সরকারের পুরো প্রশাসনই এখন জামাত লীগের নিয়ন্ত্রণে,নাটের গুরু এখনও বহাল তবিয়তে


শীর্ষনিউজ: অন্তর্বর্তী সরকারের প্রশাসনযন্ত্রে এখন চরম বিশৃঙ্খলা চলছে। ঘুষ-দুর্নীতি ভয়াবহ আকারে বেড়েছে। পদোন্নতি পদায়নে প্রকাশ্যেই ঘুষ লেনদেন হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও আলোচনা-সমালোচনা চলে আসছে বেশ কিছুদিন ধরেই। বলা যায়, অনেকটা ওপেন সিক্রেট। সর্বশেষ গত সপ্তায় এক সচিবের ঘুষের চুক্তির অভিযোগ উঠে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। যা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়।
শুধু সিভিল প্রশাসনেই নয়, পুলিশ প্রশাসন, শিক্ষা প্রশাসন, স্বাস্থ্য প্রশাসন সর্বত্রই এমন অনিয়ম-বিশৃঙ্খলা ও ঘুষ লেনদেনের অভিযোগ রয়েছে। এ ধরনের প্রকাশ্যে ঘুষ লেনদেনের সুযোগেই শেখ হাসিনার একান্ত অনুগত, ফ্যাসিস্ট বলে চিহ্নিত সরকারি কর্মকর্তারা এ সরকারের আমলেও অনেকে বহাল-তবিয়তে রয়ে গেছে। জুলাই অভ্যুত্থানের চেতনা অনেকটাই এসব কারণে ভূলণ্ঠিত হয়েছে। সরকারের ভাবমুর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষুন্ন হয়েছে। সরকারের ‘বাস্তব’ সংস্কার কার্যক্রম ব্যহত হয়েছে। সরকারি দপ্তরগুলোর চিত্র আগের মতোই রয়ে গেছে। সাধারণ মানুষ কোনোই পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছে না। এতে মানুষ হতাশ হয়েছে। বিশেষ করে সবচেয়ে বেশি হতাশ হয়েছে আওয়ামী ফ্যাসিস্ট লুটেরা শ্রেণীর কর্মকর্তাদের বহাল-তবিয়তে থাকার ঘটনায়। শুধু বহাল থাকাই নয়, নতুন করে পদোন্নতি এবং আকর্ষণীয় পদায়নও পাচ্ছে ঘুষের বিনিময়ে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জামায়াতের দলীয় মাস্টারপ্ল্যানের অংশ হিসেবেই আওয়ামী ফ্যাসিস্ট এইসব দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের বহাল-তবিয়তে রাখা হয়েছে। কারণ, প্রশাসনসহ সরকারি দপ্তরসমুহে জামায়াত সমর্থিত কর্মকর্তার সংখ্যা অত্যন্ত সীমিত। নিজেদের শক্তি বৃদ্ধি এবং বিএনপির পাল্টা হিসেবে নিজেদের দাঁড় করানোর জন্য বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের শুরু থেকেই আওয়ামী ফ্যাসিস্ট ও দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের দলে ভেড়ানোর নীতি গ্রহণ করে জামায়াত। এর নেতৃত্ব মন্ত্রিপরিষদ সচিব ড. শেখ আব্দুর রশীদের হাতে। ঠান্ডা মাথার কট্টর জামায়াতপন্থি এই কর্মকর্তা অত্যন্ত সুক্ষ্ম ও সফলভাবেই অ্যাসাইনমেন্ট অনুযায়ী কাজ এগিয়ে নিয়েছেন। যার ফল হলো, আজকের প্রশাসন। সরকারের পুরো প্রশাসনই এখন জামায়াতের নিয়ন্ত্রণে। এরসঙ্গে নিষিদ্ধ ঘোষিত হিযবুত তাহরীরও যুক্ত হয়েছে। বলছে সরকারেরই একটি স্পর্শকাতর গোয়েন্দা সংস্থা।
জামায়াত নেটওয়ার্কের শীর্ষ ব্যক্তি শেখ আব্দুর রশীদ, বলছে স্পর্শকাতর গোয়েন্দা সংস্থা!
সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর একটি গোয়েন্দা সংস্থা সম্প্রতি প্রশাসন রাজনীতিকরণ সম্পর্কিত ‘অতি গোপনীয়’ প্রতিবেদন তৈরি করেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, “বর্তমানে সিভিল প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে জামায়াতে ইসলামী ও নিষিদ্ধ ঘোষিত হিযবুত তাহরীর মতাদর্শে বিশ্বাসী কিছু কর্মকর্তা আছেন বলে পর্যবেক্ষণে পাওয়া গেছে। তারা অনেক সময় নিজেদের মূল রাজনৈতিক দলের ছায়াতলে থেকে তাদের মতাদর্শের কার্যক্রম অব্যাহত রাখেন, যাতে প্রশাসনিক নজরদারির বাইরে থাকতে পারেন। তাদের মধ্যে একটি সংঘবদ্ধ অভ্যন্তরীণ নেটওয়ার্ক সক্রিয় রয়েছে, যারা পারষ্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে নিজেদের মতাদর্শের অনুগত ব্যক্তিদের গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক পদে নিয়োগ ও পদায়নে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে থাকে। এ লক্ষ্যে তারা সংশ্লিষ্ট নিয়োগ/ পদায়ন প্রক্রিয়ায় প্রভাব বিস্তারের পাশাপাশি ওইসব কর্মকর্তাদের ‘মেধাবী, সৎ, কর্মঠ ও যোগ্য’ হিসেবে উপস্থাপন করতে কৌশলগত প্রচারণা চালায়। প্রতিবেদনটিতে আশংকা প্রকাশ করে বলা হয়, “সবচেয়ে আশংকাজনক বিষয় হলো, উক্ত চরমপন্থি মতাদর্শে বিশ্বাসী ব্যক্তিরা প্রয়োজনবোধে তাদের আদর্শিক অবস্থান রক্ষার স্বার্থে রাষ্ট্রীয় স্বার্থকে উপেক্ষা করতেও দ্বিধা করে না। ফলে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা, নীতিনির্ধারণী ও প্রশাসনিক নিরপেক্ষতার দিক থেকে বিষয়টি গভীরভাবে বিচেনার দাবি রাখে।”
গোয়েন্দা সংস্থাটি এই নেটওয়ার্কের ১২৫ জন কর্মকর্তার তালিকা তৈরি করে প্রতিবেদন আকারে পেশ করেছে। সচিব থেকে বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তার নাম রয়েছে এই তালিকায়। এই ১২৫ জনের সবাই চরমভাবে জামায়াত এবং কেউ কেউ হিযবুত তাহরীর মতাদর্শে বিশ্বাসী। হিযবুত তাহরীর কমকর্তারাও বর্তমানে জামায়াতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। তালিকায় সবার শীর্ষে রয়েছে মন্ত্রিপরিষদ সচিব ড. শেখ আব্দুর রশীদের নাম। মূলতঃ তাঁর নেতৃত্বেই এই পুরো নেটওয়ার্ক চলছে। তালিকার দ্বিতীয় নম্বরে ড. মোহাম্মদ মোখলেস উর রহমান এবং ৩ নম্বরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. নাসিমুল গণির নাম রয়েছে।
প্রশাসনে জামায়াত লীগ প্রতিষ্ঠায় মূল ভূমিকায় ‘শেখ রশীদ’
বর্তমান অন্তুর্বর্তী সরকারের শুরুতে পরিকল্পনা ছিল যে, এ সরকার অন্ততঃ পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকবে, বিএনপিকে ‘মাইনাস’ করা হবে এবং জামায়াতকে বিএনপির বিকল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হবে। এমন পরিকল্পনাকে সামনে রেখেই জামায়াতে ইসলামী তাদের দীর্ঘদিনের এবং বিপদের সময়ের ঘনিষ্ঠ মিত্র বিএনপির সঙ্গে বেঈমানী করে। কিন্তু বিএনপির বিকল্প হিসেবে নিজেদের