বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের বিমানবালা মৌরি-শিমুর হানিট্র্যাপের ফাঁদে দুই যুবক


ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক : খাদিজা সুলতানা শিমু (৫৩৪২৯) ও এমএসটি মৌরি (৫৩৪৩৭)। পেশায় কেবিন ক্রু। চাকরি করেন জাতীয় পতাকাবাহী প্রতিষ্ঠান বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সে। দু’জনই ২০২৩ সালে ৪৬তম ব্যাচে নিয়োগ পেয়েছেন বিমানে। একসঙ্গে চাকরির সুবাদে তারা ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে যান। অধিকাংশ সময়ই তারা বিমানের একই গন্তব্যে ডিউটি করতেন। এতে করে তাদের সখ্য আরও বেড়ে যায়। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রামে আবেদনময়ী ছবি আপলোড করেন। ফেসবুকে বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গির রিলসও পোস্ট করেন দু’জন। এসব সম্পর্কের বাইরেও তাদের আরেকটি জায়গায় মিল রয়েছে। সম্প্রতি তাদের দু’জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে হানিট্র্যাপের ফাঁদে ফেলে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে দুই ব্যক্তির কাছ থেকে নগদ অর্থ ও উপহার হাতিয়ে নেয়ার। টাকা হাতিয়ে নেয়ার পর তাদের সঙ্গে যোগাযোগ ও সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করে দেন তারা। শিমু দেশীয় একটি বেসরকারি এয়ারলাইন্সের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা ও মৌরি কাতারস্থ প্রবাসী এক বাংলাদেশির সঙ্গে মিথ্যা প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তুলে প্রতারণা করেছেন। দুই বান্ধবীর হানিট্রাপের ফাঁদে ফেলে নিঃস্ব হয়েছেন ওই দুই প্রেমিক। উপায়ন্তর না পেয়ে শিমুর প্রেমিক আদালতে মামলা করেছেন। মামলাটির তদন্ত করছে উত্তরা পশ্চিম থানা পুলিশ। বিমানের প্রধান কার্যালয়েও অভিযোগ দিয়েছেন ভুক্তভোগী। আর মৌরির প্রেমিক কোনো মামলা করেননি। তিনি শুধু বিমানের প্রধান কার্যালয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, সিভিল এভিয়েশনের চেয়ারম্যানের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। দুই ভুক্তভোগী এসব অভিযোগের সঙ্গে কখন, কীভাবে প্রতারণা, নগদ অর্থ ও বিভিন্ন অজুহাতে উপহার হাতিয়ে নেয়া হয়েছে এসবের তথ্য প্রমাণ দিয়েছেন। বিমানের বলাকা অফিসে আসা দুটি অভিযোগের তদন্ত করছে বিমান। আর শিমুর বিরুদ্ধে আদালতে করা মামলারও তদন্ত চলছে। এসব অভিযোগের তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন- প্রাথমিকভাবে দুই বিমানবালার বিরুদ্ধে আসা অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে। যারা অভিযোগ দিয়েছেন তাদের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক ছিল। সম্পর্ক চলাকালীন তারা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সুবিধা নিয়েছেন। যদিও নিজেদের বিরুদ্ধে অভিযোগ অস্বীকার করেছেন কেবিন ক্রুরা।
