ইত্তেহাদ এক্সক্লুসিভ

পরমাণু শক্তি কমিশনের আওয়ামী দোসর শীর্ষ দুই কর্মকর্তা বোল পাল্টে রাতারাতি দ্বিগুণ ক্ষমতাবান

আওয়ামী দোসর শীর্ষ দুই কর্মকর্তা..
print news

আওয়ামী সরকারের টেকনোক্রেট মন্ত্রী ইয়াফেস ওসমানের ‘ডানহাত’বলে পরিচিত ছিলেন পরমাণু শক্তি কমিশনের (বাপশক) চেয়ারম্যান (চলতি দায়িত্ব) ড. মো. মজিবুর রহমান এবং বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের বর্তমান মহাপরিচালক ড. এ এস এম সাইফুল্লাহ। মন্ত্রী, মন্ত্রীপুত্র এবং মন্ত্রীর পিএস’র সঙ্গে বিশেষ সম্পর্কের সূত্রে এরা হয়ে উঠেছিলেন অত্যন্ত ক্ষমতাবান। যে কারণে বিভিন্ন প্রকল্পের অধীন যন্ত্রপাতি কেনাকাটায় অনিয়মসহ ব্যাপক দুর্নীতি সত্ত্বেও এদের বিরুদ্ধে কোনোই ব্যবস্থা নেয়া যায়নি। এমনকি মন্ত্রী এবং পিএস’র প্রভাব খাটিয়ে সিনিয়রদের ডিঙিয়ে অবৈধ প্রক্রিয়ায় একের পর এক পদোন্নতিও বাগিয়ে নিয়েছিলেন। সেই ফ্যাসিস্ট আওয়ামী দোসর ও দুর্নীতিবাজ ড. মজিবুর ও ড. সাইফুল্লাহ বোল পাল্টে বিএনপি-জামায়াত ট্যাগ লাগিয়ে নিয়েছেন। রাতারাতি হয়ে উঠেছেন আগের চেয়েও দ্বিগুণ ক্ষমতাবান! সিনিয়রদের ডিঙিয়ে আগের আমলে নেয়া পদোন্নতির পদে বহাল থাকার পর এই আমলে আবারও অবৈধভাবে নতুন করে পদোন্নতি বাগিয়ে নিয়েছেন। এমন পরিস্থিতিতে ক্ষমতার প্রভাব বেড়ে যাওয়ায় এই দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার অতীত অপকর্মের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া তো যাচ্ছেই না, এখন তারা আরও নতুন দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

আওয়ামী সরকারের আমলে “দেশের ৮টি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ক্যাম্পাসে ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার মেডিসিন অ্যান্ড এ্যালায়েড সায়েন্সেস (ইনমাস) স্থাপন” নামক প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালকের পদ বাগিয়ে নেন ড. মো. মজিবুর রহমান। অন্যদিকে ফুড অ্যান্ড রেডিয়েশন বায়োলোজি আধুনিকীকরণের জন্য আইএফআরবি’র অধীনে একটি প্রকল্প নেয়া হয়। এই প্রকল্পটির নামেমাত্র পরিচালক ছিলেন যদিও ড. মাসুদ রানা, বাস্তবে এই প্রকল্পের নেপথ্য পরিচালক হিসেবে সকল কলকাঠি নাড়তেন ড. এ এস এম সাইফুল্লাহ। মন্ত্রীর প্রভাবে তিনিই ছিলেন এই প্রকল্পের একচ্ছত্র নেপথ্য ক্ষমতাবান। দুটি প্রকল্পেই ব্যাপক দুর্নীতি-লুটপাট হয়েছে। দুর্নীতিতে ধরাও পড়েছে। কিন্তু তারপরও তাদের বিরুদ্ধে কোনোই ব্যবস্থা নেয়া যায়নি।
বিগত স্বৈরাচার সরকারের দোসর ও দুধের মাছি হিসেবে খ্যাত ড. মজিবুর রহমান ও ড. সাইফুল্লাহ অনৈতিক সুবিধা ভোগ করেছেন। কয়েকজন বিজ্ঞানী নিয়ে একটি সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন এরা। পরমাণু শক্তি কমিশনের কর্মকর্তাদের কাছে এই দুই কর্মকর্তা ছিলেন আতঙ্ক। তাদের ক্ষমতার নেপথ্যের খুঁটি ছিল পালিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনা সরকারের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী ইয়াফেস ওসমান, ইয়াফেসপুত্র এশরার ওসমান সুমিত এবং মন্ত্রীর দুই পিএস জাফরুললাহ (প্রথম) এবং মো. কায়েসুজজামান (দ্বিতীয়)।

