বাংলাদেশ সিলেট

ভোলাগঞ্জ কোয়ারির নতুন অধিপতি ছিলেন বাহার ও রজন

175987 f3
print news

ইত্তেহাদ নিউজ অনলাইন : ভোলাগঞ্জ কোয়ারির নতুন অধিপতি ছিলেন বাহার ও রজন। তাদের নেতৃত্বেই ভোলাগঞ্জে হাজার হাজার কোটি টাকার পাথর লুট হয়েছে। প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গেও ছিল তাদের দহরম-মহরম। হাত প্রসারিত ছিল সিলেট ও ঢাকা পর্যন্ত। তাই ভয়ে কেউ কোয়ারি এলাকায় ‘টু’ শব্দটিও করতে পারেননি। প্রশাসন হাতে থাকায় ভোলাগঞ্জ কোয়ারিতে গত এক বছর বেপরোয়া কর্মকাণ্ড চালিয়েছে। বাহার-রজনের বেপরোয়া কর্মকাণ্ডের নানা অভিযোগ জমা পড়েছিল বিভিন্ন দপ্তরে। কিন্তু সিলেটের জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার সব সময় ছিলেন নীরব। কোনো অভিযোগের ব্যবস্থা নেয়া তো দূরের কথা, তদন্তই হয়নি। বাহারের পুরো নাম বাহার আহমদ রুহেল। বাড়ি ভোলাগঞ্জ কোয়ারির তীরে বালুচরে। তিনি সিলেট জেলা যুবদলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। এক সময় সিলেট নগরে অপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। বিএনপি’র জমানায় সিলেট নগরের চৌহাট্টা এলাকায় আগ্নেয়াস্ত্রসহ গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। তখন ছিলেন ছাত্রদল নেতা। একই সময় দয়ারবাজারের আমবাড়ি হোটেল থেকে অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার হয়েছিলেন তার ভাই গিয়াস উদ্দিন। দুই ভাই অস্ত্র মামলায় কারান্তরীণ ছিলেন। আওয়ামী লীগের জমানায় নীরব ছিলেন বাহার। তবে তার ভাইরা বালু ও পাথর লুটে সরব ছিলেন। আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে আঁতাত করে বালু ও পাথর লুটপাট চালিয়েছেন। ভোলাগঞ্জ কোয়ারিতে বাহার জমানার শুরু হয় ২০২৪ সালের ৫ই আগস্টের দিন থেকে। ওইদিন তার নেতৃত্বে ভোলাগঞ্জ এলাকায় বিজয় মিছিল করা হয়। রেলওয়ের সংরক্ষিত সম্পত্তি ‘বাঙ্কার’ কার্যালয় ও সম্পত্তিতে লুটপাট চালানো হয়। সঙ্গে ছিল তারই ঘনিষ্ঠজন রজন মিয়া। রজন কোম্পানীগঞ্জ যুবদলের যুগ্ম সম্পাদক। একসঙ্গে দু’জনের রাজনীতি। একসঙ্গেই ওঠা-বসা। গণ-অভ্যুত্থানের দিন দু’জন জনতার নেতৃত্ব দেয়ায় প্রশাসন তাদের অনুকূলে চলে যায়। আর সেই থেকে ভোলাগঞ্জের কোয়ারিতে দাপট শুরু তাদের। সর্বশেষ তাদের নেতৃত্বেই হয়েছে সাদাপাথর লুটপাট।

