ইত্তেহাদ এক্সক্লুসিভ

গঙ্গা চুক্তির আলোচনায় থাকতে চায় তৃণমূল কংগ্রেস

ব্যরাজ ফাইল ছবি
print news

বিবিসি বাংলা: পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেস দাবি তুলেছে যে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের গঙ্গার জলবণ্টন চুক্তি নবায়নের সময়ে তাদের সঙ্গেও যেন আলোচনা করা হয়।দলটি বলেছে একতরফাভাবে যেন কেন্দ্রীয় সরকার বাংলাদেশের সঙ্গে জলবণ্টন চুক্তি চূড়ান্ত না করে ফেলে – যেরকমটা হতে যাচ্ছিল তিস্তার জলবণ্টন চুক্তির সময়ে। যদিও পরে তিস্তা চুক্তি আর হয়নি।

রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা মনে করছেন যে সব রাজ্যের ওপর দিয়ে গঙ্গা প্রবাহিত হয়েছে, সেরকম প্রতিটা রাজ্যকেই গঙ্গা চুক্তি নিয়ে আলোচনায় রাখা উচিত।দেশের পার্লামেন্টে তৃণমূল কংগ্রেস এই প্রশ্নও তুলেছে যে বাংলাদেশের সঙ্গে গঙ্গার জল বণ্টন করার কারণে নদীর গতিপথের আকার ও ধরনের কোনও পরিবর্তন হয়েছে কি না।

তবে পার্লামেন্টে কেন্দ্রীয় জল-শক্তি মন্ত্রণালয় লিখিত জবাবে জানিয়েছে যে বাংলাদেশের সঙ্গে জল বণ্টনের ফলে পশ্চিমবঙ্গে নদীর গতিপথের আকার ও ধরনে যে কোনও পরিবর্তন হয়েছে, তার সুনিশ্চিত কোনও প্রমাণ নেই।

চুক্তিটি ১৯৯৬ সালে স্বাক্ষরিত হওয়ার ৩০ বছর পরে ২০২৬ সালে তা নবায়ন হওয়ার কথা। ইতিমধ্যেই বাংলাদেশের নদী কমিশনের প্রকৌশলীরা ফারাক্কায় এসে জলের পরিমাপ সহ নানা তথ্য সংগ্রহ করেছেন।কিন্তু তৃণমূল কংগ্রেস দাবি করছে যে ওই চুক্তি নবায়ন হওয়ার আগে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সঙ্গেও আলোচনা করতে হবে ভারত সরকারকে।

ঋতব্রত ব্যানার্জী বলছিলেন, “এটা আন্তর্জাতিক চুক্তি হলেও যেহেতু পশ্চিমবঙ্গের ওপর দিয়ে এই নদী প্রবাহিত হয়েছে, তাই রাজ্য সরকারের কথাও শুনতে হবে। এই চুক্তি যখন হয় ১৯৯৬ সালে, তখনই বিশেষজ্ঞরা আপত্তি তুলেছিলেন যে এর ফলে কলকাতা বন্দরে নাব্যতার বড় সমস্যা দেখা দেবে এবং নদী ভাঙ্গনের ফলে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হব। আবার সুন্দরবন অঞ্চলেও ক্ষতি হবে।

“৩০ বছর পরে এসে দেখা যাচ্ছে যে ব্যাপক নদী ভাঙ্গন হয়ে চলেছে আর কলকাতা বন্দরের নাব্যতা বলতে গেলে নেই। আবার বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ অরণ্য সুন্দরবনে যদি নদীর মিষ্টি জল প্রবাহিত না হতে পারে তাহলে সেখানকার পরিবেশগত ভারসাম্য প্রভাবিত হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা এখনও সেই আশঙ্কা প্রকাশ করে চলেছেন। তাই সবথেকে বড় স্টেকহোল্ডার তো পশ্চিমবঙ্গ। তাই আমাদের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে এ ব্যাপারে আলোচনা করতেই হবে,” বলছিলেন মি. ব্যানার্জী।

তিনি বলছিলেন যে আগামী বছর চুক্তিটি নবায়ন হওয়ার কথা এবং খুব দ্রুতই আলোচনা শুরু হওয়ার কথা এবং একতরফা-ভাবে কেন্দ্রীয় সরকার যেন কোনও সিদ্ধান্ত না নেয়।তার কথায়, “পশ্চিমবঙ্গের মানুষের ক্ষতি করে চুক্তি যেন না হয়। একটা আলোচনা হোক পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে।

আন্তর্জাতিক চুক্তিতে রাজ্যের কী ভূমিকা?

