ইত্তেহাদ নিউজ,অনলাইন : তরুণদের নজিরবিহীন আন্দোলনে ছিন্নভিন্ন নেপালের মসনদ। প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রীরা পদত্যাগ করেছেন। কেউ কেউ পালিয়েছেন। যারা পালাতে পারেননি তাদের তাড়া করে মারপিট করেছে আন্দোলনকারীরা। দুইদিনের বড় আন্দোলনের পর কার্যত সরকারবিহীন অবস্থায় হিমালয় কন্যা। সেনাবাহিনীর হাতে দায়িত্ব হস্তান্তর করেছেন প্রেসিডেন্ট। অব্যাহত সহিংসতার জেরে বন্ধ হয়েছে বিমানবন্দর। সংসদ ভবন, প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে মন্ত্রীদের বাড়ি। আগের দিনের সহিংস বিক্ষোভ ও প্রাণহানির জেরে মঙ্গলবার সকাল থেকেই অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠে কাঠমান্ডুসহ আশপাশের শহর ও জনপদ। কারফিউ উপেক্ষা করে তরুণ ও সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ শুরু করেন। একের পর এক সরকারি ভবন ও দপ্তর দখল করে তারা অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর চালান। মন্ত্রীদের বাড়ি খুঁজে খুঁজে আগুন দেয়া হয়। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে দুপুরে প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলি পদত্যাগের ঘোষণা দেন। এরপরই তরুণদের বিক্ষোভ নতুন মাত্রা পায়। সাধারণ মানুষও রাস্তায় নেমে আসেন। জেন-জিদের দখলে চলে যায় পুরো নেপাল।
সোমবার পদত্যাগ করা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রমেশ লেখকের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। অর্থমন্ত্রী বিষ্ণু প্রসাদ পাওডেলকে মারধর করে গুরুতর আহত করেন বিক্ষোভকারীরা। এমনকি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শের বাহাদুর দেউবার বাড়িতেও হামলা হয়েছে। যেখানে দেউবা ও তার স্ত্রী আরজু রানা দেউবা শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হয়েছেন বলে খবর পাওয়া গেছে। এ ছাড়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী ঝালানাত খানালের বাড়িতে আগুন দিয়ে দেয় তরুণ বিক্ষোভকারীরা। যেখানে তার স্ত্রী আটকা পড়েন এবং পুড়ে মারা যান। বিশ্লেষকরা বলছেন, যেন ২০২৪ সালের আগস্টের ঢাকার চিত্রের পুনরাবৃত্তি ঘটালেন নেপালের তরুণরা। কেপি শর্মার পদত্যাগের চিত্র যেন পতিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের অভিন্ন রূপ। দুইজনেরই শেষ ভরসা ছিল সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টার। যদিও কেপি শর্মা দেশ ত্যাগ করতে পারেননি। তরুণদের বিক্ষোভ দমনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কঠোর হওয়ার নির্দেশ দেন কেপি শর্মা নিজেই। গত বছরের আগস্টে বাংলাদেশেও ছিল একই চিত্র। এখানে শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি চালানোর নির্দেশ দেন শেখ হাসিনা।
মঙ্গলবার দুপুরে আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখন আকস্মিকভাবে নেপালের প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের খবর আসে। এতে উল্লাসে রাজধানীর সড়কে নেমে আসে দেশটির সাধারণ জনতা। দখলে নেয় প্রধানমন্ত্রী, প্রেসিডেন্ট ও মন্ত্রীদের বাসভবন। এসময় শহরের নিয়ন্ত্রণ চলে যায় বিক্ষোভকারীদের হাতে। লুটপাট, ভাঙচুর করে মন্ত্রীদের বসতবাড়িগুলোতে আগুন ধরিয়ে দেয় তারা। অবশ্য এটা জনতার দীর্ঘ ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। লাগামহীন দুর্নীতি ও তরুণদের কণ্ঠরোধ করতে ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ ও এক্সসহ ২৬টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধ করে দেয় সরকার। যার প্রতিবাদেই এই বিক্ষোভের ডাক দেয় দেশটির তরুণ প্রজন্ম। সোমবার শুরু হওয়া এই বিক্ষোভ মুহূর্তের মধ্যেই বৃহৎ আন্দোলনে রূপ নেয়। যা অল্প সময়ের মধ্যে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। আন্দোলনের প্রথম দিনই পুলিশের গুলিতে ২০ জন নিহত হন। এতে আন্দোলন আরও তীব্র হয়ে ওঠে। দ্বিতীয় দিনের শুরুতে পদত্যাগ করেন দেশটির কৃষিমন্ত্রী। এর আগে পদত্যাগ করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রমেশ লেখক। দুপুরে প্রধানমন্ত্রী কেপি অলির পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেন দেশটির প্রেসিডেন্ট রামচন্দ্র পাউডেল। আপদকালীন সময়ে সেনাবাহিনীর কাছে দেশের দায়িত্ব তুলে দেন তিনি।
