রাষ্ট্রয়াত্ব ইসলামী ব্যাংক: সংকট সম্ভাবনা ও ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ


দেশের অর্থনীতির এই ক্রান্তিলগ্নে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আর্থিক খাতকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নেয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। ক্ষতিগ্রস্ত ইসলামী ধারার ৫টি ইসলামী ব্যাংক- ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, স্যোশাল ইসলামী ব্যাংক, ইনিয়ন ব্যাংক ও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক একীভূত করে রাষ্ট্রমালিকানায় একটি শক্তিশালী ব্যাংক গঠনের উদ্যোগ নেয়া হয়। গ্রাহকদের জমাকৃত টাকা সুরক্ষা দিতে এবং দেশের ডুবতে বসা আর্থিক খাত উদ্ধার করতেই এই উদ্যোগ। ৩৫ হাজার ২শত টাকা পেইডআপ কেপিটাল নিয়ে রাষ্ট্রীয় মালিকানায় দেশের সবচেয়ে বড় ইসলামী ব্যাংক হিসেবে এর কার্যক্রম শুরু হচ্ছে অল্পদিনের মধ্যেই।
বিশেষজ্ঞদের মতে ব্যাংক খাতের এই অসময়ে একীভূতকরণই একমাত্র সমাধান। সার্বিক বিবেচনায় অবসায়ন ছাড়া ক্ষতিগ্রস্থ ব্যাংকগুলো উদ্ধারের কোনো পথ খোলা ছিলো না। শুধুমাত্র গ্রাহকদের আর্থিক ক্ষতির হাত থেকে বাচাঁতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে।
রাষ্ট্রয়াত্ব ইসলামী ব্যাংকের সম্ভাবনা-
রাষ্ট্রমালিকানাধীন একমাত্র ইসলামী ব্যাংক: বাংলাদেশে ১৯৮৩ সালে ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থা চালু হলেও সরকারি মালিকানায় এটাই প্রথম ইসলামী ব্যাংক। ইসলামী ব্যাংকিং খাতকে লুটেরাদের হাত থেকে বাচাঁতে এবং সুশাসন ফিরিয়ে আনতে অন্তবর্তীকালীন সরকার এই উদ্যোগ গ্রহণ করে। বর্তমানে ইসলামী ব্যাংকিং খাতে গ্রাহকদের আস্থা সঙ্কট প্রকট আকাড় ধারন করেছে। ইউনাইটেড ইসলামী ব্যাংক রাষ্ট্রমালিকানায় পরিচালিত ব্যাংক হিসেবে এতে গ্রাহকদের জমাকৃত টাকার সুরক্ষা নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে হবে না।
সর্বোচ্চ পরিশোধিত মূলধন: রাষ্ট্রয়াত্ব এই ইসলামী ব্যাংক দেশের ব্যাংকিং ইতিহাসে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে যাচ্ছে। প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকার পরিশোধিত মূলধন নিয়ে এটি যাত্রা শুরু করবে, যা এটিকে দেশের সর্ববৃহৎ ও সবচেয়ে শক্তিশালী মূলধনের অধিকারী ব্যাংকে পরিণত করবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর এই ব্যাংকের বিশালতা তুলে ধরে বলেছেন, অন্যান্য সব ব্যাংকের মূলধন একত্রিত করলেও এর মূলধনের সমান হবে না-এটার সাথে অন্য কোনো ব্যাংকের তুলনা হবে না। এছাড়াও ইউনাইটেড ইসলামী ব্যাংকের রয়েছে ২.১৯ ট্রিলিয়ন টাকার বেশি সম্পদ।
বৃহত্তর নেটওয়ার্ক: একীভূত হওয়া ৫ ব্যাংকের ৭৭৯টি শাখা, ৬৯৮টি উপশাখা, ১ হাজারের অধিক এজেন্ট আউটলেট এবং ১৬ হাজারের বেশি কর্মীর এক বিশাল নেটওয়ার্ক নিয়ে এই ব্যাংকটি বড় প্রকল্পে অর্থায়ন এবং তৃণমূল পর্যায়ে সেবা পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে অসামান্য ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।
রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় আস্থা পুনরুদ্ধার: নতুন ব্যাংকটি সম্পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন হওয়ায় এবং সরকার সরাসরি এর মূলধনের যোগান দেওয়ায় আমানতকারীদের মধ্যে আস্থা দ্রুত ফিরে আসবে বলে আশা করা হচ্ছে। সরকারের সরাসরি তত্ত্বাবধান ও একটি স্বাধীন পরিচালনা পর্ষদ অতীতের অনিয়ম ও দুর্নীতির পুনরাবৃত্তি রোধ করে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করবে, যা গ্রাহকদের তাদের আমানতের নিরাপত্তা বিষয়ে আশ্বস্ত করবে।
