প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা মনপুরা: তাবিজ-কবজ ও ঝাড়-ফুঁকে চলে রোগ-চিকিৎসা


ইত্তেহাদ নিউজ,ভোলা : তিনদিকে মেঘনা ও একদিকে বঙ্গোপসাগর ঘেরা ভোলার বিচ্ছিন্ন দ্বীপ মনপুরা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা। পর্যটক আকর্ষণের সব উপাদান থাকলেও বছরের পর বছর ধরে প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে লড়াই করে দ্বীপের বাসিন্দারা টিকে আছেন। সৌন্দর্যের লীলাভূমি মনপুরার যোগাযোগ ব্যবস্থা খুবই করুণ। সেখান থেকে কেউ সহজেই বেরুতে বা প্রবেশ করতে পারেন না। নৌযাননির্ভর যোগাযোগ ব্যবস্থা পুরোপুরি রুটিনমাফিক এবং প্রকৃতির খেয়ালের বশে চলে। আবহাওয়া খারাপ হলে নৌপথ বন্ধ হয়ে যায়। এখানকার স্বাস্থ্য ব্যবস্থা আরও নাজুক। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থাকলেও জেলা হাসপাতালের ওপর নির্ভর করতে হয়। রোগ-চিকিৎসায় এখানকার বাসিন্দারা এখনো তাবিজ-কবজ ও ঝাড়-ফুঁকের ওপর বিশ্বাস করে। মৎস্য শিকার ও কৃষি কাজ মনপুরার বাসিন্দাদের জীবিকা নির্বাহের পথ হলেও দস্যু বাহিনীর কাছ থেকে তাদের অনুমতি নিতে হয়। হামলার শিকার হওয়াসহ নিয়মিত চাঁদা দিতে হয়। প্রতিবছর প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়েন বাসিন্দারা। ট্রলারডুবিতে অসংখ্য মানুষের প্রাণহানি ঘটে। মনপুরা উপজেলায় অবকাঠামোগত কিছুটা উন্নতি হলে দিনে মাত্র ৪ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকে।
ভোলা জেলায় ৩০০ বছর জেগে উঠা দ্বীপটিতে এক সময় পর্তুগিজ জলদস্যু বাহিনী আস্তানা গড়ে তোলে। দ্বীপটিতে বাঘের থাবায় মনগাজি নামে এক জেলে মারা যাওয়ায় তার নামানুসারে মনপুরা নাম রাখা হয়। ১৯৮৩ সালে দ্বীপকে উপজেলায় রূপান্তর করা হয়। পাঁচটি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত উপজেলায় প্রায় দেড় লাখ মানুষের বসবাস। এখানে তিনটি কলেজ, ১০টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ছয়টি আলিয়া মাদ্রাসা ও ৪৭টি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। উপজেলা প্রশাসনের প্রশাসনিক ভবন, হাসপাতাল ও থানার ভবনসহ বিভিন্ন দাপ্তরিক ভবন, সোনালী ও কৃষি ব্যাংক রয়েছে।
এ দ্বীপের একমাত্র যোগাযোগ মাধ্যম নৌপথ। রুটিনমাফিক ও প্রকৃতির ওপর নির্ভর করে নৌযান চলাচল করে। সকাল ১০টায় মনপুরা থেকে তজুমুদ্দিন এবং বেলা ৩টায় তজুমুদ্দিন থেকে মনপুরা রুটে চলে সি ট্রাক। এছাড়া ঢাকা-মনপুরা-হাতিয়া রুটে চলে এমভি ফারহান ও এমভি তাসরিফ লঞ্চ। বেলা ২টায় মনপুরা থেকে এবং বিকাল সাড়ে ৫টায় ঢাকা থেকে লঞ্চ চলে। আবার আবহাওয়া একটু খারাপ হলেই সব বন্ধ হয়ে যায়। তখন পুরো দেশ থেকে দ্বীপটি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এ সময় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দ্বীপের বাসিন্দারা মাছ ধরার ছোট ছোট ট্রলারে যাতায়াত করেন। এছাড়া সপ্তাহে ২ দিন ট্রলারে বাসিন্দারা হাতিয়া, চরফ্যাশন ও লালমোহনে যাতায়াত করেন।
