সন্ত্রাসীর গায়ে রাজনীতির জার্সি!


আলম রায়হান: প্রবচনের মতো একটা কথা আছে, ‘ভিক্ষা চাই না কুত্তা ঠেকাও’। রাজনীতির জার্সি পরা সন্ত্রাসীদের দাপটে সাধারণ মানুষও অনেক ক্ষেত্রে রাজনীতি প্রসঙ্গে এ প্রবচন স্মরণ করছেন। প্রসঙ্গত, সবকিছুই রাজনীতিময় হয়ে গেছে। আর এ রাজনীতি অনেকটাই সন্ত্রাসী আর অপরাধীতে পরিপূর্ণ। অনেকটা গল্পের রাজার দিঘির মতো, দুধের বদলে পানিতে পরিপূর্ণ। একসময় বলা হতো, ‘যার নাই কোনো গতি সে করে ওকালতি।’ এটি হোমিওপ্যাথি পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়েছিল। পরে এই প্রবচন যুক্ত হয়েছে রাজনীতির সঙ্গে। নিষ্কর্মা তরুণের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে বলা হতো, ‘ছেলে আমার রাজনীতি করে!’ কিন্তু চলমান সময়ে উল্লিখিত তিনটিই রমরমা বাণিজ্যে পরিণত হয়েছে। আর এমন কোনো সন্ত্রাসী নেই যার কোনো না কোনো রাজনীতির পরিচয় পাওয়া যাবে না। সর্বত্রই ‘সন্ত্রাসীর গায়ে রাজনীতির জার্সি!’ আর রাজনীতির কলেবর যত প্রসারিত হয়েছে, অপরাধীর সংখ্যাও বেড়েছে। এ ক্ষেত্রে ঘটেছে জ্যামিতিক হারে। এদিকে রাজনৈতিক অপরাধীদের রমরমা ভাব দেখে অন্যান্য সেক্টরের বড় থেকে ছোট অপরাধীরাও নিজেকে রাজনীতির ব্র্যাকেটবন্দি করেছেন। আর রাজনৈতিক দলগুলোও এদের বরণ করে নিয়েছে এবং এদের দলের ছাতার নিচে স্থান দেওয়ার সুবিধার জন্য রাজনৈতিক দলগুলো অঙ্গ সংগঠনের সংস্থা ক্রমাগত বেড়েছে, যা একসময়ের রাজা-বাদশাহদের হেরেমের রমণীর সংখ্যার মতো প্রায় অগুনতি। এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি মাশআল্লাহ! নামের সঙ্গে ‘লীগ’ ও ‘দল’ দিয়ে এদের পিতৃপরিচয় নির্ধারণ করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। এদিকে জননজর কম। ফলে রাজনৈতিক অঙ্গসংগঠন যেন সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়ে গেছে। আর জামায়াতের স্বীকৃত অঙ্গসংগঠন কম হলেও বেনামে আছে অনেক। এরা কোকিলের মতো অন্যের বাসায় ডিম পাড়ে। সব মিলিয়ে রাজনীতির যেখানে হাত দেওয়া হবে সেখানেই সন্ত্রাসী। যেন আল মাহমুদের নোলক কবিতার সেই চরণ, “—হাত দিও না আমার শরীর ভরা বোয়াল মাছে।”
কত বিপুলসংখ্যক সন্ত্রাসী ও অপরাধী যে রাজনীতির নিরাপদ গৃহে আশ্রয় নিয়েছে, তা অনুধাবন করতে বিশেষ কিছু প্রয়োজন নেই। সংঘটিত বিভিন্ন ধরনের অপরাধকাণ্ডের দিকে হালকা করে নজর দিলেই হবে। ভোগবাদ প্রভাবিত রাজনীতির জার্সি শুধু শরীরে, অন্তরে নয়। বামধারার জার্সি যত না থাকে শরীরে তার চেয়ে অনেক বেশি থাকে অন্তরে। সেই বামধারা এখন লাজুক পান্ডার মতো বিলুপ্তপ্রায়। এখন চলছে ডান রাজনীতির তাণ্ডব। যার পুরোটাই ভোগবাদের ওপর প্রতিষ্ঠিত। নানান ধরনের অপরাধী সবসময় ক্ষমতাসীন রাজনীতির জার্সি পরার চেষ্টা করে। ক্ষমতার পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে জার্সির রং বদলে যায়। প্রথম