মৌরির বিরুদ্ধে যে অভিযোগ: গত ২১শে আগস্ট বিমানের কেবিন ক্রু মৌরির বিরুদ্ধে অভিযোগে কাতার প্রবাসী বাংলাদেশি ব্যবসায়ী বলেছেন, বাংলাদেশে ব্যবসা থাকার সুবাদে প্রতিনিয়ত বিমানে যাতায়াত করি এবং আমি বিমানের একজন নিয়মিত কাস্টমার। ২০২৪ সালের ১০ই অক্টোবর কাতারের একটি হোটেলে মৌরি নিজেকে বিমানের কেবিন ক্রু হিসেবে পরিচয় দিয়ে আমার সঙ্গে পরিচিত হোন। তখন আমার সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থান দেখে কমিটেড রিলেশনে যেতে ইচ্ছা প্রকাশ করেন। ১৬ই অক্টোবর মৌরি আবার কাতারে এসে আমাকে ফোন করে হোটেল লবিতে ডেকে প্রেমের প্রস্তাব দেন। আমি তাকে সরাসরি বলি যে আমি বিয়ের জন্য পাত্রী চাই। কিন্তু চাকরিজীবী কাউকে নয়। সে আমার শর্তে রাজি হয় এবং বিয়ের পর চাকরি ছেড়ে দিবে বলে আশ্বস্ত করেন। আমি তাতে সাড়া দেই। পরদিন তাকে নিয়ে আমি লং ড্রাইভে নিয়ে বিচে যাই। ১৬ থেকে ২০শে অক্টোবর মৌরি লে ওভারে আমার সঙ্গেই ছিল। এ সময় সে আমার কাছে শপিং করে দিতে আবদার করে। তার ইচ্ছাতেই আমি তাকে শপিং করে দেই। ১৪ই ডিসেম্বর আমি লন্ডনে যাই একটি বিজনেস ট্রিপে। তখন মৌরি বিমানের সিডিউল ইনচার্জদের ম্যানেজ করে লন্ডনে যায়। ব্যবসায়িক কাজে যাওয়াতে ওখানে আমার ব্যস্ততা ছিল। কিন্তু সে তার কলিগসহ ঘুরতে এবং শপিং করিয়ে দিতে জোর করে আমাকে।
অভিযোগে ওই ব্যবসায়ী বলেন, ৩০শে ডিসেম্বর আমি বিজনেস মিটিংয়ে ঢাকায় আসি। ৫ই জানুয়ারি ফ্লাইট থেকে ফিরে আমার জন্মদিন পালন করে গুলশান ক্যাপিটাল ক্লাবে। তার সহকর্মী শিমুর বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে সিলেটে যাওয়া ও আমাকে কক্সবাজারে নিয়ে যেতে বলে। আমি ব্যস্ততা থাকায় অপারগতা প্রকাশ করি। চলতি বছরের ১৪ই ফেব্রুয়ারি মৌরি তার আরেক বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে হোটেল সেরিনায় সময় কাটানোর খবর জানার পর আমার সঙ্গে তার দূরত্ব তৈরি হয়। তারপর থেকে মৌরি আমাকে মানসিকভাবে উত্তেজিত করে আমার কথা রেকর্ড করে রাখতো। মার্চের শেষ দিকে মৌরি কাতার প্রবাসী গাড়ির গ্যারেজের মালিকের সঙ্গে সম্পর্কে জড়ায়। ওই ব্যবসায়ীর সঙ্গে হোটেল রুমে দেখাও করেছেন। এপ্রিল মাসেও কাতার গিয়ে ওই ব্যবসায়ীর সঙ্গে দেখা করেন। মে মাসেও না জানিয়ে দোহা এসে কায়সারের সঙ্গে সময় কাটান। গত জুন মাসে মৌরি তার জন্মদিনের গিফট হিসেবে পিংক কালারের আইফোন ১৬ কিনে দিতে বলে। তখন আমি কাতার থেকে আইফোন কিনে ঢাকায় পাঠাই। ২৫শে জুলাই আমি জার্মানিতে যাই। এ খবর জেনে মৌরি সিডিউল ইনচার্জকে দিয়ে তার সহকর্মী শিমুসহ ২৫শে জুলাই রাতে কাতারে যায়। তখন আমার গাড়িচালক বিমানের নির্ধারিত হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। তিনি দেখেন- মৌরি ও শিমুকে হোটেলের সামনে থেকে পিকআপ করেন। তারা রাতে নাইট ক্লাবে কাটিয়ে ভোরে হোটেলে ফিরেন। ৬ই আগস্ট কাতার এসে আমাকে না জানিয়ে কায়সারের সঙ্গে সময় কাটায়। লিখিত অভিযোগে ওই ব্যবসায়ী আরও বলেন, ৭ই আগস্ট মৌরির সঙ্গে আমার দেখা হয়। তখন মৌরি তার আসল মতামত জানিয়ে বলে আমি একজনের সঙ্গে ২ মাসের বেশি রিলেশনে থাকি না। এ সময় আরও কিছু আপত্তিকর কথা বলে আমাকে ব্লক করে দেয়। তার বিরুদ্ধে বিমানে লিখিত অভিযোগ দেয়ায় রাইয়ানকে দিয়ে প্রতিনিয়ত আমাকে হুমকি দিচ্ছে বলেও অভিযোগে জানান।