দাঁড় করানোর জন্য পর্যাপ্ত জনবল নেই দলটির। আর তাই আওয়ামী লীগকে নানা প্রক্রিয়ায় নিজেদের দলে ভেড়ানোর কৌশল নেয়। বিশেষ করে সরকারি দপ্তরগুলোয় ব্যাপকভাবে আওয়ামী লীগের সুবিধাভোগী ও ফ্যাসিস্ট কর্মকর্তাদের দলে ভেড়ানোর নীতি গ্রহণ করে। এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই সচিবালয়সহ প্রায় সকল সরকারি দপ্তরে বিএনপিকে উচ্ছেদ ও কোনঠাসা করা হয়। প্রতিষ্ঠা করা হয় জামায়াত লীগ। এতে তাদের দু’দিক দিয়ে ফায়দা হয়। প্রথমত, বিএনপিকে উচ্ছেদ করা এবং দ্বিতীয়ত, আওয়ামী কর্মকর্তাদের কাছে বিপুল পরিমাণে যেসব অবৈধ অর্থ আছে সেগুলো হাতিয়ে নেয়া। আওয়ামী ফ্যাসিস্ট কর্মকর্তারাও এই সুবিধাকে সানন্দে লুফে নেয়। বিগত দিনের অপকর্ম চাপা দেয়া এবং পুনর্বাসিত হওয়ার অকল্পনীয় সুযোগ হিসেবে এটি মনে হয় তাদের কাছে। অবৈধ আয়ের একটা অংশকে তারা এই পুনর্বাসনের ব্যয় করে। মূলতঃ এসব কারণেই অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে প্রশাসনে ঘুষের হার অনেক গুণ বেড়ে গেছে।
সচিবালয়সহ সরকারি দপ্তরসমুহে পদোন্নতি পদায়নে এখন ঘুষ লেনদেন বহুলভাবে প্রচলিত শব্দ। জেলা প্রশাসক (ডিসি) পদায়ন নিয়ে ইতিপূর্বে বড় ধরনের কেলেঙ্কারি কাণ্ড ঘটে গেছে, এটা কারো অজানা নয়। এখন আবার সম্প্রতিক ডিসি পদে পরিবর্তন নিয়ে প্রকাশ্যে ঘুষ বাণিজ্যের তুলকালাম কাণ্ড ঘটে চলেছে। সাধারণ জেলাগুলোয় সর্বনিম্ন ৩ থেকে ৫ কোটি টাকা ঘুষ লেনদেন হচ্ছে। ডিসি পদের জন্য সর্বনিম্ন রেট হলো ৩ কোটি টাকা। এরপরে জেলা অনুপাতে ৩০ কোটি টাকা পর্যন্ত নিলাম উঠেছে। ঢাকা জেলার জন্য সর্বোচ্চ ৩০ কোটি টাকা। কক্সবাজারের মতো জেলার ডিসি পদ ২০ কোটি টাকায়। এবং পটুয়াখালীর মতো অনুন্নত জেলায়ও ১৫ কোটি টাকা নিলাম উঠেছে। চাঁদপুরে ৫ কোটি টাকা। কক্সবাজার এবং পটুয়াখালীর ডিসি পদে পদায়নের জন্য এত টাকা কেন, এ প্রশ্নের উত্তরে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন- এই দুটি জেলায় জমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত অনেক কেস অমীমাংসিত আছে। এসব কেস থেকে বড় অংকের আয় হবে, তাই ঘুষের রেটও বেশি। উল্লেখ্য, গত সপ্তায় কক্সবাজারে ডিসি পদে একজনকে পদায়ন দেয়া হয়েছে। তিনি কোন লাইনে বা কোন ক্রাইটেরিয়ায় নিয়োগ পেয়েছেন এ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানা যায়নি। তবে মোখলেস উর রহমানের হাত দিয়েই নিয়োগ পেয়েছেন এই নতুন ডিসি আবদুল মান্নান।
মোখলেস আউট হলেও নাটের গুরু শেখ রশীদ এখনো বহাল-তবিয়তে