পছন্দ হচ্ছে ক্ষমতাসীন দল। না পেলেও তেমন অসুবিধা হয় না। যে কোনো দলের জার্সি পরলেই হলো। কোনো না কোনো মাত্রার সুবিধা পাওয়া যায়। এদিকে কখন কার গণেশ উল্টায়—এ বিবেচনায় দেখা যায় একই পরিবারের সদস্যরা বিভিন্ন দলের জার্সি পরে আছেন। যাকে এক ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা আখ্যায়িত করেছেন, ‘অর্ধা ভাগের রাজনীতি’ হিসেবে। এ ধারায় রাজনীতির আয়তন অনেক বড় হয়ে গেছে। আর রাজনীতির জার্সি ছাড়া কোনো সন্ত্রাসী অথবা অন্য কোনো অপরাধী পাওয়ার উপায় নেই। এরাই মূলত চাঁদাবাজি, খুন-খারাবিসহ নানান অপরাধ করে। আর এদেরই সাধারণ মানুষ রাজনীতির কর্মী-নেতা হিসেবে চেনে। আবার শুধু অপরাধী নয়। অপরাধের যে শিকার হয় সেও অনেক ক্ষেত্রেই রাজনীতির জার্সি পরা সন্ত্রাসী। হাতের কাছে উদাহরণ, লাল চাঁদ ওরফে সোহাগ। তিনি এবং তাকে যারা খুন করেছেন তারা একই শ্রেণিভুক্ত এবং লাল চাঁদ ৫ আগস্ট পটপরিবর্তনের আগে হাজী সেলিমের গ্রুপের দাপটের ‘চাঁদ’ ছিলেন এবং যারা খুন করেছেন, তারা ছিলেন তারই সাঙ্গাত। স্বার্থের দ্বন্দ্বে খুন হওয়ার পর লাল চাঁদ মহান হয়ে গেছেন। একেবারে পূর্ণিমার চাঁদ, কোনো কলঙ্কের ছাপ নেই। বিএনপির জার্সি পরাকে এ লোককে অন্য দল ভাই হিসেবে দাবি করে মিছিল করেছে, ‘আমার ভাই মরল কেন, তারেক জিয়া জবাব চাই।’ ভাগ্য ভালো, শহীদ বলে দাবি করা হয়নি! প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের মতো এত শহীদ অন্য কোনো দেশে আছে কি না, সে বিষয়ে অনেকেরই সংশয় রয়েছে। আর রাজনীতি তো একেবারে ‘ভাইময়’। উমুক ভাই তুমুক ভাই। ভাইর আর অভাব নেই।
বাস্তবতা হচ্ছে, অপরাধ এবং রাজনীতি অবিচ্ছেদ্যভাবে সংযুক্ত। কারণ ভোগবাদী রাজনীতিতে সংঘাত অনিবার্য। আর এটি একতরফা হয় না। বিরোধী রাজনীতির দমনে শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ব্যবহারের পাশাপাশি নিজস্ব বাহিনীও লাগে। রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সঙ্গে প্রাইভেট বাহিনীও থাকে। এটি সব সরকারের আমলে প্রকটভাবে প্রকাশিত হয়েছে। তবে নগ্নভাবে প্রকাশিত হয়েছে পৈশাচিক স্বৈরাচার শেখ হাসিনার শেষ সময়ে জুলাই-আগস্টে। আর সরকার লালিত সন্ত্রাসীদের জেনারেল এরশাদ আখ্যায়িত করেছিলেন ‘শান্তি সৈনিক’ হিসেবে। এই ‘শান্তির সৈনিকরা’ সবসময়ই রাজনীতি ও সমাজে অশান্তির মূল কারণ। এদের সবারই রাজনীতির জার্সি আছে। জনগণ তাদের তাণ্ডব বিবেচনা করে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড হিসেবেই। ফলে জনগণ রাজনীতির প্রতি বীতশ্রদ্ধ। প্রসঙ্গত, এক সময়ে সন্ত্রাসীপ্রবণতার মানুষকে শক্ত ভিত্তি দেওয়ার উর্বর জমি ছিল বামধারার রাজনীতি। এরা ছিল অনেকটাই নিয়ন্ত্রিত। পরে সন্ত্রাসী লালনের ধারা প্রায় পুরোই চলে গেছে ডানে এবং এরা অনিয়ন্ত্রিত। মুক্ত জলাশয়ের আফ্রিকান মাগুরের মতো। তবে এ ক্ষেত্রে জামায়াত অনেকটাই ব্যতিক্রম।
