অনলাইনে উড়োজাহাজের টিকিট বুকিং:গ্রাহকের টাকা নিয়ে ফ্লাই ফার উধাও


ইত্তেহাদ নিউজ,অনলাইন : বারবার জালিয়াতির ঘটনা ঘটছে অনলাইনে উড়োজাহাজের টিকিট বুকিং খাতে। গ্রাহকের টাকা নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে একের পর এক অনলাইন ট্রাভেল এজেন্সি (ওটিএ)। টিকিট কেটে টাকা হারিয়ে নিঃস্ব হচ্ছেন সাধারণ ক্রেতা। নীতিমালা না থাকায় প্রতারকচক্র থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। সর্বশেষ বুধবার হুট করে বন্ধ হয়ে গেছে টিকিট বুকিংয়ের প্ল্যাটফর্ম ‘ফ্লাই ফার ইন্টারন্যাশনাল’। বিপাকে পড়েছেন হাজারো গ্রাহক ও টিকিট বিক্রেতা এজেন্সি।
বারবার এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি হওয়ায় নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ওটিএ নীতিমালা না থাকায় এমন ঘটনা ঘটছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্ট বাংলাদেশের (আটাব) সাবেক সভাপতি আব্দুস সালাম আরেফ বলেন, ‘এসব প্রতিষ্ঠান শুধু টিকিট বিক্রিতে সীমাবদ্ধ নয়, তারা মানি ম্যানেজমেন্টের নামে বাজার থেকে টাকা সংগ্রহ করে বিক্রি বাড়ায় এবং মূলত বিদেশে অর্থ পাচারের পথ তৈরি করে। চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে তারা গ্রাহক আকৃষ্ট করে, পরে টাকা নিয়ে উধাও হয়। আমরা ওটিএ নীতিমালার কথা বারবার বলেছি। কিন্তু কোনো এক অজানা কারণে সেটি এখনো হয়নি।’
সূত্রমতে, দেশে বর্তমানে ৪০ থেকে ৪৫টি ওটিএ প্রতিষ্ঠান থাকলেও ব্যবসা করছে ৫ থেকে ৭টি কোম্পানি। বাকিগুলো ওয়েবসাইটসর্বস্ব কোম্পানি খুলে রেখেছেন।
সম্প্রতি আলোচনায় আসা ফ্লাই ফার ইন্টারন্যাশনালের ওয়েবসাইটে ঢুকে কার্যক্রম বন্ধ দেখা যায়। ফেসবুক পেজটি ডি-অ্যাক্টিভেট এবং সব ফোন নম্বর বন্ধ। প্রধান কার্যালয় বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা রোড ক ৯/এ, হাজি আব্দুল লতিফ ম্যানসনের দ্বিতীয়তলায় সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, তালাবদ্ধ অফিসটির সামনে শত শত মানুষের ভিড়।
জসিম উদ্দিন নামের এক ভুক্তভোগী বলেন, ‘গতকাল আমরা তাদের কাছ থেকে টিকিট কেটেছি এবং অনলাইনে টাকা পরিশোধ করেছি। কিন্তু সকাল থেকেই কেউ ফোন ধরছেন না। অফিসে এসে দেখি তালা লাগানো।
সূত্রমতে, সারা দেশে ফ্লাই ফার ইন্টারন্যাশনালের প্রায় ১০ থেকে ১২ হাজার সাব-এজেন্ট রয়েছে। স্বপ্ন গ্লোবালের স্বত্বাধিকারী শৈশব মাহমুদ বলেন, ‘প্রায় সাড়ে ৪ লাখ টাকার টিকিট ইস্যু করি এবং সেই অর্থ সরাসরি ফ্লাই ফার ইন্টারন্যাশনালের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা দিই। কিন্তু এখন আর তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছি না। তাদের অফিস ও ফোন বন্ধ, আর টিকিটগুলো বাতিল করে দেওয়া হয়েছে। অনেক গ্রাহকের ফ্লাইট ছিল, এখন তারা যেতে পারছেন না।’
‘ফ্লাই ফার ইন্টারন্যাশনাল’, ‘ফ্লাই ফার ট্রিপস’ এবং বিশেষ করে নারী ভ্রমণকারীদের জন্য গড়া জনপ্রিয় ব্র্যান্ড ‘ফ্লাই ফার লেডিস’। ‘ফ্লাই ফার লেডিস’ ব্যাপক জনপ্রিয়তা ও আস্থা অর্জন করেছিল। কিন্তু সেই আস্থার জায়গাতেই এখন ধস নেমেছে।
ভুক্তভোগী আলেয়া আফরিন যুগান্তরকে বলেন, ‘তাদের ফেসবুক বিজ্ঞাপনে বিশাল ছাড় আর ইতিবাচক রিভিউ দেখে আমি দুবাই ভ্রমণের একটি প্যাকেজ কিনেছিলাম। প্রায় সাড়ে তিন লাখ টাকা পরিশোধ করার পর জানানো হয়, ভ্রমণের সাত দিন আগে টিকিট ও হোটেল বুকিংয়ের কপি দেওয়া হবে। কিন্তু এখন তাদের কোনো কর্মীকে পাওয়া যাচ্ছে না, ফোনও বন্ধ।’