গোয়েন্দা সংস্থার পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী প্রশাসনের এই পুরো নেটওয়ার্কের মূল নেতা হলেন ড. শেখ আব্দুর রশীদ। তাঁর নিজের নেটওয়ার্ক বজায় রাখা এবং জামায়াতের রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করার জন্য জনপ্রশাসন সচিব পদটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ড. শেখ আব্দুর রশীদ অত্যন্ত বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন এখন যারা সচিব পদে আছেন এদের মধ্য থেকেই নিজের পছন্দমতো কোনো কর্মকর্তাকে সচিব করতে। তাতে তার নিজের এবং জামায়াতের ষোলকলা পূর্ণ হবে। নির্বাচন বানচালের জন্য জামায়াত যেসব নানা রকমের ষড়যন্ত্র করছে তা বাস্তবায়ন হবে। এখন সচিব পদে যারা আছেন এদের প্রায় সকলেই জামায়াতের অনুসারী। এরমধ্যে আগে থেকে জামায়াতের অনুসারী যারা ছিলেন তারা তো আছেনই। আওয়ামী লীগের যারা সচিব পদে আগে ছিলেন এবং যারা নতুন সচিব হয়েছেন, প্রশাসনের অন্য গুরুত্বপূর্ণ পদেও যারা আছেন এদেরও তিনি জামায়াতের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। অঘোষিত বাইয়াত পড়িয়েছেন জামায়াতে যোগদানের। অন্যদিকে তাদের কাছ থেকে বিভিন্ন মাধ্যমে বায়তুল মালও সংগ্রহ করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্মমহাসচিব রুহুল কবির রিজভী গত সপ্তায় অভিযোগ করে বলেছেন, একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের লোকদের ডিসি-এসপি করা হচ্ছে। বাস্তবেও কিন্তু তাই। এমন প্রবণতা বিএনপির জন্য, এমনকি সরকারের জন্যও বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়াবে। এই প্রশাসন দিয়েই জামায়াত গোটা নির্বাচনকে ভুন্ডল করে দিতে পারে। সেই পাঁয়তারাই চলছে। শুধু প্রশাসনের জোরেই জামায়াত এতটা জোর গলায় কথা বলতে পারছে, মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
প্রশাসনে বর্তমানে বিএনপির কর্মকর্তা হিসেবে যারা সচিব পদে আছেন এরাও সবাই তলে তলে জামায়াতে যোগ দিয়েই সচিব হয়েছেন, বিশেষ করে চুক্তিভিত্তিতে যারা আছেন। যেমন ভূমি সচিব এ এস এম সালেহ আহমেদ বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া বিরোধীদলীয় নেত্রী থাকাকালে সরকারি নিয়োগে পিএস পদে ছিলেন। কিন্তু বিগত ফ্যাসিস্ট আমলে তাকে কখনো বিএনপির পক্ষে বা ফ্যাসিস্ট বিরোধী ভূমিকায় দেখা যায়নি। তিনি এই অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে সিনিয়র সচিব পদে নিয়োগ পেয়েছেন জামায়াতের আশীর্বাদে। মন্ত্রিপরিষদ সচিব ড. শেখ আব্দুর রশীদের অত্যন্ত আস্থাভাজন তিনি। সালেহ আহমেদের মূল অ্যাসাইনমেন্ট হলো, বিএনপির কর্মকর্তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখা। একথা ইতিপূর্বে এক ঘটনায় ফাঁস করেছেন উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির। বিয়াম ভবনের অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকা এবং বৈষম্যবিরোধী কর্মকর্তাদের আন্দোলন নিয়ন্ত্রণ করতে না পারার বিষয়ে ক্ষোভ ঝাড়তে গিয়ে উপদেষ্টা ফাওজুল কবির একথাটি ফাঁস করেন।
সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ সব সংবাদ, ছবি ,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন। ভিজিট করুন : http://www.etihad.news
* অনলাইন নিউজ পোর্টাল ইত্তেহাদ নিউজে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায় ।