চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে গ্রামবাসীর সংঘর্ষ:জোবরা গ্রাম পুরুষশূন্য,নারীরা পালটা হামলার ভয়ে শঙ্কিত


ইত্তেহাদ নিউজ,চট্টগ্রাম : চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে গ্রামবাসীর সংঘর্ষের ঘটনায় সহস্রাধিক ব্যক্তিকে আসামি করে থানায় মামলা করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। মামলায় সুনির্দিষ্ট ৯৮ জন এবং অজ্ঞাতনামা ৮০০ থেকে ১ হাজার জনকে আসামি করা হয়েছে। এছাড়া ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে লুণ্ঠিত ১৩০ অস্ত্র জমা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এ ঘটনায় একটি জিডিও করা হয়েছে।
এদিকে মামলা দায়েরের খবর শোনার পর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সংলগ্ন জোবরা গ্রাম পুরুষশূন্য হয়ে পড়েছে। নারীরা পালটা হামলার ভয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন।
যদিও হাটহাজারী উপজেলা প্রশাসন বলেছে, নিরপরাধ সাধারণ বাসিন্দাদের আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। শিক্ষার্থী ও গ্রামবাসী সবাইকে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পরামর্শ দিয়েছেন।
মঙ্গলবার বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা দপ্তরের প্রধান আবদুর রহিম বাদী হয়ে হাটহাজারী থানায় মামলা করেন। এতে ৯৮ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ড. সাইফুল ইসলাম গণমাধ্যমকে মামলা দায়েরের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। এছাড়া নিরাপত্তা দপ্তর থেকে দেশীয় অস্ত্র লুটের ঘটনায় একটি সাধারণ ডায়েরিও করা হয়েছে। ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে লুণ্ঠিত ১৩০ অস্ত্র জমা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
এদিকে মঙ্গলবার জোবরা গ্রামে পরিদর্শনে গিয়ে সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মুহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মুমিন।
মামলা দায়ের প্রসঙ্গে চবির অধ্যাপক ড. সাইফুল ইসলাম বলেন, আমাদের শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে হাটহাজারী থানায় মামলা দায়ের করা হয়েছে। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা দফতরের প্রধান এই মামলার বাদী হয়েছেন। এছাড়া নিরাপত্তা দফতর থেকে দেশীয় অস্ত্র লুটপাটের ঘটনায় একটি সাধারণ ডায়েরি করা হয়েছে।
মামলার এজাহারে বলা হয়, ৩০ আগস্ট রাত অনুমান সাড়ে ১১টার দিকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সাফিয়া খাতুন (২৩) জোবরা গ্রামে তার ভাড়া বাসায় প্রবেশ করতে গেলে বাসার গেট খোলাকে কেন্দ্র করে দারোয়ানের সঙ্গে কথা কাটাকাটি হয়। এ নিয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মতবিরোধ তৈরির একপর্যায়ে জোবরা গ্রামবাসী পরস্পর যোগসাজশে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করে।
পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য, প্রক্টর, নিরাপত্তা কর্মকর্তারা ঘটনার মীমাংসা করতে গেলে তাদের ওপরও হামলা করা হয়। তাদের ব্যবহৃত নোহা মাইক্রোবাস, মোটরসাইকেল, পুলিশের গাড়ি ভাঙচুর করে ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে।
এর ধারাবাহিকতায় ৩১ আগস্ট সকাল থেকে জোবরা গ্রামবাসী বেআইনি জনতাবদ্ধ হয়ে দা, কিরিচ, রামদাসহ দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এতে অন্তত ৪৫০ জন শিক্ষার্থী আহত হন। পূর্বপরিকল্পিতভাবে তাদের ওপর হামলা ও হত্যার চেষ্টা করা হয় বলে এজাহারে উল্লেখ করেন বাদী।
যে দারোয়ানের সঙ্গে শিক্ষার্থীর কথা কাটাকাটির জের ধরে এত বড় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে মঙ্গলবার ফেসবুক লাইভে এসে ওই দারোয়ান নিজেকে নির্দোষ দাবি করেন। ভয়ে ঘটনার দিন থেকে এলাকা ছাড়া থাকার কথা উল্লেখ করে বলেন, কেবল রাত ১১টার পর বাসায় কেন আসছে এই কথা জিজ্ঞেস করার কারণেই তাকে ওই নারী শিক্ষার্থী থাপ্পড় মেরেছেন। এরপরও তিনি ওই নারী শিক্ষার্থীর গায়ে হাত তোলেননি। এ ঘটনায় প্রতিবেশীরা জড়ো হলে নারী শিক্ষার্থী তার পুরুষ সহকর্মীদের ফোনে ডেকে আনেন। তাকে ধাওয়া করার সময় এলাকাবাসী শিক্ষার্থীদের নিবৃত্ত করার চেষ্টা করলে শিক্ষার্থীরা তাদের ওপর আক্রমণ করেন।
লুণ্ঠিত অস্ত্র জমা দেওয়ার নির্দেশ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা দপ্তর থেকে লুট হওয়া রামদা, দা, রড, ছুরিসহ দেশীয় অস্ত্র ফিরিয়ে দিতে শিক্ষার্থীদের নির্দেশ দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে এসব ফিরিয়ে দেওয়া না হলে লুটের ঘটনায় জড়িত শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ারও হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে। মঙ্গলবার দুপুর ২টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক তানভীর মোহাম্মদ হায়দার আরিফের সই করা এক বিজ্ঞপ্তিতে এ নির্দেশনা জানানো হয়।সংঘর্ষের সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা ভবনের দরজার তালা ভেঙে এসব অস্ত্র লুট করে নিয়েছে শিক্ষার্থীরা।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি) সংলগ্ন জোবরা গ্রাম এখন আতঙ্কে স্তব্ধ। ঘটনার পর থেকেই এলাকার পুরুষদের অনেকেই এলাকা ছেড়ে গেছেন। মঙ্গলবার মামলা দায়েরের খবর শোনার পর আরও অনেকেই ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। এতে জোবরাগ্রাম একপ্রকার পুরুষশূন্য হয়ে পড়েছে।