অন্তর্ভূক্তিমূলক ব্যাংকিং-এর সুযোগ: দেশজুড়ে প্রায় ১৫শত শাখা এবং হাজারের অধিক এজেন্ট আউটলেট নিয়ে চালু হওয়া ইউনাইটেড ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর মাঝে ব্যাংকিং সেবা পৌছেঁ দেয়া যাবে। যার মাধ্যমে বৈষম্যহীন আর্থিক অন্তর্ভূক্তিমূলক ব্যাংকিং ব্যবস্থার দিগন্ত উন্মোচিত হবে।
ইউনাটেড ইসলামী ব্যাংকের চ্যালেঞ্জ:
খেলাপিঋণের বোঝা: পাঁচটি সমস্যাগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানের বিশাল অঙ্কের খেলাপি ঋণ (NPL) নিয়ে যাত্রা শুরু করবে ইউনাইটেড ইসলামী ব্যাংক। এই ব্যাংকগুলোর সম্মিলিত খেলাপি ঋণের হার প্রায় ৭৭%, যা প্রায় ১.৪৭ লক্ষ কোটি টাকা। ইউনিয়ন ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার ৯৮% পর্যন্ত পৌঁছেছে। এই বিপুল পরিমাণ মন্দ ঋণ আদায় করা এবং ব্যাংকের ব্যালেন্স শিট পরিষ্কার করা হবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। অবশ্য খেলাপিঋণ পুনরুদ্ধারের জন্য এগুলো লায়াবিলিটি ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির নিকট হস্তান্তর করা হবে বলে জানিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
আইনী জটিলতা ও রাজনৈতিক সদিচ্ছা: ক্ষতিগ্রস্ত ৫টি ইসলামী ব্যাংক একীভূতকরণ ও রাষ্ট্রয়াত্ব নতুন ব্যাংক গঠন নিঃসন্দেহে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের একটি বড় উদ্যোগ। তবে যে অধ্যাদেশ বলে একীভূতকরণ ও নতুন ব্যাংক গঠন করা হয়েছে সেটার বৈধতার ব্যাপারে সংসদের অনুমোদন নিয়ে ভবিষ্যতে প্রশ্ন উঠতে পারে। পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া এ সংস্কার টিকিয়ে রাখা এবং এর সুফল স্থায়ী হওয়ার সম্ভাবনা কম।
পরিচালনগত একীভূতকরণ: পাঁচটি ভিন্ন ব্যাংকের আইটি প্ল্যাটফর্ম, প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কৃতি, মানবসম্পদ নীতি এবং কর্মপ্রক্রিয়াকে একক কাঠামোতে আনা একটি অত্যন্ত জটিল ও সময়সাপেক্ষ কাজ। এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে দুই থেকে পাঁচ বছর পর্যন্ত সময় লাগতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
নেতৃত্ব ও সুশাসন: ইউনাইটেড ইসলামী ব্যাংকের সাফল্য নির্ভর করবে একটি পেশাদার, স্বাধীন এবং রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনার ওপর। যদি পুরনো অনিয়মের পুনরাবৃত্তি ঘটে তবে এ সমস্যার সমাধান হওয়া অসম্ভব। এ থেকে উত্তরণের জন্য ব্যাংকগুলোকে শুদ্ধি অভিযান চালাতে হবে। মানব সম্পদের মধ্যে লুকিয়ে থাকা দুর্নীতিগ্রস্থ বা দুর্নীতিগ্রস্থদের সহযোগীদের খুজে বের করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে শুরু থেকেই।
মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা: ১৬ হাজারের বেশি কর্মকর্তা-কর্মচারি, তাদের বেতন কাঠামো এবং পদোন্নতি নিয়ে সৃষ্ট উদ্বেগ সঠিকভাবে সমাধান করতে না পারলে অভ্যন্তরীণ অসন্তোষ দেখা দিতে পারে, যা ব্যাংকের কার্যক্রমে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
ইউনাইটেড ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠা বাংলাদেশের আর্থিক খাতের জন্য একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এর সাফল্য নির্ভর করছে স্বচ্ছতা, কঠোর জবাবদিহিতা এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছার ওপর। যদি সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা যায়, তবে এটি কেবল ইসলামী ব্যাংকিং নয়, পুরো খাতের জন্যই একটি ইতিবাচক পরিবর্তনের সূচনা করতে পারে।
লেখক: ইসলামী ব্যাংকার।