এদের প্রভাব খাটিয়েই ড. মজিবুর জুনিয়র কর্মকর্তা হয়েও নিয়মনীতির উর্ধ্বে বাগিয়ে নেন কমিশনের ‘সদস্য, জীব বিজ্ঞান পদ’। এছাড়া সদস্য পদ বাগিয়ে নেওয়ার পূর্বে জুনিয়র হয়েও তিনি কমিশনের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ (আইএডি) এর পরিচালক পদ বাগিয়ে নেন। অবশ্য, এসব পদোন্নতিতে কোনো কোনো পর্যায়ে তিনি আওয়ামী সরকারের ডিপুটি স্পিকার শওকত আলীর প্রভাবকেও কাজে লাগান। কমিশনে অভিযোগ আছে যে, পরিচালক পদে থেকে বৈদেশিক ট্রেনিং বাণিজ্য করা এবং তার ক্ষমতার গুরুদের বিদেশ ভ্রমণের আয়োজন ছিল ড. মজিবুরের নিত্যকর্ম। মন্ত্রী, মন্ত্রীপুত্র ও পিএস সিন্ডিকেটের সদস্য থাকায় মজিবুর রহমান পরিচালিত প্রকল্পের অনিয়ম-দুর্নীতিও চাপা পড়ে যায়।

ইয়াফেসপুত্র এশরার ওসমান সুমিত বেশিরভাগ সময়ই বিদেশে থাকতেন। তবে বিদেশে বসেই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সবকিছুতে ছিল তার খবরদারি। পিএস মো. কায়েসুজজামান, মন্ত্রীপুত্র এশরার ওসমান, ড. মজিবুর ও ড. সাইফুল্লাহ নিজেদের মধ্যে ব্যবসায়িক সম্পর্কও গড়ে তুলেছিলেন এক পর্যায়ে। কায়েসুজ্জামান ইতিপূর্বে এক সময় ছিলেন রাজউকের উপপরিচালক (এস্টেট) পদে। প্লট দুর্নীতির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ ছিল তার বিরুদ্ধে। মন্ত্রীর পিএস পদের প্রভাব খাটিয়ে দুদকের এসব তদন্ত তিনি ধামাচাপা দিতে সক্ষম হন। এই কায়েসুজ্জামান এবং মন্ত্রীপুত্রের সঙ্গে সখ্যতার সুবাদে পরমাণু শক্তি কমিশনের কর্মকর্তা ড. মজিবুর এবং ড. সাইফুল্লাহও হয়ে উঠেছিলেন বেপরোয়া দুর্নীতিবাজ। হাসিনা সরকারের আমলে টানা চার বার মন্ত্রীত্ব পাওয়া অত্যন্ত প্রভাবশালী মন্ত্রী ইয়াফেস ওসমানের ছত্রছায়ায় ১০ বছরে ৩৩ বার বিদেশ সফর করেছেন ড. সাইফুল্লাহ। এছাড়া, ৩০ মে-১ জুন, ২০১৭ আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার ৬০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে স্বৈরাচার হাসিনার সফরসঙ্গী হিসেবে ড. সাইফুল্লাহ কমিশনের পক্ষ থেকে ডেলিগেট হিসেবে ভিয়েনা যান। পরমাণু শক্তি সংস্থার ৬০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে অনুষ্ঠিত কনফারেন্সে শেখ হাসিনার সাথে ড. সাইফুল্লাহর ছবি প্রমাণ করে যে স্বৈরাচার সরকারের সাথে ড. সাইফুল্লাহর খুবই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। এখানে আরো উল্লেখ্য যে IAEA থেকে এই সফরের জন্য অর্থায়ন পাওয়ার পরও, তিনি তার আওয়ামী ক্ষমতাবলে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন থেকেও অতিরিক্ত অর্থ বাগিয়ে নেন।