নারীরা থাকলেও তাদের মধ্যেও আতঙ্ক বিরাজ করছে। রাতের আঁধারে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে প্রতিরোধ করার মতো কাউকে পাওয়া যাবে না- এমন আতঙ্ক ভর করছে নারীদের মধ্যে।
এ অবস্থায় পরিস্থিতি শান্ত করতে মঙ্গলবার জোবরা গ্রাম পরিদর্শন করেন হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ আল মুমিন। তিনি এলাকার উপস্থিত লোকজনের সঙ্গে কথা বলেন। যাদের বাড়িঘর ভাঙচুর করা হয়েছে এমন পরিবারের সদস্যদের সঙ্গেও কথা বলেছেন।
তিনি বলেন, নিরপরাধ কারো ভয় নেই। শান্তিপূর্ণ পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে সবার সহযোগিতা প্রয়োজন। গ্রামবাসী ও শিক্ষার্থীরা যেন মিলেমিশে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করতে পারেন সে লক্ষ্যে প্রশাসন কাজ করছে বলে আশ্বস্ত করেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা।
এ সময় তার সঙ্গে আরও উপস্থিত ছিলেন উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক নূর মোহাম্মদ, ফতেপুর ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান মো. জাকির হোসেন, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মুছা সিদ্দিকী, ২ নম্বর ইউপি সদস্য আব্দুল কাদের, মো. আবুল বশর বাবুল, আনন্দ বিকাশ বড়ুয়া, মো. মোজাহের ও লোকমান চৌধুরী।
ছাত্রদলসহ বিভিন্ন সংগঠনের বিক্ষোভ
এদিকে চবি প্রশাসন শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে ব্যর্থ দাবি করে ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেছে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল চবি শাখা। মঙ্গলবার দুপুর ১২টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বুদ্ধিজীবী চত্বরে এ কর্মসূচি পালন করেন তারা। একই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় জিরো পয়েন্টে দুপুর ১২টায় উপাচার্য এবং প্রক্টরিয়াল বডির পদত্যাগের দাবিসহ আরও চার দফা দাবিতে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র জোট, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের আরও কয়েকটি সংগঠন। এ সময় তারা ব্যর্থতার দায়ে চবি প্রশাসনের পদত্যাগের দাবি করেন।
শাখা ছাত্রদলের সভাপতি আলাউদ্দিন মহসিন বলেন, জুলাই পরবর্তী প্রশাসন শিক্ষার্থীদের তেমন কোনো আকাঙ্ক্ষাই পূরণ করতে পারেনি। আবাসন নিশ্চিত করতে পারেনি, নিরাপদ খাবার নেই। শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা এখন হুমকির মুখে। আমরা এই ব্যর্থ প্রশাসনের পদত্যাগের দাবিতে এখানে অবস্থান নিয়েছি। এ প্রশাসনের অব্যাহতি না হওয়া পর্যন্ত আমরা এ বিক্ষোভ চালিয়ে যাব।
শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চরমভাবে ব্যর্থ হওয়ায় উপাচার্য ও প্রক্টরের পদত্যাগ দাবি করেছে শাখা গণতান্ত্রিক ছাত্র জোট। এ দাবিসহ মোট ৬ দফা দাবি তুলে ধরে সংবাদ সম্মেলন করেছে সংগঠনটি।
মঙ্গলবার বেলা ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ঝুপড়িতে সংবাদ সম্মেলন করে দাবি তুলে ধরে সংগঠনটি। এতে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন গণতান্ত্রিক ছাত্র কাউন্সিলের সংগঠক ধ্রুব বড়ুয়া।
এ সময় উপস্থিত ছিলেন শাখা বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রীর সভাপতি জশদ জাকির, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সাধারণ সম্পাদক সুদর্শন চাকমা, শাখা বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রীর সহ-সাধারণ সম্পাদক উম্মে সাবাহ তাবাসসুম এবং প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক মোশরেফুল হক রাকিব।
তাদের ৬ দফা দাবির মধ্যে রয়েছে- আহত শিক্ষার্থীদের সুচিকিৎসা নিশ্চিতকরণ ও তাদের চিকিৎসার সমস্ত ব্যয়ভার প্রশাসনকে বহন করা, জোবরার স্থানীয় সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে কার্যকর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করে দ্রুত তাদের বিচার নিশ্চিত করা, ক্যাম্পাসের ভেতর ই-কারের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং ক্যাম্পাস থেকে ১নং ও ২নং গেট অবধি চক্রাকার বাস চালু করা। স্থানীয়দের থেকে শিক্ষার্থীদের শতভাগ নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে শতভাগ আবাসনের রোডম্যাপ ঘোষণা ও আবাসন ভাতা ভাতা চালু করা। ১নং ও ২নং গেট এবং ১নং রেলক্রসিং ও ২নং রেলক্রসিংয়ে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ সব সংবাদ, ছবি ,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন। ভিজিট করুন : http://www.etihad.news
* অনলাইন নিউজ পোর্টাল ইত্তেহাদ নিউজে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায় ।