তথ্যানুসন্ধানে দেখা যায়, ফ্লাই ফার ইন্টারন্যাশনাল তাদের নিজস্ব আন্তর্জাতিক বিমান পরিবহণ সংস্থা (আইএটিএ) নম্বর (৪২৩৩৯৮৮৩) ছাড়াও ভেলেনসিয়া, ডাইনামিকসহ বেশ কয়েকটি অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে টিকিট ইস্যু করেছিল। নির্ধারিত আইএটিএ পেমেন্ট পরিশোধ না করায় গণহারে গ্রাহকের টিকিট রিফান্ড শুরু করে। এতে শত শত গ্রাহক টিকিট এবং অর্থ দুটোই হারায়।
ভুক্তভোগী প্রায় ৮০০ সাব-এজেন্সির পক্ষে বৃহস্পতিবার বেসামরিক বিমান পরিবহণ ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর লিখিত অভিযোগপত্র জমা দেন। অভিযোগকারীরা জানান, ফ্লাই ফার ইন্টারন্যাশনাল তাদের কাছে যেসব টিকিট বিক্রি করেছিল সেগুলো সরাসরি ইস্যু করা হয়নি। ডায়নামিক ট্রাভেলস, হাজি এয়ার ট্রাভেলস ও ভেলেন্সিয়া ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলসের মাধ্যমে। ফ্লাই ফার ইন্টারন্যাশনাল পালিয়ে যাওয়ায় এই এজেন্সিগুলো টিকিটের অর্থ রিফান্ড করে আত্মসাৎ করেছে। সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
এ বিষয়ে ফ্লাই ফার ইন্টারন্যাশনালের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) নুসরাত জাহান ওপির সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ পাঠানো হলেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। পরে তার ফোনও বন্ধ পাওয়া যায়।
এ বছরের আগস্ট মাসের শুরুর দিকে প্রতারণা করে উধাও হয়ে যায় ফ্লাইট এক্সপার্ট। ২০১৭ সালের মার্চ মাস থেকে বাংলাদেশে তাদের কার্যক্রম শুরু করে। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিষ্ঠানগুলোর তুলনায় কম দামে টিকিট বিক্রির মাধ্যমে বাংলাদেশের বাজারে জনপ্রিয়তা পেয়েছিল এই প্ল্যাটফর্মটি। হুট করে প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায় ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সালমান বিন রাশিদ শাহ সাঈম।
২০২১ সালে বন্ধ হয়ে যায় ‘২৪টিকিট ডটকম’ নামের আরেকটি অনলাইন ট্রাভেল এজেন্সি (ওটিএ)। উড়োজাহাজের টিকিট বিক্রির নামে গ্রাহক ও ৬৭টি এজেন্টের কাছ থেকে প্রায় চার কোটি ৪৪ লাখ টাকা আত্মসাৎ করে উধাও হয় প্রতিষ্ঠানটি। একইভাবে ২০২৩ সালে ‘লেটস ফ্লাই’ নামের আরেকটি ওটিএ একই কায়দায় ৩৮টি ট্রাভেল এজেন্সির প্রায় ১০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করে উধাও হয়ে যায়। এ ঘটনায় এক কর্মী গ্রেফতার হলেও ক্ষতিগ্রস্তরা তাদের অর্থ ফেরত পাননি।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এ খাতে বারবার প্রতারণা হলেও কার্যকর নীতিমালা না থাকা অগ্রহণযোগ্য। এ সুযোগে কিছু প্রতিষ্ঠানের মালিক জনগণের আস্থা ও অর্থের সঙ্গে প্রতারণা এবং মানি লন্ডারিংয়ের মাধ্যমে বিদেশে সম্পদ গড়ে তুলছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা এর দায় এড়াতে পারে না। সরকারের, বাংলাদেশ ব্যাংক ও বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের সমন্বিত পদক্ষেপ জরুরি।
জানতে চাইলে আটাবের প্রশাসক বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মোতাকাব্বির আহমেদ বলেন, আমরা এ সংক্রান্ত কোনো অভিযোগ পাইনি। অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেব। এ বিষয়ে জানতে বেসামরিক বিমান ও পর্যটন উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত তিনি সাড়া দেননি।
সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ সব সংবাদ, ছবি ,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন। ভিজিট করুন : http://www.etihad.news
* অনলাইন নিউজ পোর্টাল ইত্তেহাদ নিউজে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায় ।