গঙ্গা চুক্তি সই হয়েছিল ভারত ও বাংলাদেশ – দুই সরকারের মধ্যে। তবে ১৯৯৬ সালেও পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু সবুজ সংকেত দেওয়ার পরেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়েছিল। সেই সময়ে জ্যোতি বসুকে রাজি করাতে ব্যক্তিগত উদ্যোগ নিয়েছিলেন সেসময়ের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ও কংগ্রেস নেতা বরকত গণি খান চৌধুরী।

তবে তিস্তার জল বণ্টন নিয়ে যখন শেষ মুহূর্তে চুক্তি সই হয় নি মূলত মমতা ব্যানার্জীর আপত্তিতে, তখন এই প্রশ্ন উঠেছিল যে দুটি দেশের মধ্যে একটা আন্তর্জাতিক চুক্তিতে কোনও অঙ্গ রাজ্যের মতামত কেন নেওয়া হল।

তৃণমূল কংগ্রেসের সংসদ সদস্য ঋতব্রত ব্যানার্জী বলছিলেন, “আমাদের দেশের সংবিধান অনুযায়ী যে রাজ্যের ওপরে দিয়ে কোনও নদী প্রবাহিত হয়, সেই রাজ্যের অধিকার রয়েছে ওই নদী নিয়ে মতামত দেওয়ার। আমাদের মতামত খুব স্পষ্ট – আন্তর্জাতিক চুক্তি বলে রাজ্যকে বাদ দেবেন, এটা অসাংবিধানিক। আমরাই তো বড় স্টেক হোল্ডার।”

আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশ্লেষক ও রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক সব্যসাচী বসুরায়চৌধুরী বলছিলেন, “আগামী বছর যেহেতু এই চুক্তির নবায়ন হওয়ার কথা, তাই স্বাভাবিকভাবেই তৃণমূল কংগ্রেস আগেভাগেই জানিয়ে রেখেছে যে তাদেরও যেন চুক্তি নিয়ে আলোচনার মধ্যে রাখা হয়।”

“যে প্রশ্নটা তোলা হয়েছে, যে রাজ্যের ওপর দিয়ে গঙ্গা প্রবাহিত হচ্ছে, সেখানে সংশ্লিষ্ট রাজ্যকে আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত করা উচিত কী না। ভারতের অঙ্গরাজ্যগুলোর নিজেদের এক্তিয়ার রয়েছে, অন্যদিকে প্রতিবেশী দেশে অঙ্গরাজ্য তো নেই। সুতরাং এখানে আমার মত হচ্ছে, শুধু পশ্চিমবঙ্গ কেন, যতগুলি রাজ্যের ওপরে দিয়ে গঙ্গা বয়ে এসেছে, প্রতিটা রাজ্যেরই মত নেওয়ার দরকার আছে।”

”ব্রহ্মপুত্রের ক্ষেত্রে যেমন আসাম, অরুণাচল প্রদেশ বা তিস্তার ক্ষেত্রে সিকিম এবং পশ্চিমবঙ্গের মতামত নেওয়াটাই উচিত, তাদের বক্তব্য শোনা দরকার। এদের বাদ দিয়ে আন্তর্জাতিক চুক্তি হয়ে গেলে তা কতটা কার্যকরী হবে, তা নিয়ে সন্দেহ আছে। তবে প্রতিটা রাজ্যের মতামত কতটা রাখা যাবে, সেটা অন্য বিতর্কের বিষয়,” বলছিলেন অধ্যাপক বসুরায়চৌধুরী।

9b270a10 7d09 11f0 83cc c5da98c419b8.jpg
বাংলাদেশকে জল দেওয়ার ফলে কি নদীর গতিপথ বদলেছে?

তৃণমূল কংগ্রেসের সংসদ সদস্য গঙ্গার জলপ্রবাহ নিয়ে দুটি পৃথক প্রশ্ন করেছিলেন।একটিতে তিনি জানতে চেয়েছিলেন যে বাংলাদেশের সঙ্গে গঙ্গার জল বণ্টন করার ফলে তাদের রাজ্যে যে নদী ভাঙ্গন হচ্ছে, তার ফলে লক্ষ লক্ষ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন কি না। দ্বিতীয় প্রশ্নটি ছিল গঙ্গার গতিপথ পরিবর্তনের ফলে সুন্দরবনের ওপরে কোনও নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে কি না।এই প্রশ্নের লিখিত জবাব দিয়েছেন জল-শক্তি মন্ত্রী সি আর পাটিল।তিনি জানিয়েছেন যে, নদীর গতিপথে পলি বয়ে আনা এবং পলি জমা হওয়া সহ নানা ভৌগলিক কারণেই নদীর গতিপথের আকার ও ধরনে বদল ঘটে।