জনসাধারণকে শান্ত থাকার নির্দেশ দিয়েছে দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়। নেপাল সরকারের মুখ্য সচিব একনারায়ণ আরিয়াল নেপালি সেনাবাহিনীর প্রধান গোকর্ণমণি দুওয়াদির বরাত দিয়ে এক বিবৃতিতে প্রাণ হারানো পরিবারের প্রতি আন্তরিক সমবেদনা এবং আহতদের দ্রুত চিকিৎসার তাগিদ দেন। জনগণকে শান্ত দেখার আহ্বান জানিয়েছেন কাঠমান্ডু সিটির মেয়র বলেন্দ্র শাহ। কাঠমান্ডুর জনগণের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, সরকারের পদত্যাগ ইতিমধ্যেই নিশ্চিত হয়েছে। প্রিয় জেন-জি আপনার দাবি পূরণ করা হয়েছে। এখন সংযত থাকার সময়। দেশের সম্পদের ক্ষতি বাস্তবে আমাদের নিজস্ব সম্পত্তির ক্ষতি। এখন আমাদের সকলের সংযম বজায় রাখা অপরিহার্য। শাহ নেপালের ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব গঠনে তরুণ প্রজন্মের দায়িত্ব তুলে ধরেন এবং গঠনমূলকভাবে জড়িত থাকার জন্য তাদের প্রস্তুত থাকার আহ্বান জানান। তিনি সেনাবাহিনী প্রধানের সঙ্গে আলোচনার সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করে বলেন, মনে রাখবেন-সংসদ ভেঙে দেয়ার পরেই এ ধরনের সংলাপ হওয়া উচিত।
তবে এসব দাবি নেপালি জনগণকে ঘরে আটকে রাখতে পারেনি। সরকারের পদত্যাগে উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ে গোটা নেপাল। আনন্দ মিছিল করতে থাকেন জেন-জিরা। আক্রান্ত হতে শুরু করে মন্ত্রীদের বাড়িঘর। সেখানে লুটপাট চালানোর পর দেয়া হয় আগুন। বাদ যায়নি থানাও। সন্ধ্যায়ও থামেলের আশপাশের অনেক থানাতে আগুন জ্বলতে দেখা গেছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় সৌরকুট থানায়। পর্যটক অধ্যুষিত থামেলের নিকটবর্তী এই থানার পুলিশ সকালে জেন-জিদের কাছে আত্মসমর্পণ করে থানা ছেড়ে চলে যান। পরে বিক্ষুব্ধ জনতা থানা ভাঙচুর করে যানবাহনে আগুন লাগিয়ে দেয়। এতে প্রায় অর্ধশতাধিক পুলিশের গাড়ি পুড়ে যায়।
এর আগে সকালে সরকার পতনের দাবিতে কাঠমান্ডুর বাণেশ্বর, নকশাল, ভক্তপুর, ললিতপুরে রাস্তায় ব্যারিকেড দেয় স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা। আতঙ্কে সকল দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়। সকাল থেকে দফায় দফায় সভা করেছে কেপি শর্মা ওলির সরকার। স্থানীয়রা বলেছেন, যেকোনো মুহূর্তে পদত্যাগ করতে পারেন। এর আগে সোমবার সকালে রাজধানী কাঠমান্ডুর বাণেশ্বর এলাকায় প্রথম বিক্ষোভ শুরু হয়। অল্প সময়ের মধ্যে কাঠমান্ডুর সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। বিক্ষোভ দমনে দেশটির পুলিশ বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে রাবার বুলেট, টিয়ার গ্যাস এবং জলকামান নিক্ষেপ করে। পার্লামেন্ট ভবনে ঢোকার সময়ে পুলিশের গুলিতে আটজন নিহত হন। পরে সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ২০ জনে। তবে মঙ্গলবার পুলিশকে তেমন হার্ড লাইনে দেখা যায়নি। থামেলের মুসলিম টোল এলাকাতে সরজমিন গিয়ে দেখা গেছে রাস্তায় টায়ায় জ্বালিয়ে আন্দোলন করছেন শিক্ষার্থীরা। স্থানীয়রা তাদের বাড়ি থেকে পুরনো কাঠ, চেয়ার দিয়ে বিক্ষোভকারীদের রাস্তায় আগুন জ্বালাতে সহায়তা করছেন। অনেককে পানিসহ শুকনো খাবার দিচ্ছেন। থেমে থেমে আন্দোলনকারীদের জল কামান ও গরম পানি নিক্ষেপ করে ছত্রভঙ্গ করে দিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ওলি সরকার মুর্দাবাদ, জেন-জি জিন্দাবাদ, মন্ত্রীরা চোর, প্রচণ্ড চোর ইত্যাদি স্লোগান দিয়েছেন বিক্ষোভকারীরা।
কাঠমান্ডুর সিনিয়র সাংবাদিক প্রজ্জল অলি জানান, খুব ভোর থেকে কাঠমান্ডুর অলিগলিতে অবস্থান নেয় বিক্ষোভকারীরা। তাদের বিক্ষোভের মুখে পুরো কাঠমান্ডুতে কারফিউ জারি করেছে সরকার। মাইকিং করে দোকানপাট বন্ধ রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। সর্বত্র আতঙ্ক। আন্দোলনকারীদের চাপের মুখে দুপুরে দেশ থেকে পালান কেপি শর্মা ওলি। তার পদত্যাগের পরেই একে একে স্বাস্থ্যমন্ত্রী, বাণিজ্যমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সরকারি বাসভবনে আগুন দেয় বিক্ষোভকারীরা। বন্ধ করে দেয়া হয় কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন এয়ারপোর্ট। বিমানবন্দরে আটকা পরে হাজার হাজার যাত্রী। ত্রিভুবনে নামতে না পেরে ১১৪ জন যাত্রী নিয়ে ঢাকা ফিরে গেছে বাংলাদেশ বিমানের একটি ফ্লাইট। তবে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত নেপাল ছাড়তে পারেনি বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দল।
সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ সব সংবাদ, ছবি ,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন। ভিজিট করুন : http://www.etihad.news
* অনলাইন নিউজ পোর্টাল ইত্তেহাদ নিউজে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায় ।
ইত্তেহাদ নিউজ, এয়ার পোর্ট রোড, আবুধাবী ,সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইমেইল: [email protected], web:www.etihad.news
এম এম রহমান, প্রধান সম্পাদক, ইত্তেহাদ নিউজ, এয়ার পোর্ট রোড, আবুধাবী, সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে প্রকাশিত ও প্রচারিত