অবাক ব্যাপার হলো, ৫ আগস্ট, ২০২৪ এর পরে মুজিব কোট পাল্টে রাতারাতি বিএনপি-জামায়াত বনে যান পরমাণু শক্তি কমিশন কেন্দ্রীক সিন্ডিকেটের হোতা এই দুই কর্মকর্তা। উভয়ে নতুন করে আগের মতো অবৈধ পদোন্নতিও বাগিয়ে নেন। নিয়ম অনুযায়ী ইতিপূর্বে যারা বৈষম্যের শিকার হয়েছেন এই অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে তাদেরই পদোন্নতি হওয়ার কথা। কিন্তু এর পরিবর্তে পদোন্নতি পেয়েছেন আওয়ামী দোসর ও সিন্ডিকেটের হোতা ড. মজিবুর রহমান এবং ড. এ এস এম সাইফুল্লাহ। ড. মজিবুর রহমান সদস্য (জীব বিজ্ঞান, চলতি দায়িত্ব) পদ থেকে চলতি দায়িত্বে চেয়ারম্যান হয়েছেন। আর ড. সাইফুল্লাহ হয়েছেন পরমাণু শক্তি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের মহাপরিচালক । অন্তর্বর্তী সরকারের বিশেষ মহলকে মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে আওয়ামী ফ্যাসিস্ট এই দুই দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা পদোন্নতি বাগিয়ে নেন বলে অভিযোগ রয়েছে। সিনিয়র চারজন বিজ্ঞানীকে ডিঙিয়ে তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে সাভারস্থ পরমাণু শক্তি গবেষণা প্রতিষ্ঠান (AERA) এর মহাপরিচালকের পদটি ছিনিয়ে নেন এ এস এম সাইফুল্লাহ। অন্যদিকে ড. মজিবুর ইতিপূর্বে যাদের ডিঙিয়ে সদস্য হয়েছেন তাদেরই আগে পদোন্নতি হওয়ার কথা। কিন্তু তাদের পদোন্নতি না দিয়ে মজিবুর রহমানকে চলতি দায়িত্বে চেয়ারম্যান করা হয়।

বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের (বাপশক) একজন প্যানেল আইনজীবীর তথ্যানুযায়ী, ড. মো. মজিবুর রহমান সরকারি চাকরিবিধি পরিপন্থি কাজ করা একজন কর্মকর্তা হিসেবেও চিহ্নিত বাপশক প্রশাসনের কাছে। তিনি কমিশনের অফিস আদেশের বিরোধিতা করে সরকারের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে রিট পিটিশন করেন। যা পরবর্তীতে খারিজ করে দেয় উচ্চ আদালত।

জানা গেছে, আওয়ামী সরকারের ডিপুটি স্পিকার শওকত আলীর ঘনিষ্ঠতায় বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ সচিবালয়ে সিনিয়র সহকারী সচিব হিসাবে প্রেষণে নিয়োগ নেন মজিবুর রহমান। প্রেষণে থাকা অবস্থায়ও কমিশনে প্রভাব খাটিয়ে বিজ্ঞানীদের চাকরির বিষয়ে খবরদারি করতেন তিনি। পরবর্তীতে প্রেষণ থেকে ফিরে ডিপুটি স্পিকারের প্রভাব খাটিয়ে অনেক সিনিয়রকে ডিঙিয়ে রাতারাতি কমিশনে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ পরিচালক হয়ে যান মজিবুর রহমান।