সাদা পাথরের দু’টি অংশ। একটি অংশে নদীর পশ্চিমপাড় ও আরেকটি অংশ পূর্বপাড়। পূর্বপাড় অংশেই বেশি লুটপাট হয়েছে। আর এই লুটপাট একদিনের মিশনে হয়নি। দীর্ঘদিন ধরেই সাদাপাথরে চোখ পাথরখেকোদের। কিন্তু বিজিবি’র কড়াকড়ির কারণে লুটপাট বন্ধ ছিল। বাহার ও রজন প্রশাসন ম্যানেজের পর বিজিবিকে ‘অ্যাটাক’ করেন। শ্রমিকদের দিয়ে কয়েক দফা বিজিবি’র ওপর হামলা চালানো হয়। বিজিবি সদস্যদের বিতর্কিত করা হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কয়েকটি ভিডিও ভাইরাল করা হয়। পরে বিজিবি নীরব হয়ে পড়লে চলে সাদাপাথর লুটপাটের ‘মহাযজ্ঞ’। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, সাদাপাথরের পূর্ব অংশ লুটপাটের অনুমতি দেয় বাহার ও রজন। তারা হচ্ছেন, পুলিশের লাইনম্যান। কোয়ারিতে মূলত লাইনম্যানই সবকিছু। লাইনম্যানরা কোয়ারি লুটের কমান্ডিং অফিসার হিসেবে কাজ করেন। ফলে অনুমতি পাওয়ার পর শ’ শ’ নৌকা পাঠানো হয় সাদাপাথরে। রাত ও দিনে চলে লুটপাট। আর এই লুটপাটে নৌকাপ্রতি পুলিশের নামে টাকা আদায় করা হয়। শ্রমিকরা জানিয়েছেন, লুটপাট করা পাথরের ছোটো নৌকা থেকে ৫শ’ থেকে ৭শ’ টাকা করে চাঁদা আদায় করা হয়। এতে সাদাপাথর লুটের দুই সপ্তাহে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়েছে। শ্রমিকরা ছিল পাথর সিন্ডিকেটের বেতনধারী। তারা ১ হাজার টাকা বেতনে প্রতিদিন সাদাপাথর লুটপাট চালিয়েছে। এই লুটে কয়েক হাজার শ্রমিক নিয়োজিত ছিল। তারা জানিয়েছেন, লুটের অর্ধেক পাথর বড় বড় ভলগেট দিয়ে ছাতক হয়ে ঢাকা পর্যন্ত নেয়া হয়েছে। আর অর্ধেক পাথর ধোপাগুলসহ কয়েকটি পাথর জোনে বিক্রি করা হয়। সে পাথরগুলো এখন প্রশাসনের অভিযানে উদ্ধার হচ্ছে। পাথর ব্যবসায়ীরা ধারণা করছেন, সাদাপাথর থেকে দুই সপ্তাহে ২০০ কোটি টাকার পাথর লুট হয়েছে। আর লুটের পাথর থেকে পুলিশ ও বিজিবি’র নামে অন্তত ২০ কোটি টাকার চাঁদাবাজি করা হয়েছে। এ চাঁদাবাজি করেন বাহার ও রজন। তাদের সিন্ডিকেটে রয়েছে পূর্ব ইসলামপুর ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি আলীম উদ্দিন, যুবলীগ নেতা বিলাল আহমদ, বাহারের ভাই গিয়াস উদ্দিন, ওয়ার্ড যুবলীগ সভাপতি আজিদ আহমদ, শাহাব উদ্দিন, একাধিক মামলার আসামি কলাবাড়ি এলাকার মনির আহমদ, কালাইরাগ এলাকা আমির উদ্দিন ও বাহারের ভাই নাজিম উদ্দিন। এছাড়া তাদের সিন্ডিকেটের কম হলেও শ’খানেক লোক ছিলেন। তারা কোয়ারিতে আধিপত্য রাখতে লাঠিসোটা নিয়ে কোয়ারিতে মহড়া দিতো। বাহারের বালুচরের বাড়ি বালুচরে তাদের নিজস্ব অফিস। এই অফিসে বসেই তারা নিয়ন্ত্রণ করতেন গোটা কোয়ারি। টাকার ভাগ-বাটোয়ারা হতো ওখান থেকে। স্থানীয়দের মতে, বাহার ও রজন কোয়ারি লুটপাট ও লাইনম্যানের প্রাপ্ত টাকায় এক বছরেই ২০ থেকে ২৫ কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। সম্প্রতি সময়ে বাহার ১৫ লাখ টাকায় রেব ফোর নামের একটি গাড়ি ক্রয় করেছেন। নামে-বেনামে কোয়ারিতে ক্রয় করেছে ভূমি। সাদাপাথর লুটের ঘটনায় প্রশাসন সক্রিয় হওয়ার পর বাহার, রজন ও তাদের সিন্ডিকেট গা ঢাকা দিয়েছে। বর্তমানে এলাকায় কেউ নেই। তিন দিন আগেই তারা এলাকা ছেড়ে পালিয়েছেন। এখন ব্যবহৃত মোবাইল ফোনও বন্ধ।

একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাদের পাওয়া যায়নি। তবে সাদাপাথর লুটের ঘটনায় দেশজুড়ে আলোচিত হওয়ার সময় তারা এলাকাতেই ছিলেন। ওই সময় বাহার আহমদ রুহেল ও রজন মিয়া সাদাপাথর লুটের ঘটনায় জানিয়েছিলেন, ‘লুটের সঙ্গে তারা জড়িত নয়। পুলিশের লাইনম্যান হিসেবে কারা রয়েছে সেটি তারা জানেন না।’ এ দু’জন ছাড়াও ভোলাগঞ্জ কোয়ারিতে বিজিবি’র লাইনম্যান হিসেবে ছিলেন নাজিরের গাঁওয়ের কালাম আহমদ, কালাইরাগের কামাল আহমদ ও দিলীপ সুট। পাথর লুটের ঘটনায় ইতিমধ্যে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছে লাইনম্যান কালাম ও কামাল। তবে দিলীপ সুট রয়েছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। সে অস্ত্র মামলার তালিকভুক্ত আসামি ছিল। পাথর শ্রমিকরা জানিয়েছেন, গত এক বছরে পুলিশের নামে বাহার ও রজন ভোলাগঞ্জ কোয়ারিতে ঘাটে ঘাটে চাঁদাবাজি করেছে। এতে তারা প্রতিদিনই ২০ থেকে ২৫ লাখ চাঁদার টাকা আদায় করে। এর কিছু অংশ পুলিশকে দিয়ে পুরোটাই তারা নিজেদের পকেটে ভরেছে। প্রতিদিন কোয়ারিতে চলে ৫ হাজার বারকি নৌকা। এসব নৌকা থেকে ৫০০ থেকে ৩০০, ৪০ থেকে ৫০টি ফেলুডার থেকে ৩ হাজার টাকা, ৫০-৬০টি লিস্টার থেকে ১৫ হাজার টাকা ও ৪শ থেকে ৫শ’ ট্রাক্টর থেকে ২ হাজার করে চাঁদাবাজি করতো। ফলে এক বছরে শতকোটি টাকা চাঁদাবাজি করা হয়েছে। যারাই চাঁদা দিতে প্রতিবাদ করেছেন পুলিশ দিয়ে তাদের হয়রানি করা হয়েছে। তাদের এই চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে কয়েক মাস আগে সিলেটের পুলিশ সুপারের কাছে আবেদন করেছিলেন কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা শ্রমিক দলের সভাপতি এলাইছ আহমদ ও স্থানীয় ব্যবসায়ী আরিফ চৌধুরী রাজ। অভিযোগ দিলেও প্রশাসনের পক্ষ থেকে বাহার ও রজনের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি বলে জানিয়েছেন অভিযোগকারীরা। উল্টো তাদের নানাভাবে হয়রানি করা হয়। ভোলাগঞ্জ পশ্চিম পাড়ে সমানভাবে চাঁদাবাজি হয়েছে। পূর্বপাড়ের লাইনম্যান ছিলেন- উপজেলা যুবদলের আহ্বায়ক সাজ্জাদ হোসেন দুদুর ভাই বুরহান উদ্দিন, আজিম উদ্দিন, ভোলাগঞ্জের জাহাঙ্গীর ও তার ভাই জাকিরসহ কয়েকজন। তবে, পুলিশের লাইনম্যানের কথা অস্বীকার করেছেন কোম্পানীগঞ্জের ওসি উজায়ের আল মাহমুদ আদনান। তিনি জানিয়েছেন, পাথর লুটের ঘটনায় ইতিমধ্যে কোম্পানীগঞ্জ থানায় ১৯টি মামলা হয়েছে। গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৬০ জনকে। প্রতি সপ্তাহে যৌথ টাস্কফোর্স অভিযান চালিয়েছে বলে জানান তিনি।

 

সর্বশেষ  গুরুত্বপূর্ণ  সব  সংবাদ, ছবি ,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও লেখা পেতে আমাদের  ফেসবুক পেইজে  লাইক  দিয়ে  অ্যাকটিভ  থাকুন।  ভিজিট করুন : http://www.etihad.news

অনলাইন  নিউজ পোর্টাল  ইত্তেহাদ নিউজে  লিখতে  পারেন  আপনিও। লেখার বিষয়  ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন  [email protected] ঠিকানায় ।

সংবাদটি শেয়ার করুন....
ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক :

ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক :

About Author

etihad news is one of the famous Bangla news portals published from Abudhabi-UAE. It has begun with a commitment to fearless, investigative, informative, and independent journalism. This online portal has started to provide real-time news updates with maximum use of Smart Technology.