প্রসঙ্গত, মার্ক্সবাদী অপরাধবিদদের মতে, বেশিরভাগ রাজনৈতিক অপরাধ রাষ্ট্রের বৈষম্যের কাঠামো থেকে উদ্ভূত হয়। এদিকে রাজনীতির আওতায়ও অপরাধী সৃষ্টি হয়। রাজনৈতিক অপরাধী অত্যাচারী শাসকের বিরুদ্ধে লড়াই করে। ফলে যাই ঘটুক না কেন, রাজনীতিতে বিজয়ীকে ‘অপরাধী’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয় না। আর পাকিস্তান আমল থেকে আমাদের এ ভূখণ্ডে অনেকগুলো ‘সফল’ নৃশংস ঘটনা ঘটে আসছে। রাজনীতিতে নৃশংস অপরাধ করেও তারা অপরাধী নয়! এ ধারায় রাজনীতি যেন নৃশংতার সমার্থক হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পাঠ অনুসারে, অপরাধবিদ্যায়, রাজনৈতিক অপরাধ এবং অন্যান্য অপরাধ হলো এমন একটি প্রবণতা, যা রাষ্ট্র ও সরকারের ক্ষতি করে। একপর্যায়ে বিষয়টি রাষ্ট্রের অস্তিত্বের জন্যই হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে। সুদূর ও নিকট ইতিহাস বলে, অপরাধপ্রবণতা সীমা ছাড়ালে একপর্যায়ে তা রাষ্ট্রদ্রোহ, সন্ত্রাসবাদ নিয়ন্ত্রণের বাইরে গিয়ে ক্ষমতায় থাকা সরকারের প্রতিই চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে। ক্ষমতাসীনদের স্বার্থেই অপরাধীদের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর কথা। কিন্তু সেটি দৃশ্যমান তো নয়ই, মৃদু অনুভবেও নেই। বরং সন্ত্রাসী লালনের প্রবণতা প্রকট। অথচ নির্দলীয় সরকারের সময় সন্ত্রাসীদের জন্য বিরূপ পরিস্থিতি হওয়ার কথা। কিন্তু বর্তমান ড. ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে ভিন্ন পরিস্থিতি বিরাজমান। এর প্রধান কারণ হতে পারে, বর্তমান সরকার রাজনৈতিক লক্ষ্যহীন নয়। ফলে চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের এক বছর পরও লাগাতরভাবে সংঘটিত নানা ধরনের অপরাধ ও এর বিস্তৃতির ধারা অব্যাহত। শুধু তাই নয়, বর্তমান সরকারের এক বছরে বিশেষ কিছু অপরাধের মাত্রা আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। এর মধ্যে নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা ও মব-সন্ত্রাসের মতো অপরাধ সরাসরি ভুক্তভোগী ছাড়াও আতঙ্কে ফেলেছে সাধারণ জনগণকে। সহিংসতা-পরবর্তী এই বিশেষ সময়ে নানা অপরাধপ্রবণতা বিস্তৃতি প্রতিরোধে বর্তমান সরকারের প্রতিক্রিয়া ও প্রচেষ্টাকে অপরাধবিজ্ঞানের লেন্সে দেখা প্রয়োজন। তা না হলে কিন্তু শুধু বিপদ নয়, মহাবিপদ!
অপরাধ সীমা ছড়িয়েছে। পরিসংখ্যান তাই বলে। চলতি বছরের এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত ‘অধিকার’-এর ত্রৈমাসিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তিন মাসে দেশে রাজনৈতিক সহিংসতায় কমপক্ষে ৭২ জন নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে ১ হাজার ৬৭৭ জন। এসব ঘটনার অধিকাংশ খলনায়কদেরই রাজনীতির জার্সি আছে।
লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক