ইত্তেহাদ নিউজ,অনলাইন : ভারতের রাজনৈতিক আকাশে অশান্তির মেঘ দিন দিন ঘন হয়ে উঠছে। নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকার টানা এক দশকের বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় থাকলেও বর্তমানে দেশজুড়ে নানা কারণে অস্থিরতা বাড়ছে। রাজপথে নামছে ছাত্র, যুবক, কৃষক, সংখ্যালঘু ও বিভিন্ন প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। কেউ দাবি করছে কর্মসংস্থান, কেউ স্বচ্ছ নিয়োগ, আবার কেউ চাইছে স্বায়ত্তশাসন বা সাংবিধানিক অধিকার। বিহার থেকে শুরু করে আসাম, পাঞ্জাব, মণিপুর কিংবা মহারাষ্ট্র-ভারতের প্রায় সব প্রান্তেই একেকটি আলাদা ইস্যু নিয়ে ক্ষোভ ফুঁসে উঠছে। সর্বশেষ লাদাখের জেন-জি ঝড়ে কেঁপে ওঠেছে মোদি সরকার।
এই বিক্ষোভ শুধু সাধারণ ক্ষোভ প্রকাশ নয়, বরং এটি মোদি সরকারের জন্য ভবিষ্যতের রাজনৈতিক অশনিসংকেত। কারণ, বিজেপি বরাবরই জাতীয়তাবাদী আবেগ ও শক্তিশালী নেতৃত্বের ছত্রছায়ায় জনগণকে একত্রে ধরে রাখতে পেরেছিল। কিন্তু ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব, মুদ্রাস্ফীতি, প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি ও আঞ্চলিক বৈষম্যের কারণে জনগণের আস্থা নড়বড়ে হয়ে যাচ্ছে। নরেন্দ্র মোদি সরকারের তৃতীয় মেয়াদ শুরুর পরপরই একের পর এক বিক্ষোভ ভারতকে দাঁড় করিয়েছে এক কঠিন প্রশ্নের মুখে- এবার কি সত্যিই রাজপথের জনরোষে কেঁপে উঠবে দিল্লির সিংহাসন?
জেন-জি’দের বিক্ষোভে চাপে মোদি সরকার
২৪ সেপ্টেম্বর লাদাখের শীতল পর্বতমণ্ডল উত্তাল হয়ে উঠে। পৃথক রাজ্যের দাবিতে ‘জেন-জি’ তথা নতুন প্রজন্মের তরুণেরা গত ১৯ সেপ্টেম্বর থেকে ধারাবাহিক বিক্ষোভে নামেন। এই আন্দোলন শুধু স্থানীয় প্রশাসনের ওপর চাপ তৈরি করেনি, বরং কেন্দ্রীয় সরকারকেও অবিলম্বে পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করেছে। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, এই বিক্ষোভে অন্তত ৫ জন বিক্ষোভকারী ইতিমধ্যেই প্রাণ হারিয়েছেন। আহত হয়েছেন অনেকেই।
লাদাখের যুবসমাজ মূলত শিক্ষিত, তথ্যপ্রযুক্তিতে দক্ষ এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অত্যন্ত সক্রিয়। তারা মনে করেন, লাদাখের ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করতে হলে পৃথক রাজ্যের দাবি অত্যন্ত জরুরি। বিশেষত, জলবায়ু পরিবর্তন, পর্যটন ও বেসামরিক অবকাঠামোর উন্নয়নের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকারের উদাসীনতার অভিযোগ তুলে ধরেছে বিক্ষোভকারীরা।
বিক্ষোভের মূল কেন্দ্রস্থলটি ছিল লেহ ও কার্গিল শহরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে। শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে এই আন্দোলনে বিভিন্ন পেশার তরুণরাও অংশগ্রহণ করেছেন। তারা জেলা প্রশাসনের সামনে বড় ব্যানার ও প্ল্যাকার্ড নিয়ে শান্তিপূর্ণ প্রদর্শন করছিলেন। তবে পরিস্থিতি দ্রুত উত্তপ্ত হয়ে ওঠে, যখন পুলিশকে বাধ্য করা হয় বাধা দিতে। সংঘর্ষে ৫ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত হওয়ায় অঞ্চলজুড়ে শোকের ছায়া নেমে আসে।
স্থানীয় নেতারা জানিয়েছেন, এই আন্দোলনের প্রেক্ষাপট শুধুমাত্র প্রশাসনিক অবহেলা নয়, বরং দীর্ঘ দিনের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্যও। লাদাখের যুবরা দাবি করছেন, কেন্দ্রীয় সরকারের নীতি প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় তাদের অংশগ্রহণ না থাকা এবং পর্যাপ্ত বিনিয়োগ না হওয়ায় অঞ্চলটির অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে।
এদিকে আন্দোলনের পর ২৬ সেপ্টেম্বর শুক্রবার লাদাখ পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছেন সোনম ওয়াংচুক। ২৬ সেপ্টেম্বর দুপুর ২টা ৩০ মিনিটে সংবাদ সম্মেলনে যোগ দেওয়ার কথা থাকলেও এর আগেই তাকে আটক করা হয়। ওয়াংচুককে গ্রেপ্তার করে লাদাখ পুলিশের একটি দল, যার নেতৃত্বে ছিলেন ডিরেক্টর জেনারেল অব পুলিশ এস ডি সিংহ জামওয়াল। লেহতে ইন্টারনেট সেবাও স্থগিত করা হয়েছে। কোন অভিযোগে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তা তাৎক্ষণিকভাবে স্পষ্ট হয়নি। তবে তাকে গ্রেফতার পর জেন জিরা আন্দোলন জোরালোভাবে শুরুর করতে পারে। এতে করে মোদির অবস্থা অলির মতোই হতে পারে বলে অনেকেই আশঙ্কা করছেন।
মোদী সরকারের জন্য এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ। লাদাখকে কেন্দ্র করে সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে ব্যাপক সমর্থন এবং প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। #ঋৎববখধফধশয এবং #খধফধশযঝঃধঃবযড়ড়ফ এর মতো হ্যাশট্যাগগুলো মুহূর্তের মধ্যে ট্রেন্ডিংয়ে উঠে এসেছে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই তরুণ প্রজন্মের চাপ যদি দীর্ঘমেয়াদী হয়, তবে কেন্দ্রীয় সরকারকেও নীতি পরিবর্তনের দিকে মনোনিবেশ করতে হবে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, লাদাখের পরিস্থিতি শুধুমাত্র স্থানীয় নয়, বরং সাম্প্রতিক ভারতের যুবজনসংখ্যার সক্রিয় নাগরিক অংশগ্রহণের প্রতিফলন। ‘জেন-জি’ প্রজন্মের জন্য সামাজিক ন্যায়, অর্থনৈতিক স্বায়ত্তশাসন এবং পরিবেশগত সচেতনতা প্রধান উদ্বেগের বিষয়। তারা জানাচ্ছে, শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের মাধ্যমে তাদের দাবি আদায় করা হবে, এবং কেন্দ্রকে এই চাহিদা অগ্রাহ্য করা সম্ভব নয়।
এছাড়াও, বিক্ষোভে অংশ নেওয়া যুবকদের মতে, লাদাখকে আলাদা রাজ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিলে প্রশাসনিক কার্যক্রম আরও স্বচ্ছ হবে, স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পাবে এবং পর্যটন ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের ক্ষেত্রে বড় ধরনের সাফল্য আসবে। তারা কেন্দ্রের কাছে দৃঢ় প্রত্যাশা করছেন যে, দ্রুত এই দাবি বিবেচনা করা হবে।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে লাদাখ প্রশাসন অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। সভা-সমাবেশ ও বড় জমায়েত সীমিত করা হয়েছে। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, চাপ কমানো সম্ভব হলেও, ‘জেন-জি’ প্রজন্মের আন্দোলন সহজেই থেমে যাবে না। তারা শিক্ষিত, প্রযুক্তি সচেতন এবং সামাজিক ন্যায়ের পক্ষে দৃঢ় অবস্থানে রয়েছে।
লাদাখের এই বিক্ষোভ মোদি সরকারের জন্য শুধু প্রশাসনিক নয়, রাজনৈতিক সংকেতও বহন করছে। যুবসমাজের চাপে কেন্দ্রকে দ্রুত নীতি পরিবর্তন করতে হবে, না হলে এ ধরনের আন্দোলন আরও সম্প্রসারিত হবে এবং দেশের অন্যান্য অংশে অনুরূপ আন্দোলনের আগ্রহ তৈরি হতে পারে।
লাদাখের উত্তাল পরিস্থিতি স্পষ্টভাবে দেখাচ্ছে যে, নতুন প্রজন্মের যুবারা শুধুমাত্র নিজেদের স্বার্থে নয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক স্বচ্ছতার জন্যও আওয়াজ তুলছে। ‘জেন-জি’ প্রজন্মের দৃঢ় অবস্থান কেন্দ্রের জন্য চ্যালেঞ্জ, এবং মোদি সরকারকে এই তরুণদের চাপে বিবেচনামূলক পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করছে।
কে এই তরুণ নেতা ওয়াংচুক
সোনম ওয়াংচুক হলো লাদাখের একজন তরুণ নেতা, যিনি জেন জি আন্দোলনের মুখ। তিনি মূলত জলবায়ু কর্মী ও সমাজকর্মী, এবং ‘থ্রি ইডিয়টস’ সিনেমার রেঞ্চো চরিত্রের কারণে অনেকে তাকে রেঞ্চোখ্যাতও বলে। ওয়াংচুক লাদাখের পৃথক রাজ্য মর্যাদা এবং সাংবিধানিক সুরক্ষা নিশ্চিত করার দাবিতে আন্দোলন চালাচ্ছেন। তার নেতৃত্বে হাজার হাজার তরুণ ছাত্রছাত্রী রাস্তায় নেমে আসে এবং শান্তিপূর্ণভাবে শুরু হওয়া বিক্ষোভ দ্রুত কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল লাদাখে ব্যাপক সংঘর্ষে রূপ নেয়।
ওয়াংচুক স্পষ্ট জানিয়েছেন, এটি জেন জি আন্দোলন, এতে কোনো রাজনৈতিক দলের সরাসরি হাত নেই। আন্দোলনের মূল লক্ষ্য হলো লাদাখকে পূর্ণ রাজ্য ঘোষণা করা এবং কেন্দ্রের প্রতিশ্রুতিগুলি বাস্তবায়ন করা।
তাঁর নেতৃত্বে আন্দোলন তরুণ প্রজন্মকে একত্রিত করেছে, যারা সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তনের পক্ষে শক্তিশালী অবস্থান নিয়েছে। ওয়াংচুকের উদ্যোগ ও অনশন লাদাখবাসীর মনে আশা জাগাচ্ছে এবং দেশের নজর কাড়ছে, যেখানে তরুণরা সক্রিয়ভাবে তাদের অধিকার ও স্বীকৃতির জন্য লড়ছেন।
বিহারের ছাত্র আন্দোলন: নিয়োগ ও শিক্ষা ব্যবস্থার সংকট
বিহার ভারতের অন্যতম দরিদ্র ও শিক্ষাপ্রবণ রাজ্য। দীর্ঘদিন ধরেই এখানে সরকারি চাকরির নিয়োগ প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও জালিয়াতির অভিযোগ রয়েছে। সম্প্রতি শিক্ষক ও পুলিশ নিয়োগ পরীক্ষায় অনিয়মের অভিযোগ সামনে আসতেই রাজপথে নেমে আসে হাজার হাজার ছাত্র-যুবক।
শিক্ষিত যুবকরা বছরের পর বছর ধরে পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছে, কিন্তু শেষ মুহূর্তে পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস, ভুয়া প্রার্থী প্রবেশ, কিংবা রাজনৈতিক যোগসাজশে নিয়োগের ঘটনা সাধারণ ছাত্রসমাজকে ক্ষুব্ধ করে তুলেছে। বেকারত্বের হার বিহারে জাতীয় গড়ের চেয়ে অনেক বেশি। একদিকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে মানসম্মত শিক্ষার অভাব, অন্যদিকে সরকারি চাকরির সুযোগও হাতছাড়া হওয়ায় ছাত্রদের হতাশা চরমে পৌঁছেছে।
বিক্ষোভকারীরা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে-“শিক্ষায় স্বচ্ছতা চাই, নিয়োগে দুর্নীতি চাই না।” পুলিশের কড়া দমন, গ্রেপ্তার ও লাঠিচার্জ পরিস্থিতিকে আরও উত্তপ্ত করেছে। রাজনীতিবিদরা কেউ কেউ এটিকে মোদি-বিরোধী প্ল্যাটফর্মে রূপ নিতে পারে বলে সতর্ক করেছেন।
আসামের জনজীবনে অস্থিরতা: এনআরসি, অভিবাসন ও বন্যা
আসাম ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য। এখানে কয়েক বছর ধরে জাতীয় নাগরিকপঞ্জি (এনআরসি) ও অভিবাসন ইস্যু রাজনৈতিক উত্তেজনার কেন্দ্রবিন্দুতে। এনআরসি তালিকা থেকে লাখো মানুষ বাদ পড়েছে, যাদের অনেকেই মুসলিম ও বাঙালি বংশোদ্ভূত। এর ফলে তাদের নাগরিকত্ব প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে গেছে।
এ অবস্থায় আসামে আবারও ক্ষোভ দানা বাঁধছে। অনেকে এটিকে মোদি সরকারের বিভাজনমূলক রাজনীতির ফল হিসেবে দেখছে। শুধু তাই নয়, আসামে প্রতিবছর ভয়াবহ বন্যা ও নদীভাঙন হাজার হাজার মানুষকে বাস্তুচ্যুত করে। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে কার্যকর কোনো দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা না থাকায় স্থানীয় জনগণ নিজেদের পরিত্যক্ত মনে করছে।
সাম্প্রতিক বিক্ষোভে দেখা গেছে, যুব সমাজ শুধু এনআরসি নয়, বরং উন্নয়ন বৈষম্য, কর্মসংস্থানের অভাব ও দুর্বল অবকাঠামোর বিরুদ্ধেও সরব হয়েছে। মোদি সরকারের প্রতিশ্রুত “অভ্যন্তরীণ শান্তি ও উন্নয়ন” কথাটি আসামের জনগণের কাছে এখন অনেকটাই ফাঁকা বুলি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
মণিপুরের সাম্প্রদায়িক সংঘাত: বাস্তুচ্যুত মানুষের আর্তনাদ
উত্তর-পূর্ব ভারতের মণিপুর রাজ্য দীর্ঘদিন ধরেই জাতিগত বিভাজন ও সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার জন্য পরিচিত। সাম্প্রতিক সময়ে কুকি ও মেইতেই জনগোষ্ঠীর মধ্যে সংঘাত ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। কয়েক মাস ধরে চলা এই সহিংসতায় শতাধিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছে এবং কয়েক হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়ে শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। গ্রামগুলোতে ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে, দোকানপাট লুট হচ্ছে এবং অবকাঠামো ধ্বংসের ফলে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা অচল হয়ে পড়েছে।
সংঘাতের মূল কারণ জমি, পরিচয় ও রাজনৈতিক আধিপত্যকে কেন্দ্র করে দীর্ঘদিনের অসন্তোষ। মেইতেই জনগোষ্ঠী, যারা সংখ্যাগরিষ্ঠ, তারা মূলত উপত্যকায় বসবাস করে এবং অধিকাংশ সরকারি সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে আসছে। অন্যদিকে পাহাড়ি অঞ্চলে বসবাসরত কুকি সম্প্রদায় বহুদিন ধরে অভিযোগ করে আসছে যে তারা উপেক্ষিত। সম্প্রতি মেইতেইদের তফসিলি উপজাতি মর্যাদা দেওয়ার দাবিকে কেন্দ্র করে দ্বন্দ্ব আরও চরমে পৌঁছে যায়। কুকিদের আশঙ্কা, এই মর্যাদা পেলে মেইতেইরা পাহাড়ি এলাকায় জমি ও সম্পত্তির দখল বাড়াবে, ফলে কুকি সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়বে।
সংঘাতের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ আঘাত এসেছে নারী নির্যাতনের ঘটনাগুলো থেকে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একাধিক ভিডিওতে দেখা যায়, উভয় সম্প্রদায়ের নারীকে প্রকাশ্যে লাঞ্ছিত ও নির্যাতন করা হয়েছে। এসব দৃশ্য পুরো ভারতজুড়ে তীব্র ক্ষোভ সৃষ্টি করে। মানবাধিকার সংস্থাগুলো একে সরকারের ব্যর্থতা ও প্রশাসনের পক্ষপাতিত্বের ভয়াবহ উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করেছে। নিরাপত্তা বাহিনীর ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে, কারণ অনেক ক্ষেত্রে তারা নিরপেক্ষ আচরণ করতে ব্যর্থ হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, মণিপুরের এই অস্থিরতা শুধু আঞ্চলিক নয়, বরং ভারতের কেন্দ্রীয় রাজনীতির জন্যও একটি সতর্কবার্তা। কেন্দ্রীয় সরকার শান্তি ফিরিয়ে আনতে বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েন করলেও এখনো মূল সমস্যার সমাধান হয়নি। বরং বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। শিশু ও নারী সবচেয়ে বেশি ভুগছে।
পাঞ্জাবের কৃষক আন্দোলন: দাবি পূরণে অটল সংগ্রাম
২০২০ সালে কেন্দ্রীয় সরকারের তিনটি কৃষি আইনকে কেন্দ্র করে যে ব্যাপক কৃষক আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল, তা শুধু ভারতের ইতিহাসে নয়, বিশ্ব রাজনীতিতেও দাগ কেটে গেছে। দিল্লির সীমানায় এক বছরেরও বেশি সময় ধরে লাখো কৃষকের অবস্থান, অবরোধ ও প্রতিবাদ সরকারকে শেষ পর্যন্ত আইন প্রত্যাহারে বাধ্য করে। তবে আইন বাতিলের মধ্যেই কৃষকদের আন্দোলন শেষ হয়নি। কৃষকরা ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের নিশ্চয়তা, ঋণ মওকুফ ও কৃষি সংস্কারের দাবি অব্যাহত রেখেছে। কারণ, তাদের মূল দাবিগুলোর বড় অংশ এখনো অমীমাংসিত।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দাবি হলো ন্যূনতম সহায়ক মূল্য (গঝচ) আইনি নিশ্চয়তা। কৃষকরা চান- ধান, গমসহ সব ফসলের জন্য সরকার ন্যূনতম দাম নিশ্চিত করবে এবং তা আইনে সুরক্ষিত থাকবে। বর্তমানে এমএসপি ঘোষণা করা হলেও তা আইনগতভাবে বাধ্যতামূলক নয়। ফলে ব্যবসায়ী ও বড় করপোরেট কোম্পানির দৌরাত্ম্যে কৃষকরা ন্যায্য দাম পান না। এছাড়া তারা কৃষিঋণের বোঝা মওকুফ, কৃষি যন্ত্রপাতি ও সার-ডিজেলের ভর্তুকি এবং ক্ষুদ্র কৃষকদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চয়তার দাবি জানাচ্ছেন।
পাঞ্জাব ও হরিয়ানার কৃষকরা বিশেষভাবে ক্ষুব্ধ। কারণ, এই অঞ্চলগুলোকে ভারতের "ধান-গমের ভাণ্ডার" বলা হলেও কৃষক আত্মহত্যার হার সবচেয়ে বেশি এখানেই। অতিরিক্ত ঋণের চাপ, জমির খরচ এবং উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় কৃষকদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। ফলে প্রতিবারই নতুন দাবিকে ঘিরে তারা রাজপথে নেমে আসছেন। সাম্প্রতিক মাসগুলোতেও পাঞ্জাব-হরিয়ানা সীমান্তে হাজার হাজার কৃষক ট্র্যাক্টর-ট্রলি নিয়ে বিক্ষোভ করেছেন।
মহারাষ্ট্রের মরাঠা আন্দোলন
মহারাষ্ট্রে মরাঠা জনগোষ্ঠীর সংরক্ষণের দাবিকে ঘিরে কয়েক বছর ধরে রাজনীতি এবং সামাজিক অস্থিরতা তীব্র আকার ধারণ করেছে। ঐতিহাসিকভাবে মরাঠারা কৃষিনির্ভর সম্প্রদায় হলেও আধুনিক অর্থনীতিতে তারা ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছে। শিক্ষা ও চাকরিতে সুযোগের অভাব, শিল্প-কারখানায় কম অংশগ্রহণ এবং কৃষিতে লোকসান- সব মিলিয়ে এই জনগোষ্ঠীর মধ্যে হতাশা বাড়ছে। তাদের অভিযোগ, বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকার বারবার সংরক্ষণের প্রতিশ্রুতি দিলেও বাস্তবে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি। ফলে মহারাষ্ট্র জুড়ে হরতাল, অবরোধ, বিক্ষোভ নিয়মিত হয়ে গেছে।
মরাঠা আন্দোলনের কেন্দ্রীয় দাবি হলো শিক্ষা ও সরকারি চাকরিতে সংরক্ষণ (কোটা)। ভারতের সংবিধান অনুযায়ী ইতোমধ্যেই অনেক প্রান্তিক জনগোষ্ঠী সংরক্ষণ সুবিধা ভোগ করছে। তবে মরাঠারা মনে করে, সামাজিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে তারা পিছিয়ে পড়ায় তারাও এই সুবিধার অধিকারী। ২০১৮ সালে মহারাষ্ট্র সরকার বিশেষ আইন করে মরাঠাদের জন্য ১৬ শতাংশ কোটা ঘোষণা করেছিল। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট তা বাতিল করে দেয়, যুক্তি দেয়-৫০ শতাংশের বেশি সংরক্ষণ সংবিধানসম্মত নয়। এরপর থেকেই আন্দোলন নতুন করে উত্তাল হয়ে ওঠে।
গত কয়েক বছরে আন্দোলনকারীরা মহারাষ্ট্রজুড়ে বৃহত্তর মিছিল, হরতাল, অবরোধ ও সড়ক অবরোধ কর্মসূচি পালন করেছে। অনেক সময় সহিংসতাও ঘটেছে, প্রাণহানির ঘটনাও আছে। আন্দোলনের ফলে কৃষি উৎপাদন, পরিবহন ও ব্যবসায় বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। বিশেষত পুনে, নাগপুর, ঔরঙ্গাবাদ ও সাতারা অঞ্চলে এ আন্দোলন সবচেয়ে তীব্র।
অর্থনীতি ও বেকারত্ব সংকট
ভারতের অর্থনীতি গত কয়েক বছরে প্রবৃদ্ধি অর্জন করলেও বাস্তবে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা কঠিন হয়ে উঠেছে। মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় খাদ্যপণ্যের দাম সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে।
বিশেষ করে বেকারত্ব সংকট ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকোনমি (সিএমআইই)-এর হিসাব অনুযায়ী, ২০২৫ সালে যুব বেকারত্বের হার ২০ শতাংশ ছাড়িয়েছে। গ্রামাঞ্চলে কৃষির উপর অতিরিক্ত চাপ, শহরে শিল্প কারখানার সংকট এবং দক্ষতাভিত্তিক কাজের অভাব ছাত্র-যুব সমাজকে হতাশ করে তুলেছে।
মোদির দেওয়া প্রতিশ্রুতি- “মেক ইন ইন্ডিয়া” কিংবা “স্টার্টআপ ইন্ডিয়া”-প্রকৃতপক্ষে সীমিত পরিসরে সফল হলেও কোটি তরুণের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে। এ কারণে বেকার যুবকদের আন্দোলন দিন দিন আরও বিস্তৃত হচ্ছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই সব বিক্ষোভ কেবল স্থানীয় বা আঞ্চলিক সংকট নয়, বরং ভারতীয় গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ প্রশ্নবিদ্ধ করছে। বিরোধীরা অভিযোগ করছে- মোদির আমলে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল হয়ে পড়েছে, সংবাদমাধ্যম স্বাধীনতা হারিয়েছে এবং বিরোধী কণ্ঠরোধ করা হচ্ছে।
দক্ষিণ এশীয় প্রেক্ষাপট
ভারতের বর্তমান পরিস্থিতি দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের সঙ্গে তুলনা করলে অনেক মিল পাওয়া যায়। বাংলাদেশে নির্বাচন, মূল্যস্ফীতি ও রাজনৈতিক সহিংসতা নিয়ে জনগণের ক্ষোভ বেড়েছে। শ্রীলঙ্কায় অর্থনৈতিক সংকটে সরকার পতন হয়েছে, যা ভারতীয়দের চোখে সতর্কবার্তা। নেপালে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও দুর্নীতি বিরোধী আন্দোলন অব্যাহত। ফলে ভারতের জনগণও এখন প্রশ্ন তুলছে- “আমরা যদি রাজপথে না নামি, তবে কি সরকার আমাদের কথা শুনবে?”
ভবিষ্যৎ ঝুঁকি মোদি সরকারের
ভারত সরকার ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সরকারের জন্য ভবিষ্যৎ ঝুঁকি এখন মূলত তরুণ প্রজন্মের রাজনৈতিক সচেতনতা, লাদাখের জেন-জি আন্দোলন ও স্থানীয় অসন্তোষ থেকে উদ্ভূত হচ্ছে। জেন-জি আন্দোলন দেখিয়েছে, তরুণরা শুধু সামাজিক নয়, রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় এবং শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের মাধ্যমে তাদের দাবিসমূহ তুলে ধরছে। যদি সরকার তাদের দাবি উপেক্ষা করে বা কঠোর দমনমূলক পদক্ষেপ নেয়, তবে আন্দোলন বৃহত্তর সম্প্রদায়ের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে পারে।
লাদাখের কেন্দ্রীয় শাসিত অঞ্চল হিসেবে থাকা এবং পৃথক রাজ্য মর্যাদার দাবি কেন্দ্রের জন্য দীর্ঘমেয়াদী চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে। স্থানীয় অসন্তোষ উপেক্ষা করলে জনগণের বিশ্বাস ক্ষুণ্ন হতে পারে, যা রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক ক্ষেত্রে সমস্যার জন্ম দেবে। বিক্ষোভের সময় সংঘর্ষ এবং সহিংসতার ঘটনায় নিরাপত্তা ঝুঁকিও বাড়ছে, যা সীমান্ত সংলগ্ন লাদাখে জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি সৃষ্টি করতে পারে।
অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক চাপ ও আন্তর্জাতিক সমালোচনার সম্ভাবনা আরও একটি বড় ঝুঁকি। বিরোধী দলগুলোর হাতিয়ার হিসেবে এই আন্দোলন ব্যবহৃত হতে পারে, তরুণ ভোটারদের মনোভাব সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। এই পরিস্থিতিতে মোদি সরকারকে শান্তিপূর্ণ আলোচনার পথ গ্রহণ ও স্থানীয় দাবিসমূহ বিবেচনা করতে হবে, না হলে ভবিষ্যতে রাজনৈতিক, সামাজিক ও নিরাপত্তাগত সমস্যা আরও জটিল হয়ে উঠবে।
লাদাখ ছাড়াও ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে এখন যেন আন্দোলনের ঝড় বইছে। সর্বশেষ লাদাখের সীমান্ত অঞ্চল থেকে শুরু করে উত্তর-পূর্ব ও পশ্চিম ভারতের রাজ্যগুলো পর্যন্ত একের পর এক আন্দোলন যেন কেন্দ্রীয় সরকারের নীতি ও প্রতিশ্রুতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, আগামী দিনে মোদি সরকারের সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হলো- আস্থা সংকট। উন্নয়ন, কর্মসংস্থান, সামাজিক ন্যায়বিচার ও আঞ্চলিক ভারসাম্য রক্ষায় যদি সরকার কার্যকর উদ্যোগ নিতে না পারে, তবে আন্দোলনের আগুন আরও ছড়িয়ে পড়বে। আর সেই আগুন শেষ পর্যন্ত ২০২৯ সালের জাতীয় নির্বাচনে বিজেপির ভবিষ্যৎকেও হুমকির মুখে ফেলতে পারে। এমনকী- আসন্ন নির্বাচনের আগেই মোদি সরকারের পতন ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন তারা।
সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ সব সংবাদ, ছবি ,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন। ভিজিট করুন : http://www.etihad.news
* অনলাইন নিউজ পোর্টাল ইত্তেহাদ নিউজে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায় ।
ইত্তেহাদ নিউজ, এয়ার পোর্ট রোড, আবুধাবী ,সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইমেইল: [email protected], web:www.etihad.news
এম এম রহমান, প্রধান সম্পাদক, ইত্তেহাদ নিউজ, এয়ার পোর্ট রোড, আবুধাবী, সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে প্রকাশিত ও প্রচারিত