“এরকম কোনও সুনিশ্চিত প্রমাণ নেই যে বাংলাদেশের সঙ্গে জল বণ্টন করার জন্য পশ্চিমবঙ্গে নদীটির গতিপথের আকার ও ধরনে পরিবর্তন হয়েছে,” জানিয়েছেন মি. পাটিল।

প্রশ্নকর্তা, তৃণমূল কংগ্রেসের সংসদ সদস্য ঋতব্রত ব্যানার্জী  বলছিলেন, “একদিকে তারা বলছে যে বাংলাদেশের সঙ্গে জলবণ্টনের কারণে গতিপথের আকার ও ধরনে বদল ঘটেছে বলে কোনও সুনিশ্চিত প্রমাণ নেই, অন্যদিকে আমারই তোলা একটি পৃথক প্রশ্নের উত্তরে তারা বলছে যে ফারাক্কার ভাটি এলাকায় বিশেষত শুষ্ক মৌসুমে উজান থেকে মিষ্টি জলের প্রবাহ কম থাকার ফলে সুন্দরবনের ভারতীয় অংশের ওপরে প্রভাব পড়ছে। দুটি উত্তরে তারা দুরকম কথা বলছে।”

“তবে আমি তো বিশেষজ্ঞ নই, তাই এর সমাধান কী আমি বলতে পারব না – সেটা বিশেষজ্ঞরা আর সরকার ঠিক করবে। তবে রাজনীতির মানুষ হিসাবে নদী-ভাঙ্গনে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের চোখের জল আমি দেখেছি,” বলছিলেন মি. ব্যানার্জী।সেই ক্ষতির মুখে প্রায় প্রতিবছরের মতোই এবারের বর্ষাতে আবারও পড়েছেন পশ্চিমবঙ্গের মালদা জেলার মানুষ।গঙ্গা ভাঙ্গন প্রতিরোধ অ্যাকশন নাগরিক কমিটির মুখপাত্র তরিকুল ইসলাম বলছিলেন, “এর আগে ভাঙ্গন হত একেকটা এলাকায়, পরের বছর আবার অন্য এলাকা ভাঙ্গত। কিন্তু এবছর দেখছি গঙ্গা তীরবর্তী মালদা আর মুর্শিদাবাদ জেলার সব এলাকাতেই নদী ভাঙ্গছে।”

‘তিনি বলেন ‘ফারাক্কা তৈরি হওয়ার আগে থেকেই কপিল ভট্টাচার্যের মতো প্রযুক্তিবিদরা যেমন বলেছেন, তেমনই আমরা স্থানীয়রাও দাবি তুলেছিলাম যে এই ব্যারাজ হলে নদী ভাঙ্গন হবেই। সেই প্রমাণ তো গত পঞ্চাশ-ষাট বছর ধরে আমরা দেখে আসছি।”

“এবছর যে অবস্থা দেখছি, তাতে আবারও আমরা তিনটে দাবি তুলছি – ভাঙ্গন রুখতে কেন্দ্রীয় সরকারকে স্থায়ী পদক্ষেপ নিতে হবে আর যাদের বাড়ি-ঘর ভাঙ্গছে, তাদের পুনর্বাসন আর ক্ষতিপূরণ দিতে হবে রাজ্য সরকারকে,” বলছিলেন তরিকুল ইসলাম।

 

সর্বশেষ  গুরুত্বপূর্ণ  সব  সংবাদ, ছবি ,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও লেখা পেতে আমাদের  ফেসবুক পেইজে  লাইক  দিয়ে  অ্যাকটিভ  থাকুন।  ভিজিট করুন : http://www.etihad.news

অনলাইন  নিউজ পোর্টাল  ইত্তেহাদ নিউজে  লিখতে  পারেন  আপনিও। লেখার বিষয়  ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন  [email protected] ঠিকানায় ।

সংবাদটি শেয়ার করুন....
ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক :

ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক :

About Author

etihad news is one of the famous Bangla news portals published from Abudhabi-UAE. It has begun with a commitment to fearless, investigative, informative, and independent journalism. This online portal has started to provide real-time news updates with maximum use of Smart Technology.