এছাড়া, সাবেক মন্ত্রী ইয়াফেস ওসমান এবং তার ছেলের প্রিয়ভাজন হয়ে প্রথম ধাপে ৫৮২ কোটি ও পরবর্তীতে প্রায় ১০০ কোটি টাকা বৃদ্ধি করে ৬৮৬ কোটি টাকার প্রকল্প নিজের নামে নিয়েছেন মজিবুর রহমান। কমিশনে অভিযোগ ছিল, পছন্দের ঠিকাদারকে কাজ দিয়ে কমিশন বাণিজ্যের জন্য তার প্রকল্পে একটি মেশিন এর স্থলে বিভিন্ন ধরনের একাধিক মেশিন ক্রয়, আবার নিম্নমানের যন্ত্রপাতি অধিক মূল্যেও কিনেছেন। জনবলের যেখানে অপ্রতুলতা, সেখানে প্রয়োজনের অতিরিক্ত যন্ত্র ক্রয় যা পরবর্তীতে নষ্ট হয়ে যাওয়ার কথা জানিয়েছেন কমিশনের কর্মকর্তারা। প্রতিটি ইনমাসে ৩ তলা বিল্ডিং করাই যথেষ্ট হওয়ার পরও প্রকল্পে ব্যয় বাড়ানোর উদ্দেশ্যে ৬ তলা বিল্ডিং করা হয়েছে। যা রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কমিশনকে এখন অপ্রয়োজনীয় অতিরিক্ত ব্যয় বহন করতে হচ্ছে।

সূত্র জানিয়েছে, মজিবুর রহমান যেসব ঠিকাদারকে অবৈধ সুবিধা দেন তাদের টাকায় দুই ছেলে মেয়েকে অস্ট্রেলিয়ায় লেখাপড়া করাচ্ছেন তিনি। প্রতি মাসে দুই ছেলের খরচ বাবদ ৫ থেকে ৬ লাখ টাকা কয়েকজন ঠিকাদারের একাউন্ট থেকে পাঠানো হয় অস্ট্রেলিয়ায়।

কমিশনের একটি নথি থেকে জানা যায়, গণমাধ্যমে বহুল আলোচিত বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ (ডিআরআইসিএম) এর বিতর্কিত বিজ্ঞানী মালা খানের পিএইচডি ডিগ্রি এবং তার প্রকল্পের দুর্নীতির তদন্তের জন্য গঠিত কমিটিতে বিশেষজ্ঞ বিজ্ঞানী সদস্য হিসেবে মজিবুর রহমানকে দায়িত্ব দেন সাবেক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী ইয়াফেস ওসমান। দায়িত্ব পেয়ে মালা খানের পিএইচডি’র বৈধতার সুপারিশ করেন তিনি। অথচ, যে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি দেওয়া হয়, সেটি সরকার অননুমোদিত এবং অবৈধ ক্যাম্পাস ছিল। এমনকি পিএইচডি ডিগ্রি বিক্রির দায়ে তৎকালীন সরকার ওই বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেয়।

 

সর্বশেষ  গুরুত্বপূর্ণ  সব  সংবাদ, ছবি ,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও লেখা পেতে আমাদের  ফেসবুক পেইজে  লাইক  দিয়ে  অ্যাকটিভ  থাকুন।  ভিজিট করুন : http://www.etihad.news

অনলাইন  নিউজ পোর্টাল  ইত্তেহাদ নিউজে  লিখতে  পারেন  আপনিও। লেখার বিষয়  ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন  [email protected] ঠিকানায় ।

সংবাদটি শেয়ার করুন....
ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক :

ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক :

About Author

etihad news is one of the famous Bangla news portals published from Abudhabi-UAE. It has begun with a commitment to fearless, investigative, informative, and independent journalism. This online portal has started to provide real-time news updates with maximum use of Smart Technology.