আধুনিকমানের ৫০ শয্যার হাসপাতাল থাকলেও দ্বীপবাসী এর সুফল পান না। চিকিৎসক, নার্স ও টেকনিশিয়ানের অভাবে তারা চিকিৎসা বঞ্চিত হন। বছরজুড়ে এক বা দুজন চিকৎসক সেবা দিয়ে থাকেন। ল্যাব না থাকায় রোগ নির্ণয় করতে না পেরে চিকিৎসকরা জেলা হাসপাতালে রোগীদের পাঠিয়ে দেন। উত্তাল মেঘনা পাড়ি দিতে গিয়ে অনেক সময় রোগীরা দুর্যোগে পড়েন। এছাড়া এখানকার বাসিন্দারা এখনও তাবিজ-কবচ ও ঝাড়-ফুঁকের ওপর নির্ভর করেন। চরাঞ্চলে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অবস্থা আরও নাজুক।
জেনারেটর দিয়ে শুধু উপজেলা সদরে দিনে ৪ ঘণ্টা বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়। বাকি সময় বিদ্যুৎবঞ্চিত দ্বীপের বাসিন্দারা। বিদ্যুতের অভাবে কল-কারখানাও স্থাপন হয়নি। উপজেলার বাহিরে বাসিন্দারা সোলার প্যানেলের মাধ্যমে বিদ্যুৎ পাচ্ছেন। তবে আবহাওয়া খারাপ হলে দুই থেকে তিন দিন বাতি জ্বলে না। দ্বীপে ছয় মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন মিনি সোলার গ্রিড রয়েছে।
বছরের পর বছর ধরে প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে লড়াই করে দ্বীপের বাসিন্দারা বেঁচে আছেন। ১৯৭০ সালে ঘূর্ণিঝড় গোর্কির আাঘাতে দ্বীপের অধিকাংশ মানুষের মৃত্যু হয়। প্রায় প্রতিবছর প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। পর্যাপ্ত আশ্রয়কেন্দ্র গড়ে না ওঠায় বাসিন্দাদের মৃত্যুর মুখোমুখি হতে হয়।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা মনপুরা দ্বীপে হরিণ ও বানরের দেখা মেলে। এ দ্বীপ থেকে একই সঙ্গে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখতে পাওয়া যায়। প্রতিবছর হরিণ ও সি-বিচ দেখতে দেশি-বিদেশি পর্যটক আসেন। তবে থাকা ও খাওয়ার সমস্যায় পর্যটক আসা কমে গেছে।
এ দ্বীপের বাসিন্দাদের একমাত্র জীবিকা হলো মৎস্য শিকার ও কৃষি কাজ। এ দুই কাজে তাদের দস্যু বাহিনীকে চাঁদা দিতে হয়। চাঁদা না দিলে হামলার শিকার এবং এমনকি অপহরণের শিকার হতে হয়। মেঘনায় মাছ শিকার করতে গেলে দস্যু বাহিনীর অনুমতি নিতে হয়। তাদের কাছ থেকে অনুমতির টোকেন নিতে হয়। টোকেন না থাকলে হামলা করে দস্যুরা জাল, মাছ সব লুটে নেয়। এমনকি অপহরণ করে হাতিয়ার গহিন বনে নিয়ে যায়। পরে বিকাশ ও নগদের মাধ্যমে মুক্তিপণ দিলে ছাড়া মেলে। চরাঞ্চলে চাষাবাদ করতে হলে দস্যু বাহিনীকে দাগপ্রতি এক মন ধান দিতে হয়। কথামতো ধান না দিলে অপহরণের শিকার হতে হয়।
জলদস্যুদের ব্যাপারে মনপুরা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আহসান কবির জানান, হামলার বিষয়ে জেলে বা মৎস্য আড়তদাররা থানায় জানান না। জানতে পারলে অভিযান চালানো হবে। মনপুরা বিদ্যুৎ, পর্যটন ও যাতায়াত ব্যবস্থা নিয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফজলে রাব্বি জানান, নিরাপদ যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। দ্বীপকে বিদ্যুতের আওতায় আনতে মিনি গ্রিড স্থাপনের কাজ চলমান রয়েছে। এছাড়া সাবমেরিনের মাধ্যমে বিদ্যুৎ আনার ব্যবস্থা করতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে। স্বাস্থ্যসেবা ব্যাপারেও ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ সব সংবাদ, ছবি ,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন। ভিজিট করুন : http://www.etihad.news
* অনলাইন নিউজ পোর্টাল ইত্তেহাদ নিউজে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায় ।