শিমুর বিরুদ্ধে যে অভিযোগ: বিমানবালা খাদিজা সুলতানা শিমুর বিরুদ্ধে বিয়ের প্রলোভন, ‘হানিট্র্যাপ’ ও ব্ল্যাকমেইলের মাধ্যমে প্রায় ২২ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে গত ২০শে জুলাই ঢাকার আদালতে মামলা দায়ের করেছেন দেশের একটি বেসরকারি এয়ারলাইন্সের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। তিনি একজন এয়ারক্রাফট মেইনটেন্যান্স ইঞ্জিনিয়ার। তার সঙ্গে ফেসবুকে পরিচয় হওয়ার পর ১১ মাসের সম্পর্কে এই বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নেয়া হয় বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে। বাদীপক্ষের উপস্থাপিত অর্থ লেনদেনের বিস্তারিত প্রমাণপত্র দেখে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত বিস্ময় প্রকাশ করেন। আদালত অভিযোগটি আমলে নিয়ে উত্তরা পশ্চিম থানাকে মামলাটি তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দিয়েছেন। ওই সিআর মামলার এজাহারে বলা হয়, ২০২৪ সালে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে কেবিন ক্রু শিমুর সঙ্গে পরিচয় হয়। পরিচয়ের পর তাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে এবং তারা উত্তরার একটি রেস্টুরেন্টে প্রথমবার দেখা করেন। বাদীর উন্নত পেশা ও সামাজিক অবস্থানকে পুঁজি করে শিমু অল্প সময়ের মধ্যেই তার বিশ্বাস অর্জন করেন। তিনি বাদীর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গেও সুসম্পর্ক গড়ে তোলেন এবং নিজেকে ভবিষ্যত পুত্রবধূ হিসেবে উপস্থাপন করেন। সম্পর্ক গভীর হওয়ার পর শিমু বাদীকে বিয়ের আশ্বাস দেন। এই প্রতিশ্রুতির ওপর ভিত্তি করে তিনি বিভিন্ন সময়ে ও অজুহাতে বাদীর কাছ থেকে অর্থ আদায় করতে থাকেন। নগদ টাকা, ব্যাংক ট্রান্সফার, মোবাইল ব্যাংকিং, ঘর সাজানোর ফার্নিচার, মোবাইল, কসমেটিকস, শপিংয়ের বিল পরিশোধের মাধ্যমে ধাপে ধাপে এই অর্থগ্রহণ করা হয়। সব শেষ গত বছরের ২৫শে সেপ্টেম্বর নিজের জন্মদিনে শিমু বাদীর কাছ থেকে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা মূল্যের একটি হীরার আংটি উপহার হিসেবে নেন।
পরবর্তীতে শিমু প্রস্তাব দেন তাদের বিয়ের সম্পূর্ণ খরচ বাদীকে বহন করতে হবে এবং সেই অর্থ অনুষ্ঠানের আগেই পরিশোধ করতে হবে। তার কথায় বিশ্বাস করে বাদী বিয়ের খরচ বাবদ মোট ১৬ লাখ ২৪ হাজার ৫১১ টাকা প্রদান করেন। এর বাইরে আরও ৪ লাখ টাকা নগদ নেন তিনি। হীরার আংটিসহ সর্বমোট আত্মসাতকৃত অর্থের পরিমাণ দাঁড়ায় ২১ লাখ ৭৪ হাজার ৫১১ টাকা। ওই টাকা হাতে পাওয়ার পর শিমুর আচরণে পরিবর্তন আসতে শুরু করে। একপর্যায়ে তিনি বিয়ে করতে সরাসরি অস্বীকৃতি জানান। এজাহারে আরও বলা হয়, শিমু ও তার মা নতুন করে দাবি করেন যে, অতিরিক্ত ১০ ভরি স্বর্ণালংকার ও আরও অর্থ না দিলে এই বিয়ে সম্ভব নয়। সম্পর্কের বিভিন্ন পর্যায়ে শিমু হোয়াটসঅ্যাপ ও মেসেঞ্জারে বাদীর কাছে আপত্তিকর ছবি ও ভিডিও চাইতেন। পরবর্তীতে সেই ব্যক্তিগত ছবি ও ভিডিও ব্যবহার করে তাকে ব্ল্যাকমেইল করার চেষ্টা করা হয়। এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে, বিমানবালা শিমু অর্থ আদায়ের জন্য আধুনিক ‘হানিট্র্যাপ’ ও ‘থার্স্টট্র্যাপ’ (যৌন আবেদনময়ী ছবি/ভিডিও দিয়ে মনোযোগ আকর্ষণ) কৌশল ব্যবহার করতেন। তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আকর্ষণীয় ছবি ও ভিডিও পোস্ট করে এবং ব্যক্তিগত আলাপে আবেদনময়ী আচরণ করে ভুক্তভোগীকে আকৃষ্ট করেন এবং বিয়ের ফাঁদে ফেলে অর্থ আদায় করেন। প্রতারণার শিকার হওয়ার পর বাদী প্রথমে পারিবারিকভাবে বিষয়টি সমাধানের চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। এরপর তিনি ব্যাংক স্টেটমেন্ট, অর্থ লেনদেনের রসিদ এবং সাক্ষীদের প্রমাণসহ আদালতে মামলা দায়ের করেন।
ভুক্তভোগী ওই কর্মকর্তা বলেন, সে আমার সঙ্গে এমনভাবে প্রেমের সম্পর্ক ও আমার পরিবারের সঙ্গে মেলামেশা করেছে কখনো বুঝিনি এমন করবে। বিয়ের সব কথাবার্তা হয়েছিল। কিন্তু তার মনে অন্য উদ্দেশ্য ছিল সেটা জানতাম না। আত্মীয়স্বজন ও কাছের সব মানুষ জানতো তার আমার বিষয়ে। শুধু অর্থনৈতিকভাবে নয়, সামাজিক-মানসিক সবভাবে আমি ক্ষতিগ্রস্ত।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে খাদিজা সুলতানা শিমুর সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তিনি এই প্রতিবেদকের কাছ থেকে অভিযোগ শুনে লাইন কেটে দেন। পরে আরও কয়েকবার ফোন করলে তিনি কেটে দিয়ে মোবাইল বন্ধ করে দেন।
আর কেবিন ক্রু মৌরি ওই ব্যবসায়ীর সঙ্গে পরিচয়ের সত্যতা স্বীকার করে বলেন, এরপর থেকে তিনি আমাকে বিভিন্নভাবে হ্যারাজ করেছেন। এ ধরনের অনেক প্রমাণ আমার কাছে আছে। এ ছাড়া আমি তার কাছ থেকে কিছুই নেইনি। এসব নিয়ে আমি অনেক ঝামেলায় আছি। এসব ভিত্তিহীন। বানোয়াট। শিমুর মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও উত্তরা পশ্চিম থানার এসআই তানভির আলম বলেন, প্রাথমিকভাবে তাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্কের সত্যতা মিলেছে। এখনো সার্বিক বিষয়ে তদন্ত চলছে।
বিমানের মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) এ বি এম রওশন কবির বলেন, আমরা মৌরির বিষয়ে অভিযোগ পেয়েছি। তার অভিযোগের প্রাথমিক তদন্তের কাজ করছে ফ্লাইট সার্ভিস বিভাগ। অভিযোগের ভিত্তি থাকলে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্ত হবে। আর শিমুর বিষয়ে বিমানে কোনো অভিযোগ আসেনি। জেনেছি, তার বিরুদ্ধে আদালতে মামলা হয়েছে।
সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ সব সংবাদ, ছবি ,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন। ভিজিট করুন : http://www.etihad.news
* অনলাইন নিউজ পোর্টাল ইত্তেহাদ নিউজে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায় ।