ভাঙা হয়। চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলকায় সংখ্যালঘু গোষ্ঠীদের ওপর নির্যাতন অব্যাহত রয়েছে।

এইচআরডব্লিউ বলছে, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট হাসিনা পালিয়ে যায়। এর আগে পাঁচ সপ্তাহ আন্দোলন চলে। ওই সময়ে নিরাপত্তা বাহিনী এক হাজার ৪০০ মানুষকে হত্যা করে। হাসিনা পালানোর পর ৮ আগস্ট নোবেল জয়ী ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। কিন্তু, এখনো নিরাপত্তা বাহিনীর হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু থামেনি, যা নিরাপত্তা খাতে জরুরি সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ১৬ জুলাই গোপালগঞ্জে নিরাপত্তা বাহিনী ও বর্তমানে নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে পাঁচজন নিহত হয়। সেখানে গত বছরের আন্দোলনে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের গড়া ‘ন্যাশনাল সিটিজেন পার্টি’ সমাবেশ করেছিল। পুরনো কৌশলের পুনরাবৃত্তি করে পুলিশ পরে শত শত সম্ভাব্য আওয়ামী লীগ সমর্থককে নির্বিচারে আটক করে এবং আট হাজার ৪০০ জনের বিরুদ্ধে ১০টি হত্যা মামলা করে, যাদের অধিকাংশের নামই উল্লেখ নেই। তবে, অন্তর্বর্তী সরকার অবশ্য গণগ্রেফতারের বিষয়টি অস্বীকার করেছে।

২০২৪ সালের ৬ আগস্ট থেকে ২৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯২ হাজার ৪৮৬ মানুষের বিরুদ্ধে মামলা করে পুলিশ। এসব মামলার বেশিরভাগই হত্যাকাণ্ড সম্পর্কিত। এক হাজার ১৭০ মামলায় সাবেক ৪০০ মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীর নাম রয়েছে। এসব মামলায় বহু অজ্ঞাতনামা আসামিও রয়েছে।

এইচআরডব্লিউকে সরবরাহ করা তথ্যে দেখা গেছে, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম ২০২৪ সালের আন্দোলনকালের হত্যা বা হত্যাচেষ্টার অন্তত ৬৮টি মামলার আসামি হয়ে গত অক্টোবর থেকে কারাগারে আছেন। তবে এসব ঘটনার মধ্যে ৩৬টি ঘটেছিল এমন সময়ে, যখন তিনি দেশের বাহিরে ছিলেন। অন্যান্য অনেক ঘটনার মতো এখানেও আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করা হয়নি। অন্যান্য বড় রাজনৈতিক মামলায় আটক ব্যক্তিরাও অভিযোগ করছেন, তাদের ভিত্তিহীন অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের চিকিৎসাসেবা ও জামিন থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে।

প্রথম মামলার বিচারিক কার্যক্রম শুরু হওয়ার কথা ২০২৫ সালের ৩ আগস্টে। এ মামলার অন্যতম অভিযুক্ত শেখ হাসিনা। তার অনুপস্থিতিতে বিচার করা হবে। কিন্তু অধিকাংশ মামলার বিচার আদৌ শুরু হবে কি না, সে বিষয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে। বহু গ্রেফতারকৃত ব্যক্তির বিরুদ্ধেও কোনো প্রমাণ উপস্থাপন করা হয়নি।

দমনমূলক বিশেষ ক্ষমতা আইনের অধীনে শত শত মানুষকে আটক করা হয়ে থাকতে পারে। এ আইনে অভিযোগ ছাড়াই যে কাউকে আটক করা যায়। আগের সরকার ভিন্নমত দমনে আইনটি ব্যবহার করেছিল। এ ছাড়া গত ফেব্রুয়ারিতে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ নামের অভিযানে আট হাজার ৬০০ জনের বেশি মানুষকে ধরপাকড় করা হয় বলে জানা গেছে, যাদের অনেকে আওয়ামী লীগের সমর্থক বলে অভিযোগ।

এইচআরডব্লিউ বলেছে, গুরুতর অপরাধে অভিযুক্তদের জবাবদিহি নিশ্চিত করা গুরুত্বপূর্ণ, তথাপি অনেক গ্রেফতারই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও নির্বিচার। একইসঙ্গে আগের সরকারের অধীনে মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য দায়ী নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে এখনো খুব কম মামলাই হয়েছে।

গত জুলাইয়ে বাংলাদেশ পুলিশের একজন মুখপাত্র  বলেন, জুলাই-আগস্টের ঘটনায় মাত্র ৬০ পুলিশ কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। অথচ, ওই সময় পুলিশের পাশাপাশি সেনাবাহিনীর বহু ইউনিট নিপীড়নে অংশ নেয়, যার মধ্যে ছিল ‘কুখ্যাত’ র‍্যাবও।

২০২৪ সালের ২৭ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার শেখ হাসিনার শাসনামলে গুম সংক্রান্ত তদন্তে একটি কমিশন গঠন করে। ২৯ আগস্ট ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন ফর দ্য প্রোটেকশন অব অল পারসন্স ফ্রম এনফোর্সড ডিসঅ্যাপিয়ারেন্স বা গুম থেকে প্রত্যেক মানুষের সুরক্ষা সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক সনদ আনুষ্ঠানিকভাবে অনুমোদন করে বাংলাদেশ। গুম কমিশন এখন পর্যন্ত এক হাজার ৮০০টির বেশি অভিযোগ পেয়েছে। তারা এরই মধ্যে দুটি অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। আরেকটি আগামী ডিসেম্বরে প্রকাশের কথা রয়েছে।

কমিশন এইচআরডব্লিউকে জানিয়েছে, তারা উল্লেখযোগ্য পরিমাণ প্রমাণ সংগ্রহ করতে পেরেছেন। তবে তারা বলেন, নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা প্রমাণ নষ্ট করেছে, তদন্তে তেমন সহযোগিতা করেনি। অভিযুক্তদের জবাবদিহির আওতায় আনতে যে প্রচেষ্টা নেওয়া হচ্ছে, তা প্রতিরোধ করছে। অভিযুক্তদের অনেকেই এখনো নিরাপত্তা বাহিনীতেই কর্মরত। এ ছাড়া অপরাধে জড়িত বেশ কয়েকজন উচ্চপদস্থ ব্যক্তি অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর দেশ ছাড়তে সক্ষম হয়েছেন।

ইউনূস সরকার পুলিশ, বিচার বিভাগ, নারীর অধিকারসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে আইনি ও সাংবিধানিক সংস্কারের সুপারিশ দেওয়ার জন্য ১১টি কমিশন গঠন করে। তবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এখনো এসব সুপারিশ বাস্তবায়ন করেনি। রাজনৈতিক ঐকমত্যে পৌঁছার জন্য সংস্কার কর্মসূচি উল্লেখযোগ্যভাবে সংকুচিত করা হলেও সেই চেষ্টা বেশ ধীর হয়ে পড়েছে।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, সব ধরণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় নারীদের সম্পূর্ণ, সমান, অর্থবহ এবং নিরাপদ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি এখনো অমীমাংসিত রয়ে গেছে। বিষয়টি নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কারসহ জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের ১৩২৫ নম্বর প্রস্তাবের সঙ্গে সংগতি রেখে করার কথা বলা হয়েছে।

নিজেদের সময়কালের পরেও যাতে মানবাধিকার রক্ষায় সহায়ক হয়, সে জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের নির্বিচার আটক বন্ধ করা উচিত। বিশেষ করে, বিচার শুরু হওয়ার আগেই আটক রাখা যে নিয়ম নয়, বরং ব্যতিক্রম এ বিষয়টি তাদের নিশ্চিত করা উচিত। গুরুতর অপরাধে অভিযুক্ত নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের বিচারের মুখোমুখি করে দায়মুক্তির সংস্কৃতি বন্ধ করতে হবে; বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নির্বাহী বিভাগের প্রভাব থেকে মুক্ত রাখতে হবে; নিরাপত্তা খাতে সংস্কার শুরু করতে হবে, যার অংশ হিসেবে র‍্যাব বিলুপ্ত করা দরকার; এবং নারীর অধিকার ও নারীদের পূর্ণ প্রতিনিধিত্বকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে।

এইচআরডব্লিউ বলেছে, বিদেশি সরকারগুলো ও জাতিসংঘের উচিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সমর্থন দেওয়া। এর মধ্যে নির্দিষ্টভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ থাকা ব্যক্তিদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করাও অন্তর্ভুক্ত। অন্যান্য দেশের উচিত, যেসব ব্যক্তি বাংলাদেশ ছেড়ে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে, তাদের বিচার করা—এমনকি সর্বজনীন বিচারিক এখতিয়ারের ভিত্তিতেও। তাদের স্পষ্ট করে জানিয়ে দেওয়া উচিত যে, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের গুরুতর লঙ্ঘনের দায়ে জবাবদিহিতা নিশ্চিত না করা পর্যন্ত জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ চলতে পারে না।

মীনাক্ষী গাঙ্গুলি বলেন, ‘ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার যে বিশাল চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে সে বিষয়ে কারও কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতিতে সত্যিকারের ও টেকসই পরিবর্তন আনতে হলে এখন অনেক কাজ করা দরকার। যেসব রাজনৈতিক দলের সদস্য অতীতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয়েছেন, তাদের উচিত এ ধরণের অপরাধ যেন আর কখনো না ঘটে, তা নিশ্চিত করতে সংস্কারের পক্ষে দাঁড়ানো এবং সবার অধিকার রক্ষায় সমর্থন জানানো।

 

সর্বশেষ  গুরুত্বপূর্ণ  সব  সংবাদ, ছবি ,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও লেখা পেতে আমাদের  ফেসবুক পেইজে  লাইক  দিয়ে  অ্যাকটিভ  থাকুন।  ভিজিট করুন : http://www.etihad.news

অনলাইন  নিউজ পোর্টাল  ইত্তেহাদ নিউজে  লিখতে  পারেন  আপনিও। লেখার বিষয়  ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন  [email protected] ঠিকানায় ।

সংবাদটি শেয়ার করুন....
ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক :

ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক :

About Author

etihad news is one of the famous Bangla news portals published from Abudhabi-UAE. It has begun with a commitment to fearless, investigative, informative, and independent journalism. This online portal has started to provide real-time news updates with maximum use of Smart Technology.